ক্লাসের প্রথম দিনে কোনো শিক্ষক যদি শিস দিতে দিতে ক্লাসে প্রবেশ করে তাহলে বিষয়টি কেমন হবে? ১৯৫৯ সালের শরতের এক সকালে ভেরমন্টের ওয়েল্টন একাডেমির এক ক্লাসরুমে ঘটে এরকম অদ্ভুত এক ঘটনা। জন কিটিং নামের একজন ইংরেজি শিক্ষকের হাত ধরে উঠে এসেছিল একদল শিক্ষার্থীর জীবনকে নতুনভাবে দেখার গল্প। কিটিং বিশ্বাস করতেন, তরুণদের মাঝে লুকিয়ে আছে আশার প্রদীপ, এবং এরাই পারবে ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে। আর একজন শিক্ষকের উচিত তাদের মধ্যে সেই উদ্দীপনার বীজ বপন করা, যাতে তারা খুঁজে পেতে পারে নিজেকে, এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে নিজের জীবন সম্পর্কে। এমন একটি সুন্দর গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছিল ‘ডেড পয়েটস সোসাইটি’ সিনেমাটি।
প্রতিটি দিন নিজের মতো করে উপভোগ করতে পারাতেই রয়েছে জীবনের সার্থকতা। এজন্যই কিটিং তার ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বলতেন,
Seize the day boys. Make your life extraordinary.
ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক জন কিটিং চরিত্রে অভিনয় করা রবিন উইলিয়ামস তার প্রাণবন্ত অভিনয়ের দ্বারা পুরো সিনেমাজুড়েই আকর্ষণ ধরে রেখেছেন। চরিত্রের প্রয়োজনে কখনো তিনি হয়েছেন তার কোনো ছাত্রের মেন্টর, কখনো বা হয়েছেন পাগলাটে প্রথাভাঙা একজন শিক্ষক যিনি কবিতা খুব ভালবাসতেন। যারা কবিতা খুব একটা পছন্দ করেন না তারাও এই সিনেমাটি দেখলে বুঝতে পারবেন কবিতা কীভাবে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে পারে। রবিনের কথা বললে তার অন্যান্য বিখ্যাত সিনেমা গুড উইল হান্টিং, জুমানজি, মিসেস ডাউটফায়ার, রবিন’স উইশ— এগুলোর কথা বলতেই হয়। এ সকল সিনেমার মতোই ‘ডেড পয়েটস সোসাইটি’তেও কমেডির আড়ালে তিনি তার অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়ে গেছেন।
মুভিটিতে সব কিছুর সাথে থাকে একটি ক্লাবের গল্প। ছাত্রদের মধ্যে যারা কিটিংয়ের কথায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল, তারাই তৈরি করে ‘ডেড পয়েটস সোসাইটি’ নামের ক্লাবটি, যে ক্লাবের সবাই হবে কবিতার অনুসারী, ভালবাসবে পৃথিবীকে এবং নিজেকে, ছুটবে নিজের স্বপ্নের পেছনে। সিনেমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র নীল পেরির কথা না বললেই নয়। রবার্ট লিওনার্দের অভিনয় করা চরিত্রটি ছিল প্রতিভাবান, নেতৃত্বগুণসম্পন্ন একজন মানুষ। অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ থেকে যে তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছিল। সুন্দরের প্রতি, ভালোবাসার প্রতি, কবিতার প্রতি আকর্ষণ তাকে তার নিজের জীবনের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু পারিবারিক চাপে একসময় তাকে হার মানতে হয় জীবনের কাছে। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যখন শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছিল, তখন সে চেয়েছিল নিজের স্বপ্নকে ছোঁয়ার।
Medicine, law & engineering is a noble persuade & necessary to sustain life but poetry, beauty, romance, love these are all we stay alive for.
সিনেমার এই কথাগুলো মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগাবেই মানুষের বেঁচে থাকার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে।
টম স্কালম্যানের সেমি অটোবায়োগ্রাফিকাল স্ক্রিনপ্লে থেকেই সিনেমাটি তৈরি করা হয়। এর গল্প জুড়ে জীবনের প্রতিটি বিষয়কে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রতি গুরুত্ব দর্শকের নজর কাড়বে। সিনেমার একটি দৃশ্যে জন কিটিং তার ছাত্রদের বলেন, টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ক্লাসরুমকে দেখতে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি তেমন কিছু মনে না হলেও এখানে রয়েছে খুব গভীর একটা দৃষ্টিভঙ্গি। নিজেকে অন্যের জায়গা থেকে দেখা, সামনের মানুষকে বুঝতে পারা কিংবা সব দিক বিবেচনা করে কোন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া এই শিক্ষাগুলোই মানুষকে গড়ে তুলতে পারে সুবিবেচক এবং শ্রদ্ধার যোগ্য। সিনেমার এক দৃশ্যে বলা হয়,
Words & ideas can change the world.
যুবকরা জ্ঞানের চর্চা করবে, নতুন কিছু করার চেষ্টা করবে এবং ভাল-মন্দ সব কিছুকেই সহজে গ্রহণ করতে পারবে। পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হলে সবাইকে নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই, শুধু নিজেকে পরিবর্তন করাই বেশি জরুরি।
‘দ্য ট্রুম্যান শো’ এর স্রষ্টা অস্ট্রেলিয়ান ডিরেক্টর পিটার ওয়ের খুব দারুণভাবেই প্রতিটা চরিত্রকে তুলে এনেছেন সিনেমাটিতে। জন কিটিং-এর পাশাপাশি টড এন্ডারসন, নীল পেরি, নক্স ওভারস্ট্রিটের মতো চরিত্রগুলো তাদের প্রত্যেকের জায়গা থেকেই দর্শক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। টড এন্ডারসনের প্রথমদিকে কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট থাকার পরে কিটিংয়ের সহযোগিতায় নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্যগুলো পিটারের সূক্ষ্ম কাজেরই পরিচয় বহন করে।
সিনেমাটি দেখতে দেখতে একসময় বোঝা যাবে, শিক্ষার উদ্দেশ্য আসলে মুক্তমনা মানুষ তৈরি করা। যারা সুন্দরভাবে ভাবতে জানবে, নিজের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে থাকবে সচেতন, হয়ে উঠবে মুক্তমনা। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,
মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম
মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল,
মোরা বিধাতার মত নির্ভয়
মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।।
মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,
বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন
চিত্তমুক্ত শতদল।
কবিতাই পারে খুব সহজে কত জটিল বিষয়কে তুলে আনতে। কবিতাই পারে মানুষের মনে খুব সহজে জায়গা করে নিতে। তাহলে সবাই তো বিশ্বকবি হতে পারবে না কিংবা সবাই তো শেক্সপিয়ারও হবে না। তাহলে কেন সবাইকে সুন্দরের চর্চা, কবিতার চর্চা করা দরকার। এমন চিন্তা মাথাতে আসতেই পারে। এর উত্তরও দেওয়া হয়েছে মুভিটিতে।
“We are not talking artist, we are talking free thinkers.”
শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান আমাদেরকে গড়ে তুলবে স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে, আমরা তবেই তো মাথা তুলে দাঁড়ানো শিখবো। মুভিটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই বিষয়টি খুব ভালোভাবেই দেখানো হয়েছে কীভাবে প্রকৃত জ্ঞানের চর্চা আর নিজেকে জানার মাধ্যমে তরুণরা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। এজন্যই বলা হয়ে থাকে “Know Thyself” মানে “নিজেকে জানো”। নিজের ভাল লাগা, মন্দ লাগা, নিজের শক্তির জায়গা কিংবা দুর্বলতার জায়গা, এমনকি নিজের আবেগ অনুভূতিগুলোও জানা ও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের দেশের পরিবার কিংবা শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতেও এমন পরিবেশই তৈরি করা উচিত, যেখানে তরুণরা শুধু একাডেমিক জ্ঞানই পাবে না তারা সব কিছুর পাশাপাশি নিজেকেও জানবে আর প্রতিটি দিনকেই উপভোগ করবে। কিটিংয়ের মতো সবাই যেন বলতে পারে “Carpe diem”।
সিনেমাতে আরেকটা বড় বিষয় ছিল— প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করে বাঁচা মানে যা ইচ্ছা তা করা অবশ্যই নয়। এমন কিছু অবশ্যই করা উচিত নয়, যা নিজের এবং অন্য মানুষের ক্ষতি বয়ে আনবে। নিজেকে হতে হবে অত্যন্ত ধীর স্থির, কিন্তু সেই সাথে থাকতে হবে আনন্দময়।
অত্যন্ত দর্শকপ্রিয় সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৮.১/১০ এবং ১৯৮৯ সালে রিলিজ হওয়ার পর এটি প্রায় ২৩৫.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ২ ঘণ্টা ৮ মিনিটের সিনেমাটির অ্যাওয়ার্ডের ঝুলিও বেশ ভারি, একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে রাইটিং (১৯৯০), বিএএফটিএ অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফিল্ম (১৯৯০), সিজার অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফরেন ফিল্মসহ (১৯৯১) অনেক সম্মাননা পেয়েছে মুভিটি।
একটি সুন্দর গল্প, প্রতিটি চরিত্রের মাঝে গভীর সমন্বয় আর নতুন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুই যেন সিনেমাটিকে মনের মধ্যে জায়গা করে দিতে প্রস্তুত। মুভিটি দেখলে নিজের অজান্তেই আপনার বলতে ইচ্ছা করবে ছাত্রদের দেয়া জন কিটিংয়ের ডাকনাম,
Oh, Captain! My Captain!