একজন আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারণ করছেন একেকটা বাক্য। ছোট্ট একটা স্থানে তোলে ধরছেন বড় পরিসরের কোনো ঘটনা। কিংবা কখনও এসকল সংলাপ হয়ে ওঠছে গভীর কোনো ইঙ্গিত, ওঠে আসছে গূঢ় বাস্তবতা। এর নামই নাটক। বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে, বিভিন্ন দৃশ্যে দেখানো হয় কোনো একটি বিশেষ ব্যাপারকে।
তবে সেগুলোর মধ্যে থাকতে পারে ভাগ। সাধারণত একটিমাত্র অঙ্কের পরিসরে এবং স্বল্পায়তনে উপস্থাপিত দৃশ্যকে এককথায় একাঙ্কিকা বলা যেতে পারে। জে.ডব্লিউ. ম্যারিয়ট তাঁর ‘One-act play of today’ বইতে একাঙ্কিকাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-
“The one-act play which can be read aloud in twenty minutes or half an hour shows how a single theme can be presented, developed and brought to a climax with the minimum of material and maximum of dramatic effect”
অর্থাৎ,
“একাঙ্কিকা এমন একটি নাটক, যা মাত্র ২০ মিনিট বা আধ ঘণ্টায় পড়ে ফেলা যায়। যাতে দেখা যায় একটিমাত্র কল্পনা কিংবা ধারণাকে উপস্থাপন করা যায়, ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে গিয়ে একটি ক্লাইম্যাক্স তৈরি করা যায়। যেখানে সবচেয়ে কম উপাদান নিয়ে সবচেয়ে বেশি নাটকীয়তা তৈরি করা সম্ভব।”
বিশিষ্ট নাট্য-সমালোচক ড. অজিতকুমার ঘোষ একাঙ্কিকা নিয়ে ‘একাঙ্ক সঞ্চয়ন’ বইতে বলেন-
“ঘটনার অবিচ্ছিন্নতা, ভাবগত অখণ্ডতা, ঘনীভূত রসময়তা- এগুলিই একাঙ্ক নাটকের অপরিহার্য লক্ষণ। একাধিক দৃশ্য ও দৃশ্যসজ্জার মধ্যে এ লক্ষণগুলো মাঝে মাঝে দেখা গেলেও একটি মাত্র দৃশ্যের মধ্যে এ লক্ষণগুলি সবচেয়ে সার্থকভাবে ধরা পড়ে।”
তাহলে একাঙ্ক নাটককে সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে, স্বল্প পরিসরের নাটক। অনেকসময় পাঠক কিংবা দর্শকের উপভোগ করার ব্যাপ্তি হ্রাস এবং আকস্মিকতা আনতে নাটকের এই ধারাটি প্রয়োগ করে থাকেন অনেক নাট্যকার। এখানে ফুটিয়ে তোলা হয় জীবন ও বাস্তববোধের একটি গভীর ভাব। চরম উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যার আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে।
বাংলা সাহিত্যে শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। পাকিস্তান আমলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে করা প্রথম প্রতিবাদকারীদের একজন তিনি। ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর দেয়া সেই প্রতিবাদের বক্তৃতায় ফুটে ওঠে তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। তবে তিনি প্রতিবাদের মূল ভাষা হিসেবে বেছে নেন তাঁর হাতের কলমকে। লেখেন নাটক, প্রবন্ধ আর করেন অনুবাদ । আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর সাথে তাঁকেও বিসর্জন দিতে হয় নিজের প্রাণ।
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি লেখেন ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটক। সেখানে চিত্রায়ন করেন যুদ্ধবিরোধী মনোভাব। তাঁর আরও একটি আলোচিত নাটক ‘চিঠি’। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারণে জেলে যেতে হয় তাকে। সেখানে বসেই তাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ নিয়ে লেখেন ‘কবর’ শিরোনামের একটি একাঙ্কিকা। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত এ নাটকটি কারাগারেই প্রথম মঞ্চায়ন হয়। তিনি অনুবাদ করেন জর্জ বার্নার্ড শ এবং উইলিয়াম শেকসপিয়রের লেখা।
এসব কাজ ব্যাপক প্রশংসা পায়। কিন্তু আড়ালে থেকে যায় তাঁর লেখা একাঙ্কিকা ‘মানুষ’। উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে তিনি ১৯৪৭ সালে একাঙ্কিকাটি রচনা করেন, যেটি ১৯৫০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
‘মানুষ’ একাঙ্কিকাটির ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ
উপমহাদেশের মানুষদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বীজ ছড়িয়ে দিতে ব্রিটিশ শোষক বেছে নেন ধর্মকে। এর ভিত্তিতে ভাগ করে দেয়া হয় উপমহাদেশ। ফলে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী চলে যান বহুদূরে। এটি শান্তভাবে সম্পন্ন হয়নি। লেগে যায় দ্বন্দ্ব। এক ধর্মের মানুষ আঘাত করতে থাকেন অন্য ধর্মের মানুষদের। এমনকি অনেক কাছের একজনকেও অন্য ধর্মের বলে আঘাত করা হয় মারাত্মকভাবে। শুরু হয় দাঙ্গা। সেই দাঙ্গার প্রেক্ষাপট নিয়ে মুনীর চৌধুরী লিখেছেন ‘মানুষ’।
দাঙ্গার সময়ের একটি পরিবারের গল্প এটি। একটি মুসলিম পরিবারের। যাদের একটি যুবক ছেলে দাঙ্গার সময় বেরিয়ে আর ফেরত আসেননি। ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে তাদের ছোট্ট এক শিশু। এই একাঙ্কিকায় উৎকণ্ঠার আশ্রয় নিয়ে ধর্মের গোঁড়ামি কাটিয়ে মানবতার জয়গান করেন মুনীর।
এতে মূল চরিত্র হিসেবে রয়েছে-
১) আব্বা
২) আম্মা
৩) ফরিদ
৪) জুলেখা
৫) শিশু এবং
৬) লোকটা
‘মানুষ’ একাঙ্কিকার শুরুর দিকেই পরিস্থিতির উপস্থাপনের জন্য লেখক বেছে নেন কয়েকটি স্লোগানকে-
“দূরে, বহু কণ্ঠের মিলিত ধ্বনি বন্দে মাতরম। এবং একটু কাছে প্রচণ্ড আল্লাহু আকবর রব”
সচেতন পাঠক আর শ্রোতারা সময় নামক যন্ত্রের পাখায় ভর করে ছুটে চলে যান এই উপমহাদেশের অস্থির এক সময়ে। যখন পাশের ঘরের খুব কাছের একজন প্রতিবেশীকে মারা হতো নির্দ্বিধায়। শুধু নিজের ধর্মের স্বার্থ বিবেচনায় এনে হাতে তোলে নেয়া হতো খড়গ। উপমহাদেশের সেই দাঙ্গার চিত্র। যে যাকে পেরেছে, সামনে পেয়েছে, তাকে মেরেছে কোনো দ্বিধা না করেই।
একাঙ্কিকাটির প্রধান চরিত্রগুলো তাদের নিজেদের ঘরে অবস্থান করছেন। কিন্তু তারা পার করছেন ইতিহাসের অস্থির এক সময়। তাই তাদের নিজেদের মাঝে নেই আলাপচারিতা। তাদের একত্রে থাকার পরেও স্তব্ধতার অন্যতম আরও একটি কারণ তাদের পরিবারের একজন সদস্য মোর্শেদের বাড়ি না ফেরা। বাইরের অস্থির পরিস্থিতি তাই তাদের ভাবিয়ে তুলছে।
পরিবারের কর্তা আব্বাকে দেখা যাচ্ছে খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে কথা বলছেন। নিজেই নিজের সাথে কিংবা তার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের শুনিয়ে শুনিয়ে তার সন্তান মোর্শেদের ইহলোক ত্যাগের কথা বলছেন। আবার নিজেই নিজেকে পাগল ভাবছেন কখনও কখনও। আবার তার ভাবনার জবাব দিচ্ছেন নিজে নিজেই।
আব্বা বলছেন-
“জীবনে অনেক লোককে মরতে দেখেছি, চোখের সামনে। শ্বাস বন্ধ হয়ে, চোখ উল্টে গিয়ে, জিভ বার করে, গলগল করে রক্তবমি করে কত সুস্থ মানুষকে মরতে দেখেছি। কৈ কোনোদিন তো উন্মাদ হয়ে যাইনি”
উপমহাদেশের দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম করার আসল চিত্র যেন এটি। মারা গেছেন আমাদের কত কত মানুষ। একেকজন এখানকার মাটিকে মুক্ত করতে নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। সবশেষে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের আত্মাকে। ক্ষুদিরাম বসু, মাস্টার দা সূর্যসেন, সুভাষ বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের হত্যা আমাদের উন্মাদ করেনি, দিয়েছে মনোবল।
কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে চলা বিভিন্ন সময়ের দাঙ্গা কেড়ে নিয়েছে আমাদের খুব কাছের অনেক তাজা প্রাণ। এখানে লেখক প্রহসন হিসেবেও আব্বা চরিত্রের এই কথাগুলো উল্লেখ করতে পারেন।
এ থেকে পাঠক ও দর্শকের চোখে ভেসে উঠবে রায়টের চিত্র, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চিত্র। শুরুর ‘আল্লাহু আকবর’ ও ‘বন্দে মাতরম’র পর আবার তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে সজাগ করেন লেখক। তখন ঘটনার পুরো চিত্র না বুঝলেও এবার আব্বা চরিত্রের বলা মৃত্যুর কথার পর তারা নিশ্চিত হয়ে যান এ গল্প তখনকার।
পরিবারের কর্তা তার ছেলে মোর্শেদের বিদায়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। তিনি কল্পনায় দেখছেন, তার ছেলের কাটা মাথা নিয়ে প্রতিপক্ষরা উল্লাস করছে। এমতাবস্থায় তার আরেক ছেলে ফরিদ বাইরে যেতে চান। তিনি তার ভাইয়ের খোঁজ নিতে যাবেন। হয়তো ভাইকে তিনি পাবেন না। কিন্তু হাতে ছোরা নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করে তার ভাইয়ের রক্তের বদলা নেবেন।
কিন্তু বাবা তাকে যেতে দেন না। তিনি আরেক ছেলেকে হারাতে চান না। তৎক্ষণাৎ ছেলে ফরিদ তার রাগান্বিত মনের আসল কথাটি বলেন –
“আমার ভাইয়ের কাটা মাথা যারা ফেরি করে বেড়াতে পারে তাদের বিরুদ্ধে ছোরা তুলতে আপনি আমায় নিষেধ করছেন আব্বাজান?”
এই কথার মাঝেই লুক্কায়িত তখনকার সময়ের মানুষদের মনে তৈরী হওয়া জিঘাংসা। অন্যকে বিনাশ করার হিংস্র মনোভাবের রূপ ফুটে ওঠে তার এ কথায়। তার বাবা একথা শোনার পর তাকে আর ফেরাতে পারেন না।
এদিকে মায়ের কোলে থাকা শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে সুস্থ করার জন্য একজন ডাক্তারকে খবর দেবেন, সে সুযোগটাও নেই তাদের। ইতোমধ্যে জানালার কাচ ভেঙে ঘরে ঢুকেন একজন লোক। তিনি তার পরিচয় দেন ‘মানুষ’ বলে।
এদিকে পাড়ায় রটে যায় একজন হিন্দু লোক তাদের মুসলমান পাড়ার এসেছে। তাকে হত্যা করার জন্য খোঁজা হচ্ছে। সেই হিন্দু লোকটিই এই ‘মানুষ’ পরিচয় দেয়া লোকটি। তার পরিচয় পেয়ে পরিবারের কর্তা তাকে চলে যেতে বলেন। আব্বার মনে পড়ে যায় তার সন্তানের কথা। যে সন্তানকে এই লোকটির জাতের লোকেরা হত্যা করেছে, তাকে তিনি কী করে আশ্রয় দেবেন?
“যখন তুমি জানালা ভেঙে প্রাণ বাঁচাতে আমার ঘরে ঢুকেছ, ঠিক তখনই হয়তো তোমার পরম আত্মীয় আমার বড় আদরের ছেলে মোর্শেদকে ছুরির মাথায় গেঁথে নাচাচ্ছে”
কিন্তু ডাক্তারি সম্পর্কে ভালো জানা থাকায় এই লোকটিই তার অসুস্থ শিশুর চিকিৎসা করে ভালো করে তোলেন। কিন্তু পরক্ষণেই ঘটে যায় বিপত্তি। পাড়ার লোকজন তাদের বাড়িতে সেই লোকটিকেই খুঁজতে আছেন। কিন্তু এবার এই ভিন্ন ধর্মের লোকটিকে বাঁচাতে অস্থির হয়ে ওঠেন বাড়ির কর্তা।
কিন্তু কোথায় লুকোবেন তাকে? পরিবারের কর্ত্রী তখন অভিনব এক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তাই তার কাছে আসবেন না পাড়ার লোকেরা। তিনি থাকবেন মশারির ভেতরে পর্দার আড়ালে। সেই লোকটিকে তার সাথে এক মশারির ভেতর আসতে বলেন তিনি। মশারির ভেতরে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যান লোকটি।
এই দৃশ্যের মাধ্যমে লেখক অসাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে সুন্দর চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমাদের উপমহাদেশের মানুষেরা এভাবেই একে অপরকে রক্ষা করতে পারি। একজন আরেকজনের উপকারে আসতে পারি। আমরা কে কোন ধর্মের কিংবা কোন এলাকার তার কি খুব দরকার আছে?
‘মানুষ’ একাঙ্কিকার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় পরিবারের ছেলে মোর্শেদের মৃত্যুর খবর এসেছে। তখন স্তব্ধ হয়ে থাকেন তাঁর বাবা। কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারেন না হিন্দু ধর্মের সেই মানুষটিকে। হয়তো তার ধর্মেরই কেউ বাবার আদরের ছেলেকে মেরেছে। তাই বলে তিনি কেন একজন মানুষকে মারবেন? তিনি তখন চিন্তা করতে থাকেন মানবতা নিয়ে, ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে নয়। কারণ এই লোকটি তারই মতো একজন মানুষ।