মৃত্যুর অভাবে মানুষ বেঁচে থাকে এবং এভাবে বছরের পর বছর বাঁচা যায়।
– শাহীন আখতার
১৯৭১ সালে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ অর্জন করেছিল স্বাধীনতা। যুদ্ধশেষে ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে নতুনভাবে এক রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে শুরু হয়েছিল সরকার ব্যবস্থা। সবকিছুরই পুনবার্সন হতে শুরু হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় করানো হলো রাষ্ট্রের বীর হিসেবে। বীরাঙ্গনাদেরও দেওয়া হলো সম্মানের আসন। সামাজিকভাবে নিজের অবস্থান হারানো নারীদের দেওয়া হলো আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা, সম্মান। নয় মাসে শরীরের উপর চলা নির্যাতনের ঘা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেত, যদি সময়ের মতো সমাজও একইভাবে চলত।
নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করেছিলেন যারা, তারা খুব বেশিদিন পেলেন না এ মর্যাদা আর ভালোবাসা। পাকবাহিনীর বিষাক্ত রক্ত হয়তো তাদের ধমনীতে ছিল না; কিন্তু ছিল সমাজের গুটিকয়েক মস্তিষ্কে। আর তাই, স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বীরাঙ্গনারা পেলেন অসম্মানের তকমা আর তাদের অনেকের ঠিকানা হলো পতিতালয়। যেখানে টাকা দিয়ে শারীরিক সুখ কিনতে আসে সমাজের সেই মানুষেরাই। যে রাষ্ট্র গঠনের জন্য এত ত্যাগ, সেই রাষ্ট্রই তাদের দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বীরের সম্মান তো দূরেই থাক, সাধারণ এক নাগরিক হিসেবে সমাজ তাদের জায়গা দিল না। আগুনে ভুসি দেয়ার মতোই সমাজের মানুষের মুখেও ফুটত অকথ্য আর অশ্রাব্য ভাষার ফুলঝুরি। এমতাবস্থায়, হয় বেশ্যাবৃত্তি, নয়তো মৃত্যু ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না বীরাঙ্গনাদের।
এমনকি স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কথা বলতে এখনো মানুষের কত দ্বিধা, কত অস্বস্তি। এজন্যই হয়তো বীরাঙ্গনা প্রসঙ্গে তেমন একটা গল্প-উপন্যাস নেই। থাকলেও তা হাতেগোনা। আর তাই, হয়তো শাহীন আখতার রচনা করেছেন ‘তালাশ’ নামক উপন্যাসটি। যেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ অবধি এক নারীর সন্ধান করেছেন; যে নারী বীরাঙ্গনা। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদকার হিসেবে ছিলেন ধ্রুব এষ। গল্পের আবহকে খুব সাধারণ আর সহজভাবেই ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন শিল্পী।
প্রচ্ছদপট থেকে, ‘তালাশ’ উপন্যাসের বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ। সেসব মানুষ, যারা বিক্ষত, বিপর্যস্ত, উন্মুল, অভিঘাতস্নাত, বিক্ষুব্ধ এবং জেদী। তাদের খোঁজ পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের আঠাশ থেকে ত্রিশ বছর পর- এ সময়ের পরিধিতে। তৎকালীন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের একজন সমাজকর্মী কিছু স্মৃতি টেবিলের কাঁচের নিচে সংরক্ষণ করতেন। সে সুবাদে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, ‘৭১ এর বীরাঙ্গনা মরিয়মের ঠিকানাটা তার মনে থাকে, যা যুদ্ধের আটাশ বছর পর চলে আসে গবেষক মুক্তির হাতে। সেখানে মরিয়ম আছেন, আবার নেইও। কারণ তার পেছন পেছন নয়মাসের গল্পগাথা ঢাকা ছেড়ে পদ্মা পেরিয়ে চলে গেছে বহুদূর। মুক্তি সেদিকে পা বাড়ান; মুক্তিযুদ্ধের অন্ধকার, অনাবিষ্কৃত পথে কাহিনী এগিয়ে চলে।
কুমিল্লায় জন্ম লেখিকা শাহীন আখতারের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়ার পাট চুকিয়েছেন। লেখালেখির পাশাপাশি ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণেও রয়েছে তার অভিজ্ঞতা। নব্বই দশক থেকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করলেও লেখার সংখ্যা হাতেগোনা অল্প কয়েকটা। গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে ফিকশনের চাইতে নিরীক্ষাধর্মী লেখাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। পাশাপাশি নিবন্ধ, সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনেও রয়েছে তার আগ্রহ।
২০০৪ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘তালাশ’ উপন্যাসটি ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ পুরস্কার অর্জন করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তার রচিত ‘ময়ূর সিংহাসন’ উপন্যাসটির জন্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও, তার অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার এবং এবিপি আনন্দ থেকে ‘সাহিত্যে সেরা বাঙালি’ সম্মাননা প্রাপ্তি। ২০১৫ সালে বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
২০১১ সালে উপন্যাসটি দিল্লীর জুবান পাবলিকেশন্স থেকে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ইংরেজিতে নামকরণ করা হয় ‘দ্য সার্চ’ নামে। বইটির অনুবাদ করেন এলা দত্ত। পরে ২০১৮ সালে বইটি ইংরেজি ভাষা থেকে কোরিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়। অনুবাদ করেন অধ্যাপক সিং হি জন। এরপর ২০২০ সালে নভেম্বর মাসে শাহীন আখতার তালাশ উপন্যাসের জন্য এশিয়া লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল আয়োজিত এশিয়া লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
শাহীন আখতারের লেখনশৈলীতে একধরনের ঘোরলাগা ভাব আছে। অতীত-বর্তমান আর ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে লেখা সেই লেখনশৈলীতে পাঠককে যেন এক চক্রযানে আটকে ফেলেন তিনি। সেজন্যই গল্পের গভীরে ডুবে যেতে খুব একটা সমস্যা হয় না পাঠকের। তবে পাঠকভেদে এই চক্রযানে আটকাতে খানিকটা সময় লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। এই চক্রযানের মূল ইন্ধন অর্থাৎ, লেখিকার লেখনশৈলী অত্যন্ত চমৎকার। সাবলীলতা, প্রাঞ্জলতা, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন এবং উপমার ব্যবহার পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করে। আবার, এখানেও পাঠকভেদে অনেক বর্ণনাই অনেকের কাছে বাহুল্য বলেও মনে হতে পারে। যদিও গল্প বলার ছলে লেখিকা কেবল তার মনের ভাষাই ব্যক্ত করে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী, চলাকালীন এবং পরবর্তী সময় মিলিয়ে সবকিছুর এমন চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন তিনি, যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সেই ব্রিটিশদের মতো করেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছে, সে বর্ণনা এসেছে এভাবে-
পাকিস্তান যেন দেশ নয়, গাভি একটা। তার সামনের দুই পা পূর্বে, পেছনের দুই পা পশ্চিমে। বাঙালিরা রোজ একে ঘাস খাওয়ায়, আর দুধ দুইয়ে নেয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। শতকরা ৬০ ভাগ রাজস্ব আয় করে পূর্ব পাকিস্তান, খরচ করতে পারে মাত্র ২৫ ভাগ। বাকিটা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের উদরে। সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি, জিনিসপত্রের দাম কম।
পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধে নির্যাতিত পুরুষেরা পেয়েছে বীরের আসন, আর নারীরা হয়েছে কলঙ্কিনী। দেশ স্বাধীন হবার পরও যে তাদের বরণ করে নেওয়া হবে না, তা বেশ ভালোভাবেই জানতেন নির্যাতিত নারীরা। তাই তাদের মুখ দিয়েই লেখিকা একথা প্রচার করেন এভাবে,
অনুরাধা বলে, তুমি ভাবছো স্বাধীন দেশের মানুষ মালা দিয়া আমাদের বরণ করবে? না মেরি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা কখনো ঘটে নাই। যুদ্ধ শেষে পুরুষরা হয় বীর, মেয়েরা হয় কলঙ্কিনী।
‘তালাশ’ উপন্যাসে শাহীন আখতার তুলে ধরেছেন তিনটি ভিন্ন সময়ের গল্প। যুদ্ধের আগে, যুদ্ধ চলাকালীন ক্যাম্প জীবন এবং পরবর্তী সময়ে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি পেয়েও একজন নারী এই সমাজে কীভাবে টিকে ছিলেন। বীরাঙ্গনা বলে আশ্রয় দেয় না; বীরাঙ্গনা বলে বাড়ি ভাড়া দেয় না; বীরাঙ্গনা বলে চাকরি মেলে না; বীরাঙ্গনা বলে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জুটে না; আর সেই বীরাঙ্গনা বলেই বাঁচার অধিকার নেই এই তথাকথিত সভ্য সমাজে।
এক বীরাঙ্গনার জীবনের সূত্র ধরে লেখিকা তুলে এনেছেন পুরো সময়টাকে। কীভাবে আসল মুক্তিযোদ্ধা অবহেলায় দিনাতিপাত করেছেন, যেখানে কোনো রাজাকার অবলীলায় মুক্তিযোদ্ধার তকমা পেয়ে গেছেন; কীভাবে বীরাঙ্গনা হিসেবে পুনর্বাসিত হওয়া সত্ত্বেও একজন নারী অসম্মানের পেশা বা নিজ পরিচয় গোপন করে সংসার করেছেন বা হয়তো মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছেন। কীভাবে সমাজ একজন বীরাঙ্গনাকে পদে পদে লাঞ্ছনা ও অত্যাচার করেছে, সে গল্প অবলীলায় বলে গেছেন লেখিকা।
যুদ্ধোত্তর সময়ে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে যেতে কীভাবে হামলে পড়েছিল বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো, সেসবের কথা প্রচার করতে মোটেও দ্বিধান্বিত হননি তিনি। এমনকি তিনি তুলে ধরেন এমন প্রসঙ্গও, যেখানে বর্ণিত হয় আসল যুদ্ধ তো ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে হয়েছে; মুক্তিযোদ্ধারা কেবল পাশে থেকে সাহায্য করেছে। ইতিহাসকে বিকৃত করার লক্ষ্যে নয়; বরং বিকৃত মস্তিষ্ক কীভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করেছিল, তা-ই যেন তিনি স্পষ্টভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। যেখানে নিজের মা-বাবা, পরিবারই বীরাঙ্গনাকে মেনে নিতে পারেনি, সেখানে সমাজ আর রাষ্ট্র তো অনেক দূরের কথা। সেখানে বীরাঙ্গনাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন জাতির পিতা।
পরবর্তীতে তার মৃত্যুতে পরিস্থিতি কীভাবে বদলে যায়, তার বর্ণনা এসেছে এভাবে-
বঙ্গবন্ধু চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোও উঠে গেল। শুনেছি জিনিসপত্রও নাকি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। পতিতালয় উচ্ছেদ করার মতো করে মেয়েদের তাড়িয়ে দেয়।
যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই কী করে বাঙালি সংস্কৃতি বদলে গিয়েছিল, তাও স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছেন লেখিকা। ধর্মের দোহাই দিয়ে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি কী করে এক নিমেষে ধুলিসাৎ হয়েছিল, তার বর্ণনা রয়েছে এ বইয়ে; যেখানে এক অসাম্প্রদায়িক যুদ্ধের ফসল ছিল স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক থেকে সমাজতান্ত্রিক এবং সেখান থেকে স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কী করে প্রতিষ্ঠা পেল এ সমাজে, তার বিবরণও রয়েছে এতে। বিয়ের মাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসন দেয়ার কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। কিন্তু সেই বিয়ে যে পাকিস্তানি সেনাদের দেওয়া বিভীষিকার এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল, সেটাও লিখতে ভুলেননি লেখিকা। বিষয়টি তিনি এভাবে বলেন,
ভালোবাসাহীন শরীরী সম্পর্ক একপ্রকার ধর্ষণই, পুরুষটি স্বামী হলেও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ভালোবাসার অর্থ কী। সংগম এবং ধর্ষণের ফারাক কী?
‘তালাশ’ উপন্যাসে শাহীন আখতার মূলত মরিয়ম নামে এক যুবতীর গল্প বলেছেন। যুদ্ধের আগে যার সম্পর্ক হয় এক তরুণের সঙ্গে। যে রাজনীতি করার স্বপ্নে বিভোর; যে উত্তাল সময়টাতে নিজের গা ভাসিয়ে দিতে ব্যস্ত; যে দেশটাকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে মত্ত। কিন্তু মরিয়মের পেটে অনাগত সন্তানের জনক হবার সময় নেই তার; এমনকি নেই সংসার বাঁধার সময়। তাই অনাহূত সন্তান বিসর্জন দেয় মরিয়ম। আর সেই দুঃখ ভোলার আগেই ঢাকার বুকে রাতের আঁধারে নেমে আসে শত শত বুট।
সেই বুটের আওয়াজ তাড়া করে ফিরে মরিয়মকে। চার দেয়ালে বন্দি হয়ে নয়টা মাস কাটিয়ে দেয় সে। যুদ্ধ শেষ হয়; সবকিছু নতুন করে শুরু হয়। কিন্তু নতুন জীবন ফিরে পায় না কেবল মরিয়ম। চার দেয়ালের বন্দি জীবনের ট্রমা বাস্তবে রূপ নেয়। ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি মরিয়মকে খুব বেশীদিন সম্মানের আসনে বসিয়ে রাখতে পারে না। বীরাঙ্গনা পুনর্বাসন কেন্দ্র উচ্ছেদ হয়। বীরাঙ্গনা সম্মানে বিবাহিত জীবন ভেঙে যায়। সাধারণ নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকাটাই দুরূহ হয়ে দাঁড়ায় মরিয়মের জন্য।
তিন দশক পর সেই গল্পই খুঁজে ফেরেন মুক্তি। আর সেই গল্পের অলিগলিতে মরিয়মের সঙ্গে তার জীবনের অর্থ খুঁজে ফেরে পাঠক।
বই: তালাশ || লেখক: শাহীন আখতার
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ || প্রকাশনী: মাওলা ব্রাদার্স