“ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।”
—হুমায়ুন আজাদ,শুভেচ্ছা
বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট নাম হুমায়ুন আজাদ। জীবদ্দশায় দুটি অভিধা তার নামে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হত, এবং সম্ভবত সাহিত্যের অনন্তপথ যাত্রাতেও হবে- ‘প্রথাবিরোধী’ এবং ‘বহুমাত্রিক’। এ দুটি উপাধি তার জন্যে কতখানি প্রাসঙ্গিক তা তার রচিত সাহিত্যভাণ্ডারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, কিশোর সাহিত্যিক ও কলামিস্ট।সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তিনি সদর্পে বিচরণ করেননি।
‘কিশোর সাহিত্যিক’ পরিচয়টি একজন ‘হুমায়ুন আজাদ’-এর পক্ষে মোটেই যথেষ্ঠ নয়, মানি, কিন্তু তার অনন্য স্বকীয় ঢঙ আর মেজাজ তার কিশোরসাহিত্যে দিয়েছে সত্য ও সৌন্দর্যের অনাবিল চিত্ররূপ।কিশোরদের জন্য তিনি খুব বেশি লিখেছেন, তা বলা চলে না, কিন্তু যা লিখেছেন তা একইসাথে মধুর, সুললিত, চিত্তসঞ্চরণশীল এবং দেদীপ্যমান। সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে তার প্রতিভা ও মননের এক অসাধারণ দিক উন্মোচনকারী কিশোরপাঠ্য বইগুলোর মধ্যে বিশিষ্টতর বক্ষ্যমাণ ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটি। এর প্রকাশকাল নভেম্বর ১৯৮৫। পরবর্তীতে আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হুমায়ুন আজাদ কিশোরসমগ্রে বইটি সংকলিত হয়। ২০০৩ সালে বইটি অনূদিত হয় জাপানি ভাষায়।
‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’- বইটি মূলত হুমায়ুন আজাদের আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ। হুমায়ুন আজাদের জন্ম ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। ছোটবেলাতেই গ্রামের উদার-মহতোমহীয়ান সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েন তিনি। চারপাশে প্রকৃতির সুন্দর ভাষা, শব্দ, ছন্দ আর সঙ্গীতের সমন্বিত স্বপ্নালি সুরলহরী তাকে মোহিত করত। রাঢ়িখাল গ্রামে তার মন আকুল করা গাঁয়ের ডাক, ফুলের গন্ধ, আড়িয়ল বিলের জলস্রোত, সবুজের স্নিগ্ধতা, মানুষের সবরকম জটিলতাবর্জিত সহজ-সরল জীবনলগ্ন বেদনাবিধুর স্মৃতি নিয়ে রচিত হয়েছে ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটি।
বইয়ের শুরুতে দেখা যায়, লেখক তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করছেন জ্যেষ্ঠ কন্যা মৌলিকে উদ্দেশ্য করে। তবে বর্ণনাভঙ্গি আর পরিবেশচিত্রণে এটি পরিণত হয়েছে মনোলোগ শ্রেণীর গদ্যগ্রন্থে। এক টুকরো খণ্ডচিত্র। আকর্ষণীয় এবং সুকোমল শিরোনামে ছোট ছোট ১৭ রচনায় লেখক দিয়েছেন তার শৈশববেলার ধারাবিবরণী।
প্রথম রচনা ‘ফুলের গন্ধ’ লেখক শুরু করছেন এভাবে,
মৌলি, তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি একসময় ছিলাম- ছোট, ছিলাম গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর গাছের ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলদে ফুল। একটা খাল পুকুর থেকে বের হয়ে পুঁটিমাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চলে গেছে বিলের দিকে। তার উপর একটি কাঠের সাঁকো। নিচে সাঁকোর টলোমলো ছায়া। তার নাম গ্রাম… তার কিছুটা তোমাকে শোনাই, হে নাগরিক মৌলি, যে গ্রাম তুমি দেখো নি, পাতায় পাতায় দেখো নি নিশির শিশির
সহজেই বোঝা যায়, শিল্পীর ছবির এ প্রথম দৃশ্যপট। সে ছবি আজকের নাগরিক সভ্যতার যুগের ছবি নয়, সে ছবি শহুরে শক্ত কংক্রিট-নিয়ন বাতি আর গোঁ-গোঁ করা ট্রাকের উল্লাস থেকে বহু দূরে আশ্বিনের সাদা মাখন-জোৎস্নায় ঝলমলে আর মাঘের ওশ-মাখা বাতাসে ভরপুর এক গাঁয়ের ছবি। লেখক স্বপ্নের মতো এক গ্রামের বর্ণনা দিচ্ছেন, যে গাঁয়ে ছিল শিশিরের আস্তরণ, কচুরি ফুলের শোভা, নালি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়া খেজুরের সোনালি রস, গুড় আর রসের মিঠা বাতাস এবং আরো আরো অনেক কিছু।
পরের ছবিটির নাম ‘পুকুরে প্রদীপ জ্বলে’। পুকুরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা কচুরি ফুলের গুচ্ছ আজাদের চোখে হয়ে উঠছে শত শত প্রদীপের ঝাড়বাতি। গোলাপ নয়, তার কাছে পুকুরের ঝাড়লণ্ঠন ঐ কচুরিই সবচে’ সুন্দর ফুল। কচুরি ফুলের দীপাবলির মতোই লেখকের স্বপ্নকে নাড়া দিয়েছে ঢল ঢল কাঁচা লাউডগা। লাউডগার বিস্তৃতি দেখে তার মনে হয়েছে,
সব গাছই তো স্বপ্ন দেখে আকাশের, কিন্তু লাউডগা স্বপ্ন দেখে দিগন্তের… পশ্চিমে যেখানে নীল মেঘের দিগন্ত ঠেকে আছে ঘাসে-মাটিতে-পানিতে। আমার মনে হয় অনেক অনেক আগে যেদিন প্রথম জন্ম নিয়েছিল লাউডগা, তার জন্ম হয়েছিল আপন বেগে পাগলপারা কোনো নদীর পাড়ে। নদীকে দেখে দেখে বইতে শিখেছিলো সে। আজও লাউডগা তার শেকড় ছাড়িয়ে ভিটে পেরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় দিগন্তের দিকে- ঘাসের ওপর পড়ে থাকে এক দীর্ঘ সবুজ চঞ্চল সুদূরপিয়াসী স্বপ্ন।
সামান্য কচুরি ফুল আর লাউডগার বর্ণনা যে এরকম মনোমুগ্ধকর, আর এমন স্বপ্নিল হতে পারে- তা কি কখনও কল্পনা করি আমরা! একইভাবে ‘খেজুর ডালে সাদা বেলুন’, ‘খেজুর ডালের ঘোড়া’, ‘মধুর মতো ভাত’, ‘টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ’, ‘পদ্মার রূপোলি শস্য’- প্রভৃতি রচনায় লেখকের উপমা এবং চিত্রকল্পের প্রাঞ্জলতা একইসাথে বিস্ময়কর এবং হৃদয়গ্রাহী।
‘বিলের ধারে প্যারিস শহর’- রচনায় যদুবাবুর জমিদারবাড়ি আবিষ্কার, সবিস্ময়ে তার সৌন্দর্যে অবগাহন, রহস্য-বিভোর দৃষ্টি এবং সানুরাগে একে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর প্যারিস বলে অভিহিত করা যেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার রেললাইন আর ট্রেন আবিষ্কারের নস্টালজিক দৃশ্যে। এছাড়া কৈশোর বিস্ময়ের অনবদ্য রূপায়ণ ‘ঐ বাড়িটা কার’, ‘দুপুরের দীর্ঘশ্বাস’-এও স্বমহিমায় প্রকট।
প্রকৃতির ছবির পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনের ছবিও এ বইতে সসৌন্দর্যে প্রখর। ‘দুই ভাই’তে তিনি কিশোর চোখে এঁকেছেন ধনী-নির্ধনের প্রভেদের ছবি। তিনি তাদের গ্রামের মানুষদের ভাগ করেছেন তিন ভাগে—এক ভাগ ধনী, যারা থাকে সুন্দল বাড়িতে; তারা কোনো কাজ করে না, কিন্তু গ্রামে দাপিয়ে বেড়ায়, পথে পথে তারা সালাম পায়। ধনীক শ্রেণীর চাটুকার মধ্যবিত্ত লোকদেরকে লেখক দেখছেন দ্বিতীয় ভাগে। আর তৃতীয় ভাগ সম্পর্কে লেখকের সকরুণ বর্ণনা,
তারা গরীব, সারাদিন শুধু কাজ করে। গরু নিয়ে যায় মাঠে, ধান বোনে, ঠাণ্ডা পানিতে নেমে মাছ ধরে। তারা মানুষের সাথে যতটুকু কথা বলে, তার চেয়ে বেশি কথা বলে গরু-বাছুর আর মাঠের ধান-গাছ-সবজির সাথে। এদেরকে কেউ সালাম দেয় না, কেউ ভয় পায় না; এরা সালাম দেয় সবাইকে।… প্রথম দু’রকম মানুষ কোনোদিন আমাকে মুগ্ধ করে নি, আমাকে মুগ্ধ করেছিলো তৃৃৃৃতীয় রকমেরা।
এই তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের জীবনে ভরপেট আহার জুটেছে স্বল্পদিনই। একমুঠো ভাতের প্রতি তাদের ছিলো হীরে-পান্না-মণি-মাণিক্য সদৃশ মুগ্ধতা, কোনোদিন জামা গায়ে পরেনি, পা’জামাও পরতে দেখা যায়নি কখনও, অথচ গ্রামের পুকুর, মাছ, বিলের ঘাসদল আর সবুজ কুমড়োলতার সমাহার যেন ছিলো তাদের জন্যই। শৈশবের নিষ্পাপ চোখে লেখক দেখেছেন ক্ষুধায় কাতর জোলাবাড়িসহ তার আশপাশ, কিন্তু তাকে অবাক করেছে এদের প্রকৃতিলগ্ন আনন্দ, সারল্য, অকৃত্রিমতা, সৌন্দর্যবোধ আর দীনতা- সংশয়হীন গতিময় জীবন। লেখকের মুগ্ধ বয়ান,
ওরা কি জানতো পৃথিবী ঘোরে? তারা কি জানতো যে শহর আছে পৃথিবীতে, শহরে আছে বড়ো বড়ো রাস্তা? তারা কেবল জানতো, বিলের ওপাশে পৃথিবী নেই। রূপোলি ইলিশ আর সোনালী ধানের চারার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই!
গ্রামের অপূর্ব মাদকতাময় কিছু হাতছানির বর্ণনার পর শেষদিকে লেখকের বর্ণনায় ফুটে ওঠে নিঃসীম হাহাকার, ঝরে ব্যাকুল দীর্ঘশ্বাস। কলেরায় তার ছোট ভাই কালামের মৃত্যু কী গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলো তার সমস্ত সত্তাকে, ছোট বয়সে নিকটজনের বিয়োগব্যথা ব্যথিত করেছিলো কতটা- তার মর্মস্পর্শী এবং শৈল্পিক বর্ণনা পাঠকের চোখে জল আনার মতো। নগরায়ণের গ্রাসে রাঢ়িখালের সৌষ্ঠবের অপমৃত্যুর সকরুণ বর্ণনা ফুটে উঠেছে ‘গ্রামের মৃত্যু’তে। বইয়ের শেষ রচনা ‘আমি ডাক পাড়ি’ বোধকরি জন্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধার্থেই লিখিত হয়েছে রাঢ়িখালের আঞ্চলিক ভাষায়। রাঢ়িখালের গ্রামের জন্য তার হৃদয়ছেঁড়া বিলাপ,
আমি কত ডাক পারি। তুমি হুমইর দ্যাওনা ক্যান? তোমারে ভুলুম ক্যামনে? তুমি ভুইল্লা যাইতে পার, আর আমিতা পারুমনা কোনো কাল। আমি আছিলাম পোনর বচ্ছর ছয় মাস তোমার ভিৎরে। থাকুম পোনর শ বচ্ছর….রারিকাল। রারিকাল। আমি কত ডাক পারি। তুমি ক্যান হুমইর দ্যাও না?
‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’র সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক নিঃসন্দেহে হুমায়ুন আজাদের ব্যঞ্জনাময় সুললিত কাব্যিক ভাষা। লেখকের ভাষায় থেকে থেকে ফুটে ওঠা কাব্যবোধ পাঠককে চমকিত করবে। তার সাহিত্যকর্মের সাক্ষ্যে তার কবি পরিচিতি নিঃসন্দেহে অবিসংবাদিত। যেহেতু বইটি স্মৃতিচারণমূলক, তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার বর্ণিত জীবনাভিজ্ঞতাতেই সহজাত কাব্যবোধ মিশে ছিলো পরতে পরতে। হাসি, আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, ভালোবাসা, হতাশা, হাহাকার প্রভৃতি মানবিক আবেগের ওঠা-নামা এবং লেখকের উপমার প্রাঞ্জলতা তুলনারহিত।
ভরা বর্ষার মুগ্ধতার পাশাপাশি নানা বাড়ি কামারগাঁয়ের কথা, কীর্তিনাশা পদ্মার বুকে নাওয়ের ভীষণ কাটালের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া, অলৌকিক ইস্টিমারের মধুর আওয়াজ, জালে ধরা পড়া চাঁদের মতো ইলিশ- পড়তে পড়তে মনে হয় আবেগ, হতাশা, সৌন্দর্যমুগ্ধতার সমন্বয়ে এটি শুধু সাবলীল বর্ণনাই নয়, আরো বেশি কিছু- কোনো দক্ষ শিল্পীর তুলির আঁচড়ের অপূর্ব সমন্বয়। লেখক যেন যাদুকরের অলৌকিক ক্ষমতায় আশেপাশের সময়কে স্তব্ধ করে আমাদেরকে নিয়ে যান তার প্রিয় রাঢ়িখালে, জগদীশচন্দ্র বসুর রাঢ়িখালে, তার প্রিয় পানু আপা, বাদশা’দা এবং মন্নাফ ভাইয়ের রাঢ়িখালে- সেই রাঢ়িখাল কেবল হুমায়ুন আজাদের গ্রাম নয়, আমাদের সবার। সব মিলিয়ে ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ হৃদয়ের মণিকোঠায় আজীবন সমুজ্জ্বল থাকার মতোই এক প্রাণময় গ্রন্থ।
ঘরে বসেই বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিঙ্কে: