সাদাত হাসান মান্টো আর মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান গালিব উপমহাদেশের দুই নক্ষত্র, দুই ভিন্ন সময়ে ভারতে জন্ম নিয়েছিলেন, গালিবের সময় মুঘল শাসন একটু একটু করে নিভে যাচ্ছিল, ব্রিটিশদের অধিকারে যাচ্ছে ভারতবর্ষ। আর মান্টোর জীবন কেটেছে যখন, ইংরেজ সাম্রাজ্য ভারতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে, দেশভাগের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে উপমহাদেশের লক্ষ কোটি মানুষ। দুই পট পরিবর্তনের ঘূর্ণিপাকে চিরে খেয়েছে দুজনকেই।
ছোটগল্পের জগতের প্রবাদ পুরুষ মান্টো আর গজল-কবিতার জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী গালিবকে নিয়ে ‘দোজখনামা’ উপন্যাস। ‘দোজখনামা’ উপন্যাসের বুনন বেশ অদ্ভুত। কবরে শুয়ে গালিব আর মান্টোর কথোপকথন চলছে, যেখানে রুক্ষভাবে তাদের জীবনের ঘটনাগুলো বলে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল না। বরং মসলিনের পিঠে যেমন কারুকার্য ফুটে উঠে ঠিক তেমন করেই পরতে পরতে লেখক মান্টো আর গালিবের জীবনের দুঃখ, একাকীত্ব, পারিবারিক জীবন সব তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসে আছে একটি পরাবাস্তব আবহ, মান্টো আর গালিব কেউই সমকালীন ছিলেন না, দুজনের দেখা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। একজন শুয়ে আছেন দিল্লীতে আরেকজন কাঁটাতারের ওপারে পাকিস্তানের লাহোরে। তবে মান্টোর আজীবন সাধ ছিল গালিবকে নিয়ে কিছু একটা করে যাওয়ার। সেখান থেকেই লেখক উপন্যাসের শুরুটা এমন নাটকীয়তায় করেছেন, পড়ে মনে হয় মান্টো যেন সত্যিই গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লিখে রেখেছেন। কিন্তু মান্টো তো উপন্যাস লিখেননি, তিনি ছোটগল্পের জাদুকর, জীবনের বাকে বাকে পোড় খাওয়া এই গল্পকারের কবরের ফলকেই লেখা আছে,
” সাদাত হাসান মান্টো এখানে চিরনিদ্রায়। তার সাথে গল্প লেখার সব রহস্যও কবরে চলে গেছে। মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে, কে বড় গল্প লেখক, মান্টো না খোদা?”
শুরুটা হবে গালিবের গল্প দিয়েই!
গালিবের ভাগ্য লেখা ছিল ভারতবর্ষে, আগ্রা দিল্লীর রাজপথ মুখরিত হবে তার কবিতা আর গজলে। তাই হয়তো ভাগ্যের সন্ধানে গালিবের পূর্বপুরুষেরা তুরস্ক থেকে ভারতবর্ষে আসে, দাদা পরদাদারা ভারতের বিভিন্ন রাজার অধীনে সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। গালিবের বাবা আবদুল্লাহ বেগ খান আসফ-উদ-দৌলার বাহিনীতে চাকরি নিয়েছিলেন। স্ত্রী আর তিন সন্তানকে রেখে যুদ্ধের প্রান্তরেই হারিয়ে গিয়েছিলেন আবদুল্লাহ। বাবার স্নেহ গালিবের পাওয়া হয়ে উঠেনি, মাকেও কাছে পাননি খুব একটা। এতিম গালিব আগ্রায় বেড়ে উঠেছিলেন।
গালিব, তার ভাই ইউসুফ, বোন ছোটি খানম আর তার মায়ের জায়গা হয় আগ্রার এক মহলে, মায়ের থাকেন সুরক্ষিত জেনানামহলে। মায়ের সাথে দেখা হয় খুবই কম, গালিব মহল থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় নামেন, মানুষের জীবনের গল্পগুলো চোখ দিয়ে পড়তে শুরু করেন।
সৈনিকের মৃত্যুর পর তার তলোয়ারের উত্তরাধিকারী হয় তার পুত্র। কিন্তু আবদুল্লাহ যুদ্ধে কোথায় হারিয়ে গেছে, সে খোঁজ কেউ রাখেনি। গালিবের হাতেও তলোয়ার উঠেনি, তার হাতে উঠেছে কলম, সাথে ঘুড়ি উড়ানো আর দাবা খেলায় হাত পাকালেন। ১১ বছর বয়স থেকেই ‘শের’ লিখতে শুরু করেন তিনি।
হিন্দি-উর্দুর পাশাপাশি ফারসি, আরবি শেখার শুরু হয় মহলেই। আব্দুস সামাদের কাছে ফারসি শেখার হাতেখড়ি হয় গালিবের। গালিবের মনে ফারসি ভাষায় রচিত গজলের প্রতি এক বিশেষ টান ছিল। গজলের ভাষা হিসেবে ফারসিকে উর্দুর উপরে রাখতেন গালিব। গজল, কবিতায় আধ্যাত্মিকতা চর্চাও একটি ধারা তখন প্রচলিত ছিল, সেই ধারা তার মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে।
গালিবের জীবনে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসেনি কখনোই। দিল্লীর এক অভিজাত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে আগ্রা ছেড়ে দিল্লীতে এলেন গালিব। মুঘল সাম্রাজ্যের তখন আর সেই আভিজাত্য নেই, ইংরেজদের অধিকারে চলে যাচ্ছে সব। দিল্লীতে শ্বশুর ইলাহী বক্স খানের বাড়িতেই থিতু হয়েছিলেন তিনি। স্ত্রী উমরাও বেগমের সাথে বনিবনা হয়েছিল কি? সেখানে রয়ে গেছে এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। ভৃত্য কাল্লু গালিবের সহচর হয়ে কাটিয়েছে দীর্ঘ সময়, গল্প শুনতে ভীষণরকম পছন্দ করা কাল্লুও এক আশ্চর্য চরিত্র। তার সূত্রে কাহিনীর প্রয়োজনে গল্প শাখা প্রশাখা মেলেছে বিভিন্ন জায়গায়।
আসলে কাল্লু কিংবা উমরাও বেগম কেমন চরিত্র ছিল সেই প্রশ্ন ইতিহাসের জন্য রেখে দিয়ে এই উপন্যাস পড়তে নামতে হবে। দোজখনামার দুনিয়াতে কাল্লু আর উমরাও বেগম চরিত্র দুইটি গালিবকে জড়িয়ে আছে অদ্ভুতভাবে।
গালিবও ছিলেন অভিজাত জীবনে অভ্যস্ত। মির্জা হওয়ার সুবাদে পালকি চড়ে যাতায়তে অভ্যস্ত ছিলেন। গজল আর কবিতার পাশাপাশি মদ, নারী আর জুয়াতেও আসক্ত হয়ে গিয়েছিলেন গালিব। নিজের বাড়িতেই বসাতেন জুয়ার আসর, দিল্লীর অভিজাত মানুষেরা যোগ দিতেন গালিবের সেই আসরে। তবে আর্থিক অনটনের মুখেও ধারদেনা করে তার দিন চলে যেত। গালিবের কাছে গজল ছিল, একটু পৃষ্ঠপোষকতার দরকার ছিল, মুঘল দরবারে জায়গা হয়নি তার, মুঘল দরবারে জৌলুশ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে, ইংরেজদের দয়া দাক্ষিণ্যে টিকে ছিল দিল্লীর দরবার।
বিলাসী জীবন গুজরান করতে গিয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েছিলেন আগেই। ইংরেজদের কাছে পাওনার পেনশনের জন্য দেন দরবার করতে হয়েছে, দিল্লী থেকে কলকাতা লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার বিবরণকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসাধারণ দক্ষতায়। গালিবের চোখ দিয়ে বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য আরেকবার চোখে পড়বে পাঠকদের। তাই ইতিহাস বইয়ের পাতা হয়তো উল্টাতে থাকবে কিন্তু উপন্যাস এগিয়ে যাবে নিজের গতিতে।
আছে মান্টোর গল্পও
এই উপন্যাসের পরতে পরতে গালিবের জীবনের সাথে পাওয়া যায় মান্টোর জীবনের কথাও। সাদাত হাসান মান্টোর জীবনটাও খুব সুখের ছিল না। ছোটবেলায় বাবার কাছেও খুব একটা সহানুভূতি পাননি মান্টো। প্রথম পক্ষের সন্তানদের প্রতি তার মনোযোগ ছিল বেশি, দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান হিসেবে মান্টো ছিলেন অবহেলিত। পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্ম মান্টোর, তবে মান্টোর কর্ম আর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে বম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহর। এই বম্বে শহরেই তার উত্থান। মান্টোর দাবী ছিল বম্বে শহর তার সাথে কথা বলতে পারতো, কান লাগিয়ে তিনি এই শহরের হাসি-কান্নার আওয়াজ শব্দে পরিণত করতে পারতেন।
জীবনে উপার্জনের জন্য কম পরিশ্রম করেননি তিনি, সিনেমার স্ক্রিপ্ট কিংবা গল্প লেখা সবই চালিয়ে গেছেন সমান তালে। মান্টোর জীবনে তার স্ত্রী শাফিয়া ছাড়াও এসেছে আরেক নারী ইসমত চুগতাই। মান্টো আর ইসমতের সম্পর্ক নিয়েও অনেক জল ঘোলা হয়েছে, আসলেই কি মান্টো ভালোবাসতেন ইসমতকে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো মান্টো বাদে কেউ দিতে পারবে না। তবে এই উপন্যাসে রঙিন সাহিত্যিক সম্পর্কের নানান দিক নিয়ে মান্টোর হয়ে কথা বলেছেন লেখক নিজেই।
দেশভাগের পর মান্টো তার প্রাণের শহর বম্বে ছেড়ে পাড়ি জমায় পাকিস্তানে। ইসমতের সাথে সম্পর্কে ভাঁটা পড়ে, নতুন দেশ পাকিস্তানে অর্থের অভাবে কষ্টের দিনগুলো কাঁটা হয়ে বিধে পাঠকের মনে। দিনে দিনে মদের আসক্তি বাড়তে থাকে, ফিরতে ইচ্ছে করে বোম্বে কিন্তু যেতে পারেন না, লেখালেখি থেকে যে টাকা আসে তা দিয়ে পরিবার চলে না তাই পারিবারিক জীবনটাও কঠিন হয়ে উঠে তার জন্য।
মান্টো আর গালিব মিলে একাকার
জীবনটাই যেন জলন্ত দোজখ হয়ে উঠেছিল মান্টো আর গালিবের। অর্থকষ্ট, নারী থেকে মদের নেশা, এই দুইজনকে চিরে খেয়েছে। তবে বারবনিতাদের কাছে শুধু আনন্দের জন্যই নয়, গল্পের জন্য, ভালোবাসার জন্যও ধরা দিয়েছেন এই দুজন। মান্টোর গল্পের বিরুদ্ধে উঠেছে অশ্লীলতার অভিযোগ, যদিও কোর্টে তার বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর দিল্লীর রাজদরবারের জৌলুশ নিভে যায়, দিল্লীর পতন নিজের চোখে চেয়ে দেখেন গালিব। পাথর চাপা দিয়ে বেঁচে ছিলেন আরো কিছুদিন। আর মান্টো বয়ে বেড়িয়েছেন দেশভাগের ক্ষত। সেই দগদগে ক্ষতের ছবি তার কলম দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক গল্পে।
‘দোজখনামা’য় এক পরাবাস্তব আবহ আছে, সুফী গল্প আর কিসসার আড়ালে দুই মহারথীর জীবন উঠে এসেছে, ইতিহাসকে অনেক জায়গায় পাশ কাটিয়ে পাঁচিল টপকে গেছেন লেখক, আর সব মিলিয়ে অসাধারণ এই উপন্যাসটি পশ্চিমবঙ্গে ‘বঙ্কিম পুরষ্কার’ লাভ করেছে।
সবশেষে ‘দোজখনামা’য় মান্টো আর গালিবের কথোপকথনকে যদি কয়েকটি বাক্যে যদি বলতে হয়, তাহলে উপন্যাস থেকে কয়েকটি লাইন নিয়ে এইরকম করেই বলা যায়,
“মান্টো তাঁর সমস্ত জীবন একটি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, মির্জা মহম্মদ আসাদুল্লা খান গালিব। মান্টোর মনে হয়েছে মির্জা আর তিনি যেন মুখোমুখি দুটি আয়না। দুই আয়নার ভিতরেই শূন্যতা। দুই শূন্যতা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।”