শিভ্যুলেশন (Shevolution)। বেশ অদ্ভুত একটি নাম। রেভ্যুলেশন বা ইভ্যুলেশন এই শব্দগুলো নিয়ে কম-বেশি সবারই জানাশোনা আছে। তবে এই শিভ্যুলেশন শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই খুব সম্ভবত এই প্রথম পরিচিত হচ্ছি। এই শব্দটাকে এককথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয়- যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে নারীদের প্রতিবাদী হয়ে উঠার আন্দোলনের নামই হচ্ছে মূলত শিভ্যুলেশন। কিন্তু এই শব্দটা এলো কোথা থেকে? আর কীভাবেই বা এই শব্দের প্রচলন? অথবা এই শব্দের মাধ্যমে যে আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে, সেটাই বা কেমন আন্দোলন? কিংবা এই আন্দোলন কতটুকুইবা সফলতার মুখ দেখেছে? এই সব প্রশ্নের উত্তরগুলো নিয়েই আজকের আলোচনা।
ইদানীং পত্রিকার খবর থেকে শুরু করে টেলিভিশন কিংবা অনলাইন পত্রিকা অথবা সামাজিক মাধ্যমগুলোতে যে হারে ধর্ষণ এবং নারীদের প্রতি যৌন হয়রানির কথা শোনা যাচ্ছে, তা বিগত সব বছরের তুলনায় অনেক বেশি। নিত্যদিনের ঘটনায় যেন পরিণত হয়েছে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে এমনকি কর্মক্ষেত্র কিংবা পরিবারেও এমন অহরহ ঘটনার কথা আমরা শুনে থাকি কিংবা শুনতে পাই।
আপনি জানেন কি, বাংলাদেশে শুধুমাত্র গত ছয় মাসে ৫৯২টি ধর্ষণের খবর প্রকাশ এবং প্রচারিত হয়েছে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনের খবরে? অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ নামে একটি এনজিও সংস্থা গত বছর একটি গবেষণা চালায়, যার শিরোনাম ছিল ‘Safe cities for women’। সর্বশেষ প্রকাশিত ফলাফলে জানা যায়, বাংলাদেশে শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন। এদের মধ্যে গণপরিবহনের চালক এবং হেল্পারদের দ্বারা শতকরা ৮৬ জন নারী যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার।
এছাড়াও, এনজিও সংস্থা ব্র্যাক গণপরিবহনে যৌন হয়রানি নিয়ে আরেকটি গবেষণা চালায় ২০১৮ সালে, যেটির ফলাফলে জানানো হয়, শতকরা ৯৪ ভাগ নারী গণপরিবহনে যাতায়াতকালে যৌন হয়রানির শিকার হন; হোক তা মানসিক, কিংবা শারীরিকভাবে। এই যৌন হয়রানির জন্য দায়ী যারা, তাদের মধ্যে বেশিরভাগের গড় বয়স হচ্ছে ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষেরা। এই গবেষণায় আরো জানানো হয়, ঘটনার শিকারে নারীরা কী পদক্ষেপ নেন? এই প্রশ্নের উত্তরে শতকরা ৮১ জন নারীই জানান যে, তারা এই বিষয়ে চুপ থাকেন বা আড়াল করে যান এবং শতকরা ৭৯ জন নারী জানান, তারা ঘটনার স্থান থেকে দ্রুত সরে যান নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা গণপরিবহনে ধর্ষণসহ নানান ধরণের যৌন হয়রানির কথা প্রত্যহ শুনি অথবা জানি। যদি যৌন নির্যাতনের শব্দটাকে বাদ দিয়ে চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে ঘরের বাইরে নারী প্রধানত চলাচলের পথে তথা পরিবহনেই সবচাইতে বেশী যৌন হয়রানির শিকার। দিনকে দিন এটা বাড়ছে কিন্তু কোন প্রতিকার হচ্ছে না। পথে ট্রাফিক পুলিশ কিংবা পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ করলে তারাও ততটা আমলে নিতে চান না বিষয়টাকে। এমনকি মাঝে মাঝে অভিযোগ করতে যেয়ে উলটো খারাপ মন্তব্য শুনে আসতে হয়েছে অনেককেই। যথাসম্ভব এর প্রতিকার আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
-কাশফিয়া ফিরোজ, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ইকুয়িটি ম্যানেজার।
চলচ্চিত্র কিন্তু শুধুমাত্র বিনোদনের কোন মাধ্যম নয় সে কথা নানা হাস্যকর কসরতে সমাজের অন্ধকার দিকগুলোকে তুলে ধরে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন চার্লি চ্যাপলিন। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটা গোটা সমাজের পরিবর্তন হতে পারে, সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা বদলে ফেলা সম্ভব, অথবা মানুষের মাঝে নতুন দিনের আলো দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে তোলা সম্ভব।
সেই ধরণের একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির প্রচেষ্টায় হোক কিংবা নিজস্ব সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই হোক গতবছর ২৫ মার্চ গুণী নির্মাতা আফজাল হোসেন মুন্না তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে বাংলাদেশের নির্মাতাদের প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। যেই চ্যালেঞ্জের মূল কথা ছিল, সেদিন থেকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ এক মাসের সময়সীমার মধ্যে নির্মাতাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা কিংবা প্রত্যহ ঘটে যাওয়া নারীদের উপর যৌন হয়রানির গল্পগুলো যেন দর্শকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হয়।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী সারা পাওয়া মিটু কিংবা টাইমস আপ অথবা রাইস বাকেট চ্যালেঞ্জ এর ন্যায় এই চ্যালেঞ্জটির নামকরণ করা হয় হ্যাশট্যাগ #আই স্ট্যান্ড ফর উইমেন #istandforwomen। সিনেমা হোক বিপ্লবের হাতিয়ার -এই স্লোগান নিয়েই আন্দোলনটি ফেসবুক থেকে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে তা পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশনসহ সকল গণমাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই ৮ জন নির্মাতা এগিয়ে আসেন এবং নারীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনকার গল্পগুলো নিয়ে তৈরী করেন ৮টি ছোট দৈর্ঘ্যর চলচ্চিত্র কিংবা শর্ট ফিল্ম। জাতীয় গ্রন্থাগারের মিলনায়তনে গত পাঁচ মাস আগে আই স্ট্যান্ড ফর উইমেন এর প্রিমিয়ার শো করা হয়েছিল।
মূলত সেই প্রদর্শনীতে একইসাথে ৮টি শর্ট ফিল্মের প্রিমিয়ার করা হয়। প্রদর্শনী শেষে মিলনায়তনে উপস্থিত সকল দর্শকের ভালোবাসায় এবং প্রশংসায় সিক্ত হন শর্ট ফিল্মগুলোর অভিনেতা, অভিনেত্রী, নির্মাতা এবং কলা-কুশলীসহ সকলেই।
পরবর্তীতে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম বায়োস্কোপ অরিজিনাল এই শর্ট ফিল্মগুলোর মধ্যে চারটি শর্ট ফিল্ম বাছাই করে শিভ্যুলেশন নামকরণে একটি সম্মিলিত ওয়েব ফিল্ম বের করে যাতে শর্ট ফিল্মগুলো সর্বস্তরের মানুষজনদের কাছে পৌঁছাতে পারে। মুক্তি পাওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই শিভ্যুলেশন ওয়েব ফিল্মটি বায়োস্কোপের নিজস্ব রেটিং এ দুই নাম্বার জায়গা দখল করে ফেলেছে। বর্তমানে এটির রেটিং আছে ৩.৬। এছাড়াও, ইতিমধ্যেই এটি মোস্ট পপুলার ক্যাটাগরির তিন নাম্বারে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে।
এই শিভ্যুলেশনে আছে আশিকুর রহমান নির্মিত অসম্ভাবিত, প্রতীক সরকার নির্মিত বন্দিনী, সাকি ফারজানা নির্মিত দ্য পার্ক দ্য বেঞ্চ অ্যান্ড দ্য গার্ল এবং আফজাল হোসেন মুন্না নির্মিত দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য গার্ল নামক শর্ট ফিল্মগুলো। শর্ট ফিল্মগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপের আগে জানিয়ে রাখছি যে, গ্রামীণফোন নাম্বার দিয়ে বায়োস্কোপে লগইন করে নির্ধারিত প্যাকেজের মূল্য (খুবই সীমিত) পরিশোধ বাবদ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শর্ট ফিল্মগুলো দেখতে পারবেন।
অসম্ভাবিত
রাতের শহর। বাস ছুটছে সবার গন্তব্যকে উদ্দেশ্য করে। আমরা আমাদের প্রধাণ চরিত্রকে দেখি, কানে হেডফোন গুঁজে মেয়েটা বাসের সবার শেষের সিটের মাঝখানটাতে বসে আছে। বাসে থাকা শেষ পুরুষটাও নেমে যায় নিজের গন্তব্যে, বাকি থাকে শুধু মেয়েটা। ড্রাইভার গাড়ি চালানোর ফাঁকে ইশারা দেয় হেল্পারকে। কিচ্ছুক্ষণ পর শহরের রাস্তা ফেলে বাসটা নেমে আসে নির্জন এক পথে, মেয়েটা ভয় পেলেও কেমন নির্বিকার বসে থাকে সিটটাতেই। বাসটা আচমকা থামে জনমানবশূন্য আর শহরের রাস্তা পেড়িয়ে আসা একটা জায়গাতে। ড্রাইভার নিচে নেমে আসে বাথরুম চাপার দোহাই দিয়ে তবে এক মুহুর্তের বেশী সময় নেয় না আবার বাসে উঠে দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিতে। মেয়েটা তবুও নির্বিকার শুধু ডান হাতটা নিজের কাঁধে ঝোলান ব্যাগটার ভেতরে রাখা। ড্রাইভার এসে মেয়েটার উপর ঝাপিয়ে পরা মাত্রই মেয়েটা ব্যাগে থাকা হাতটা বের করে আর ড্রাইভার আঁতকে উঠে পেছনে চলে আসে।
গল্পের শেষটা যদিও পরিচালক দৃশ্যায়ন করেছেন কিন্তু তারচেয়ে বরং চলুন আপনি আমি একটু ভেবে দেখি ব্যাপারটা কি হতে পারে? আচ্ছা এমনটা তো শুনে থাকবেন অবশ্যই যে গল্পটাকে কেন্দ্র করে কোন সিনেমা নির্মান করা হয় সেটা পুরোপুরি না হলেও আংশিক সত্যি! আর এই গল্পটা আংশিক নয় পুরোপুরিই সত্যিই। সংবাদপত্র বা অনলাইন পত্রিকায় প্রতিদিন না হলেও প্রায় প্রায়ই এই ধরণের খবর পড়ে আমরা নীরবে কান্না করি আর প্রার্থণায় কেবল নিজের পরিবার আর নিজের আত্মীয়স্বজনের নিরাপত্তাই কামনা করি। কিন্তু, ভেবে দেখুন তো বাসের সিটে বসা ঐ মেয়েটা আপনার বোন বা আপনার অতি আপনজন। জানি এই ধরণের ভাবনাটা আমাদের পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়।
নির্জনে একা একটা মেয়েকে পেলেই এই ধরণের পুরুষেরা ধর্ষণ করে নিজের বীরত্বটাকে প্রকাশ করতে চায় কিন্তু আসলে তারা তাদের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দেয়। আর ঠিক ঐ পুরুষটার জীবনটাকে যদি আমরা গভীরভাবে দেখতে চাই, তাহলে দেখবো হয়তো ঐ পুরুষটারও একটা আদরের ছোটবোন আছে। কিংবা ভালোবাসার একজন প্রিয় মানুষ আছে। অথবা নিজের সহধর্মিনী আছে। আর এসব কিছুই যদি না থাকে অন্তত একজন মা তো আছেই। জ্বি, কথাটা খুব তেঁতো মনে হলেও এটাই কঠিন আর চরম বাস্তব কথা। ঠিক এই ভাবনাটাই দর্শকদের ভাবাতে বাধ্য করেছেন পরিচালক আশিকুর রহমান তার নির্দেশিত অসম্ভাবিত শর্ট ফিল্মটাতে।
শর্ট ফিল্মটির প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন শতাব্দী ওয়াদুদ এবং মৌসুমি হামিদ। শতাব্দী ওয়াদুদের অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। কেননা এই অভিনেতা যেই চরিত্রই হোক না কেন সেটাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে নেন; যাতে করে সেই চরিত্রটাকে খুব ভালোভাবে খুঁজে পাওয়া গেলেও অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। মৌসুমি হামিদের অভিনয় আগে যতবার দেখেছি মোটামুটি লেগেছে কিন্তু এই শর্ট ফিল্মে অনেক ভালো লেগেছে। তার কারণ হচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে নির্যাতনের শিকার কেউ যদি প্রতিবাদ করে উঠে তাতে তার চোখেমুখেও প্রতিবাদটা ফুটে ওঠে। মৌসুমি হামিদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে; আর একদমই ভিন্ন তিনটা চরিত্রে দুজনই নিজেদেরকে খুব ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছেন।
গল্পটা একদমই সাধারণ হলেও ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য পরিচালক আশিকুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা। গল্প, চিত্রনাট্য, চিত্রগ্রহণ বা আলোকচিত্র যাইই বলিনা কেন মোটামুটি ভালোই মনে হয়েছে। তবে একটা দৃশ্যের কথা বর্ণনা না করলেই নয় আর সেটা হচ্ছে গল্পে মৌসুমি হামিদ যখন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তখন একটা দৃশ্যে দেখা যায় মৌসুমি হামিদের চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। এই দৃশ্যটা আমাকে রূপকথার গল্প মনে করিয়ে দিয়েছে যেখানে দেব-দেবীরা মানুষের অনিষ্টকারীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে ধরণীতে নেমে আসে। তবে চরিত্রের মাধ্যমে গল্পে প্রবেশ কিংবা গল্পে চরিত্রের স্থায়ী আবেশ এই ব্যাপারটা খানিকটা অসংগতিপূর্ণ মনে হয়েছে। আর তাছাড়া তৃতীয় চরিত্রের কোন অভিব্যক্তি পর্যন্ত ছিল না ব্যাপারটা কেমন অগাছালো মনে হয়েছে আমার কাছে। তারপরও, সবদিক বিচার-বিবেচনা করলে শর্ট ফিল্মটা উপযুক্তই মনে হয়েছে।
বন্দিনী
ব্যস্ত নগরীটা ভোর হতেই জেগে উঠেছে। শহরটা আর শহরের মানুষগুলো একইসাথে ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যেতে নিজেকে তৈরি করে নেয়। সেই অগণিত লক্ষ কোটি শহুরে মানুষের ভিড়ে আমরা আমাদের প্রধান চরিত্রকে দেখি ঘুম থেকে জেগে উঠতে। একদিকে পুরুষটা অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে আর অন্যদিকে নারীটা রান্নাঘর সামলাতেই ব্যস্ত। খাবার টেবিলে বসে দুদণ্ড কথা বলার সময় হয় না পুরুষটার, অফিসের ফোনে অর্ধেক নাস্তার সন্তুষ্টি নিয়ে বের হয়ে যায় সে; আর নারীটা অসন্তুষ্টি, বিষণ্ণতা আর একাকীত্বকে ঘরের ভেতরে নিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগায়। নারীটার হাতে সারাটাদিন পড়ে আছে অথচ কথা বলার কোন মানুষ নেই; কষ্ট করে পড়ালেখা করে এত সার্টিফিকেট অর্জন করেছে অথচ ওগুলো এখন মূল্যহীন; পরিচিত সব বন্ধু-বান্ধব যখন নিজেদের পরিবার-পরিজন নিয়ে ব্যস্ত নারীটা তখন ছাদে আকাশের সাথে শখ্যতা স্থাপনে মত্ত। সময় গড়ায়, দিন বদলায়, বয়স বাড়ে ঠিক তেমনি নারীটার একাকীত্বটা সময়ের বিবর্তনে নারীটাকে অলিখিত, অঘোষিত অথচ নিশ্চিত বন্দি রূপে গড়ে তোলে।
উপরোক্ত গল্পটা কেবল সিনেমার পর্দাতেই নয় বরংচ আমরা আমাদের পরিবারের দিকে তাকালেই দেখতে পাই। যুগ যুগ ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। নারী মানেই সংসারের হাল ধরা আর পুরুষ মানেই ধরণীর বুকে অবাদে বিচরণ করা- এই ধরণের কথা প্রাচীন যুগ হতেই প্রচলিত হয়ে আসছে। আবার, প্রাচীন যুগে নারীদের দাসী রূপে রাখার জন্য লোহার বেড়ি পড়ানো হতো পরবর্তীতে যেটা সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ঠিক এইভাবেই ধরণীতে যুগের পর যুগ নারীরা বন্দি জীবন কাটাচ্ছে। কর্পোরেট যুগ যদিও নারীদের স্বাধীনতা দিয়েছে সর্বক্ষেত্রে তবুও নারীরা কি স্বাধীন! নাকি কেবল স্বাধীনতার লেবাসধারী আদতে নারীরা পরাধীন! এই বিস্তর আলোচনায় না যেয়ে বরংচ আমরা ফিরে আসি প্রতীক সরকার নির্মিত বন্দিনী নামক শর্ট ফিল্মের গল্পে।
খুবই সাদামাটা একটা জীবনের গল্প এটা। এমনকি আমাদের নিত্যদিনের চেনা গল্প। এই ধরণের গল্পগুলোতে নায়ক থাকে না, কোন আবেগ থাকে না, কোন ভালোবাসা কিংবা মমতা থাকে না, থাকে কেবল একজন বন্দিনী আর এক মহাকাশ সমান শূণ্যতা, একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা। সেই একাকীত্বকে আগলে ধরে বেঁচে থাকে নারী নিজের অনাগত ভবিষ্যতের জন্যে, কিংবা প্রথার চলটাকে সচল রাখতে, অথবা সমাজে বসবাস করার স্বার্থে। সে যে কারণেই হোক না কেন এজন্যই হয়তো বলা হয়ে থাকে, নিজের স্বপ্নকে নিজের হাতে গলা টিপে হত্যা করে অন্যের স্বপ্নে বেঁচে থাকার নামই নারীত্ব।
একদমই সাদামাটা গল্প হলেও গল্পের গভীরতাটা ব্যাপক ছিল। তবে পরিচালক দৃশ্যায়নে কতটা গভীরতা ছাপ ফুটিয়ে তুলেছেন সেইটাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। সে নিয়ে আলোচনার আগে অভিনয় নিয়ে আলাপ করে নেই। এই গল্পের প্রধান এবং বলতে গেলে একমাত্র চরিত্রে অভিনয় করেছেন শারমিন আঁখি। আরো চার বছর আগে মিডিয়া সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করার কারণে আর ইদানীংকালে নাটকের প্রতি অরুচির কারণে অনেক অভিনয় শিল্পীদের সম্পর্কেই আমার এখন আর কোন ধারণাই নেই। মোটামুটি ভালোই অভিনয় করেছেন শারমিন আঁখি তবে পরিচালক চাইলে অনুভূতি কিংবা টাইমল্যাপসের জায়গাগুলোতে অভিব্যক্তির আরো ভালো সদ্ব্যবহার করাতে পারতেন।
তাতে হয়তো গল্পের গভীরতাটাও খানিকটা বৃদ্ধি পেত আর গল্পটাও আরো খানিকটা মজবুত হতো। আমার কাছে মনে হয়েছে বাকি তিনজন পরিচালকের তুলনায় এই পরিচালকের আরো খানিকটা পরিণত হওয়া বাকি। যদিও কিছু দৃশ্যায়ন দেখে মনে হয়েছে যে তিনি পরিণত হওয়ার পর্যায়েই আছেন এবং সুযোগ পেলে সামনে আরো বেশ ভালো কাজ উপহার দিতে পারবেন। এই প্রসঙ্গে গল্পের ছাদের দৃশ্যগুলোর কথা বলতে পারি যেই দৃশ্যগুলো চিরচেনা মনে হলেও পরিচালকের দৃশ্যায়নে এক ধরনের সূক্ষ্ম নিজস্বতা টের পেয়েছি অথবা শুরুর দিকে ঘরে মানুষের বেশে ক্যামেরার অনুপ্রবেশের দৃশ্যায়নের কথা বললে আশাটা বদ্ধমূল করতেই পারি যে এই পরিচালক ভবিষ্যতে খুব ভালো কিছুই উপহার দিবেন। গল্প, চিত্রনাট্যসহ সর্বদিক বিবেচনা করে বললে বলবো ভালোই হয়েছে তবে আরো ভালো করা যেত কিংবা ভবিষ্যতে এর চাইতে আরো অনেক ভালো নির্দেশনা পাব এই পরিচালকের কাছ থেকে।
দ্য পার্ক দ্য বেঞ্চ এন্ড দ্য গার্ল
একটি দিনের শুরু। সবুজে সাজানো একটা পার্কের ভেতরে পাখির কলতানের সুরে নগরের ঘুম ভাঙ্গে। সবুজে আবৃত সেই সুন্দর পার্কে এক নারীকে বসতে দেখি পার্কেরই কোন এক বেঞ্চিতে। বেঞ্চির হেলান দেয়ার জায়গাতে দেখি অসংখ্য অশ্রাব্য আর অকথ্য ভাষায় লেখা দেয়ালিকা। জিন্স আর টপস পরিহিতা নারী বেঞ্চিতে বসে কারোর অপেক্ষায় কাঁধ ব্যাগে থাকা একটা বই বের করে পড়তে বসে। পাওলো কোহেলহো’র লেখা দ্য স্পাই বইটার শুরুই হয় একটা বাক্য দিয়ে যা আমাদের গল্পের শুরুর ধাক্কাটাকে আরো প্রকটরূপে তুলে ধরে।
Her only crime was to be an Independent Women (অর্থাৎ তার একমাত্র অপরাধ ছিল এটাই যে তিনি একজন স্বাধীনচেতা নারী।)
আমাদের গল্পের প্রধান চরিত্র যখন কোহেলহো’র মাতা হারি’র মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাবার প্রবল আগ্রহে মত্ত তখন পার্কেই আসা একজন কর্পোরেট পুরুষকে দেখি আমরা যে এসে ঐ একই বেঞ্চিতে বসে। বসেই পুরুষত্বের অন্যতম নিদর্শন স্বরূপ সিগারেট ধরায় আর ধোঁয়াটা ছাড়ে আমাদের এ যুগের মাতা হারি’র দিকে। পুরুষটার কামাতুর চোখ ঢেকে আছে রৌদ্র চশমায় আর কামাতুর মনটাকে আড়াল করে রেখেছে সভ্য জাতির তৈরি পোশাক।
কিন্তু আমরা সেই পুরুষটার কামাতুর ভাবনার প্রতিফলন দেখি গ্রাফিক্সের সহায়তায় টেক্সটের রূপে। বারকয়েক সিগারেটের ধোঁয়ায় ত্যক্ত হয়ে নারীটা নিজের কাঁধ ব্যাগে হাত রাখে। পুরুষটা উঠে চলে যায় কিন্তু সেকেন্ডের কাটা ঘড়িতে ঘুরতেই আমরা আরেকজন পুরুষকে দেখি, যার বেশভূষায় মনে হয় আদতে সে একজন খেটে-খাওয়া মানুষদের কাতারে। এই খেটে-খাওয়া মানুষের আগের কর্পোরেট পুরুষের মতো এত সাহস না থাকলেও হস্তমৈথুনে এই পুরুষ বেশ পারদর্শী তাই দিনের একমাত্র খাবারের কথা ভুলে চিন্তা করে আমাদের মাতা হারি’র শরীর ভোগের কথা।
খেটে খাওয়া পুরুষটা চলে গেলে আমাদের নারী চরিত্রটি এবার বইটা রেখে প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত হয়। এবার বেঞ্চির কাছে আসে একজন নতুন প্রজন্মের যুবক। কানে হেডফোন, টি-শার্টের উপর শার্ট পরা তরুণটি বেঞ্চিতে বসেই গানের তালে তালে অদৃশ্য উপায়ে নারীটার শরীর উপভোগের কথা চিন্তা করে খুশীতে আটখানা হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের নারী চরিত্রটি আবারো তাঁর কাঁধ ব্যাগে হাত রাখলে উঠে বিরবির করতে করতে চলে যায় তরুণ। তরুণটি চলে গেলে মোবাইল ফোনটা হাতে নেয় নারী চরিত্রটি। এবার দৃশ্যপটে আসেন হালের একজন কবি। যার কাব্যিক মানসিকতায় ফুটে উঠতে শুরু করে অশ্লীলতা আর নোংরা বাক্যের একেকটা কবিতা। নারী চরিত্রটি মোবাইলে কারো সাথে কথা বলতে শুরু করলে উঠে চলে যায় কবিও।
এবার দৃশ্যায়নে কে আসবে তাই কি ভাবছেন? এবার দৃশ্যায়নে আছি আপনি আর আমি। মানে হচ্ছে আমরা যারা দর্শক যারা সবকিছুই দেখি, সবকিছুই বুঝি, সবকিছুই শুনি তবুও দর্শক সেজে শুধু সত্যই গোপন করি না বরংচ প্রতিটা মুহুর্ত উপভোগ করি। আজকের দিনে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে যে হারে প্রশ্ন উঠছে তাতে করে মাঝে মাঝে ভয়ই হয় আজ হতে এক যুগ পরে নারীদের অবস্থান কতটা নিরাপত্তাজনক হবে তা নিয়ে। আমার মনে হয় ঠিক এইরকমই একটা চিন্তাভাবনা থেকে পরিচালক সাকি ফারজানা নির্মান করেছেন দ্য পার্ক দ্য বেঞ্চ এন্ড দ্য গার্ল নামক এই শর্ট ফিল্মটি।
শর্ট ফিল্মের অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে সবাইই নিজের অবস্থান থেকে ভালো অভিনয়টা দেখালেও চোখে লেগে আছে প্রধাণ নারী চরিত্রটির অভিনয় যার নাম হচ্ছে জয়িতা। বিক্ষিপ্ত আর প্রতিবাদী মনোভাব এবং স্বাধীনচেতা নারীর একদম নিখুঁত প্রতিফলন ঘটেছে জয়িতার অভিব্যক্তিতে। বিশেষ করে পার্কের বেঞ্চিতে বসা জয়িতার চাইতে প্রতিবাদী জয়িতার রূপটা আকর্ষন করেছে বেশীই কেননা প্রতিবাদী জয়িতার চোখেমুখে আর অভিব্যক্তিতে এক ধরণের আক্রোশ লক্ষ্য করা গেছে। তবে জয়িতার অভিনয় দেখেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম ইনি খুব সম্ভবত থিয়েটারের হবেন।
চিত্রনাট্য আর চিত্রায়ন দুইটাই ভালো লেগেছ। বিশেষ করে কিছু দৃশ্য চোখে লেগে আছে তার মধ্যে হস্তমৈথুনের দৃশ্যের অস্বাভাবিকতা এবং দর্শককে প্রশ্নবিদ্ধ করা এই দুটি অন্যতম। যেহেতু পরিচালক নিজেই একজন নারী তাই নির্দেশনাতে নারীর প্রতিবাদী এবং কতিপয় পুরুষদের কাপরুষতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে জয়িতা যখন দর্শককে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেন এবং একের পর এক অস্ত্রগুলো দেখাতে থাকেন সেখানে কেন জানি আমি গভীরতাটা ঠিকভাবে পাইনি। এছাড়া, সবদিক বিবেচনা করে বলবো বেশ ভালো একটা কাজ হয়েছে।
দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য গার্ল
রাতের নিস্তব্ধ শহর। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমরা এক নারী চরিত্রকে দেখি, যে কিনা ঘরে ফেরার অপেক্ষায় এবং নিস্তব্ধতার আতংকে আতংকিত। একটা গাড়িতে দু’টি ছেলে এসে সাহায্যের কথা বলে, কিন্তু মেয়েটা নিষেধ করে। গাড়িটা চলে গেলেও খানিক বাদে ফিরে এসে জোরপূর্বক মেয়েটাকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। চলন্ত গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে মেয়েটার চিৎকার শোনা যায়, গাড়ির গ্লাসগুলো লাগানো সত্ত্বেও মেয়েটার বাঁচার আকুতি শহরের পথে পথে সাহায্যের হাত বাড়ায়; কিন্তু শহরটা কেবল ঐ ল্যাম্পপোস্টটার মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, যার কেবল দেখার আর শোনার শক্তি আছে কিছু করার শক্তিটা নেই।
রাত পেরিয়ে ভোর হয় বিস্মৃতির অতলে চলে যায় ল্যাম্পপোস্টের ঘটনাটা। স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমরা আরেকজন নারীকে দেখি, যে কিনা খুব সম্ভবত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। যার বাসা থেকে বের হয়ে চিপাচাপা আর অলিগলি পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে আসতে হয়। প্রতিদিনকার মতো মেয়েটা বের হয় বাসা থেকে, চিপাচাপা আর অলিগলি পেরিয়ে মেয়েটা নিজের গন্তব্যে এগিয়ে চলে। বাসা থেকে খানিকদূর আসার পর থেকেই অপরিচিত এক বুড়ো লোক মেয়েটার পিছু নেয়। মেয়েটা টের পায় এবং দ্রুত রিক্সায় উঠে সাময়িকভাবে পালায়। বুড়ো লোকটার পিছু নেয়াটা নিয়মিত হয়ে উঠলে মেয়েটা এক সন্ধ্যায় সাহায্য চায় এলাকার কিছু ছেলেদের কাছে। ছেলেগুলা উল্টো মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যেতে চাইলে ঐ বুড়ো লোকটাই এসে বাঁচায়।
অনেকদিন আগে ফেসবুকে একটা খবর পড়েছিলাম এক বৃদ্ধ লোক কোন একটা ঘটনার প্রতিবাদ স্বরূপ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান এবং প্রতিবাদে উৎসাহিত করেন নগরবাসীকে। সঠিক ঘটনাটা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না তবে এই গল্পের বুড়োর সাথে সেই গল্পটার একটা তাত্ত্বিক মিল পেয়েছি। আরেকটা কথা হচ্ছে এই শর্ট ফিল্মটার নাম শুনে অনেকেরই আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এর বিখ্যাত গল্প দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি এর কথা মনে পড়তে পারে কেননা নাম দুটো একই ধারার। যদিও গল্পের প্রাসঙ্গিকতায় কোন মিলই নেই তবে মনঃস্তাস্ত্বিক একটা ব্যাপার খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করা গেছে আফজাল হোসেন মুন্না নির্মিত দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য গার্ল নামক শর্ট ফিল্মটিতে।
শর্ট ফিল্মটির নাম চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং আমিনুল ইসলাম খান আবু। এই দুইজনের অভিনয় নিয়ে নতুন করে খুব ভালো বলার দরকার পড়ে না। তিশার সবচাইতে ভালো দিকটা হচ্ছে নিজেকে রূপ দেয়ার বা চরিত্রের সাথে খাপ খাওয়াতে দারুণ পারদর্শী তিনি। তাই যে কোন চরিত্রে ঢুকে যেতে ন্যূনত্ব সময় লাগে না আর একবার চরিত্রে ঢুকে গেলে নুশরাত ইমরোজ তিশাকেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
আবু ভায়ের অভিনয় ভালো লেগেছে কারণ উনার চেহারার অভিব্যক্তিতে শর্ট ফিল্ম শেষ হওয়ার আগ অবধি বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় ছিল না চরিত্রটা ঠিক কি কারণে পরিচালক দেখাচ্ছেন। এছাড়া আরো বেশ কয়েকজন অভিনয় করেছেন বিভিন্ন দৃশ্যে; এদের মধ্যে বলতে গেলে শেষের দৃশ্যের বিশালের কথা বলা যায়। চরিত্র এবং সময় অনুযায়ী দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তবে আফরাজ হোসেনের অভিনয় নিয়ে না বললেই নয় কেননা পুরো শর্ট ফিল্মের ইনার একটাই দৃশ্য যেটা তিনি অতি উৎসাহে লাফাতে লাফাতে সম্পন্ন করেছেন তাও পরিচালক মানে আফজাল হোসেন মুন্নারই সাথে।
আফজাল হোসেন মুন্নার সাথে সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলাম ৩/৪ বছরের মতো সে সুবাদে উনার কাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে। একটা কাজ যতক্ষণ পর্যন্ত মনোঃপুত হবে না ততক্ষণ অবধি তিনি নিতেই থাকবেন সেটা যত ঝামেলাই হোক না কেন; আবার মাঝে মাঝে দেখেছি পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও নিজেই ক্যামেরা হাতে নেমে যেতে। যাই হোক, এই শর্ট ফিল্মের কিছু দৃশ্যায়ন ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব ভালো লেগেছে যেগুলোর মধ্যে শুরুর দিকে মহল্লার টাইমল্যাপস যেখানে ক্যামেরা একজনের পেছন পেছন চলতে চলতে হঠাৎ করে বিপরীত দিক থেকে আসা কারোর পিছনে ছুটতে শুরু করে।
আরেকটা দৃশ্যের কথা বলবো সেটা হচ্ছে শেষের দৃশ্যের যেটা মূলত শর্ট ফিল্মের পোস্টারেই দেখা যায়। এখানে অতিমানবীয় বিশেষ কিছু ফুটিয়ে তুলতে পরিচালক গ্রাফিক্সের ভরসা না করে ক্যামেরার কারসাজিতে আস্থা স্থাপন করেছেন এবং সেটা করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। অতিমানবীয় ব্যাপারটা কেবল কল্পনাপ্রসূত কিন্তু বাস্তবে যারা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে প্রতিবাদ করে তারাই কিন্তু অতিমানব। এই ব্যাপারটাকে বুঝানোর জন্যেই হয়তো শুধুমাত্র ক্যামেরার কারসাজিতে ভরসা করেছেন পরিচালক। গল্প, চিত্রনাট্য, চরিত্রায়ন এবং দৃশ্যায়ন সবকিছু মিলিয়েই পরিপূর্ণ মনে হয়েছে।
যেহেতু আগেই স্বীকার করেছি যে উনার সাথে আমি কাজ করেছি তাই অনেকেই ইতিমধ্যেই ধরেই নিয়েছেন যে আমার পক্ষে উনার অসংগতি তুলে ধরা সম্ভব নয় কিন্তু আসেন কথাটা ভুল প্রমাণ করি। প্রথম কথা হচ্ছে যতবার মুন্না ভায়ের কাজ দেখেছি বা এখনো দেখি ততবারই কেন জানি মনে হয় দারুণ হয়েছে কিন্তু আপনি চাইলে আরো দুর্দান্ত করতে পারতেন- অনেকটা এইরকমই একটা অনুভূতি কাজ করে। দ্বিতীয়ত, গল্পের থ্রিল এবং মোড় ঘুরানো ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলেও কেন জানি গল্পের গভীরতা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত চরিত্রের অনুপ্রবেশ ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, প্রতিবাদের দৃশ্যে যেহেতু দেবীর আবির্ভাব বুঝানো হয়েছিল যেখানে দেবীর আর্শীবাদে নির্যাতিত আরেক নারীও হয়ে উঠেন প্রতিবাদী সেখানে সময় স্বল্পতা ভালো লাগেনি। কেননা এখানে পুরুষটার চাইতে নারী তথা প্রতিবাদী নারীর দিকে ক্যামেরা রেখে গল্পের শেষ টানাটা প্রসঙ্গত মনে হয়েছে যদিও পুরুষটার পরে থাকার পরে সমাজের নেপথ্যের কথাগুলিও জরুরী তবুও। ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রত্যাশা আরো বেশী ছিল আশা করি পূর্ণদৈর্ঘ্য কিছু বানালে আমার সে আক্ষেপ পূরণ করবেন পরিচালক।
সবক’টা শর্ট ফিল্মেই আছে নারীদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা, সমাজের একদম উচ্চস্তর থেকে একদম নিম্নস্তর অবধি প্রত্যেকটি নারীর প্রতিদিনকার জীবন সংগ্রামের কথা, এমনকি প্রতিবাদী নারীদের কথাগুলো উঠে এসেছে। শর্ট ফিল্মের সাথে জড়িত সকল কলাকুশলীদের বিশ্বাস এই শর্ট ফিল্মগুলোর অন্তর্গত বার্তাগুলো খানিকটা হলেও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করবে। এবং পরিচালক নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন যে, এই আন্দোলন এখানেই থেমে থাকবে না; এটাকে আরো বেশি ছড়িয়ে দিতে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু হবে খুব শীঘ্রই, যেখানে পুরাতনদের পাশাপাশি নতুনদের কাজ করারও প্রচুর সুযোগ থাকছে। আজকের লেখাটি শেষ করছি আন্দোলনের উদ্ভাবক নির্মাতা আফজাল হোসেন মুন্নার কথা দিয়ে,
আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু ঘরে-বাইরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে যেখানেই বলেন না কেন নারীরা সর্বক্ষেত্রেই হচ্ছে অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং সহিংসতার শিকার। তা সত্ত্বেও নারী নির্যাতন এবং সহিংসতার বেশিরভাগ খবরই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে, আর যতটুকু খবর প্রকাশ্যে ছাপা হয় তাতেও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আর সবচাইতে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এই বিষয়টা নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা উঠলেও কেবলমাত্র এই বিষয়টাতেই তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বাংলাদেশে। মূলত সেই ভাবনার দিকটা থেকেই চিন্তা এলো যে, আমরা যারা সিনেমা নির্মাণ করি, তারা লাইট-ক্যামেরা দিয়ে নিজেদের জায়গা থেকে নারীদের প্রতি সহিংসতার কিংবা সহিংসতার বিরোধিতার গল্পগুলোকে তো দর্শকদের জন্য তুলে ধরতে পারি। আর ঠিক এরপর পরই চিন্তাটা কাজ করলো যে বিশ্বব্যাপী ট্রেন্ডের মতো আমাদের এই আন্দোলনটাও ছড়িয়ে যাক। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই মূলত ‘আই স্ট্যান্ড ফর উইমেন’।