মহামারীর সময়ে দিকভ্রান্ত মানুষের অবস্থা কেমন হয়, তা কিছুটা হলেও আঁচ করা যাচ্ছে করোনাভাইরাসের কারণে। সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে দৃষ্টিগোচর হয় আজকাল। অর্থনীতি কিংবা রাজনীতির চেয়েও জীবন বড়- এ কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় সবখানে। স্বর্ণের চেয়ে হেক্সিসলের গুরুত্ব বেশি এই মুহুর্তে। অদৃশ্য ভাইরাসের সর্বগ্রাসী প্রলয় থেকে বাঁচার জন্য মানবীয় সম্পর্কের পতন ঘটাতেও মানুষ দ্বিতীয়বার ভাবছে না। পৃথিবীর অনেক কিছুই নতুন চোখে দেখতে হচ্ছে, নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
মহামারী প্রভাব পড়ে সাহিত্যেও। সাহিত্য তো জীবনের অংশই! মহামারীর জীবন বাস্তবতায় সাহিত্যিকরা পেয়ে যান লেখালেখির নতুন প্লট। কখনও আবার মহামারী হয়ে ওঠে দানবীয় শক্তির অত্যাচারের প্রতীক। লেখকরা কলম ধরে এগোতে থাকেন সাহিত্যকে নতুন কিছু দেয়ার তাগিদে। মহামারী নিয়ে লেখা যেসব উপন্যাস বিখ্যাত, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে আলবেয়ার কামুর ‘দ্য প্লেগ’ থাকবে।
‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি যখন লেখা হয়, তখন বিশ্ব ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে যুদ্ধের কালো থাবায়। যেন-তেন যুদ্ধ নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অবশ্য মানবসভ্যতার ইতিহাস তো যুদ্ধেরই ইতিহাস। ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে যুদ্ধের কথা পাওয়া যায় ডালভাতের মতো। এখানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাঁড় করানো হয়, শান্তিকামী মানুষের দৌড়ঝাঁপ নিয়ে তার সিকিভাগটুকুও হয় না।
উপন্যাসের লেখক আলবেয়ার কামু জন্মেছিলেন ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ায়। কাছ থেকে দেখেছিলেন ফরাসিদের নির্মম শোষণ। সুচতুর কায়দায় কীভাবে আইন-নৈতিকতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে উপনিবেশগুলোকে উলঙ্গ করে রেখে সবকিছু নিয়ে চলে যায়, তা আলজেরিয়ায় বড় হতে হতে প্রত্যক্ষ করছিলেন কামু।
উপন্যাসে বারবার যে শহরের কথা উঠে এসেছে, সেই ওরাওঁ শহর আদতে শ্রীহীন। লেখকের ভাষায়,
ওরাওঁ এ শীত এবং গ্রীষ্ম দুটোই প্রচন্ড। প্রকৃতিও অত্যন্ত নির্মম ও প্রতিকূল। সৌন্দর্য বলতে কিছুই নেই এই শহরে। গাছে লতা নেই। পাতায় নেই মর্মর। কবুতর চোখে পড়ে না। শোনা যায় না পাখির ডানার ঝাপটানি।
এ যেন উপনিবেশবাদের করাতের আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনো এক নিঃস্ব শহরের বর্ণনা। কিংবা মনে হতে পারে কোনো এক মৃত্যু উপত্যকা যেখানে প্রকৃতি প্রতিনিয়ত নির্মমতা প্রদর্শন করে চলেছে।
‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের কোথাও লেখক নাৎসি বাহিনীর নির্মমতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন কিংবা ফরাসিদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেননি। কিন্তু যে প্রবল শক্তিশালী মহামারীর করাল গ্রাসের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তা আদতে নাৎসি বাহিনীর অমানবিকতারই প্রতিনিধিত্ব করে। একটু গভীরে গিয়ে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। মহামারীর আতঙ্কে পুরো শহর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে। প্রতি সপ্তাহ শেষে যখন মৃত মানুষের সংখ্যা ঘোষণা করা হয়, তখন বেঁচে থাকা মানুষগুলো আরেক দফা ভীত হয়। দিগন্তে তাকিয়ে থাকে বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকু নিয়ে। তাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগে, মহামারীর পরে বেঁচে থাকা মানুষদের তালিকায় তাদের নাম থাকবে কি না।
উপন্যাসের চরিত্রের প্রসঙ্গে আসলে প্রথমেই বার্নাড রিওর কথা বলতে হয়। ভদ্রলোক পেশায় একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার। ওরাওঁ শহরের অধিবাসীদের কাছে তিনি ‘ডাক্তার রিও’ হিসেবেই পরিচিত। মহামারীর প্রকোপ থেকে শহরের মানুষদের বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। মহামারী ঠেকাতে একজন মানুষ আর কতটুকুই বা করতে পারে! মহামারীর আগমনের পর তার ব্যক্তিজীবন বলতে আর কিছুই থাকে না। এরপরও তিনি হতাশ নন। তার অস্তিত্ববাদী দার্শনিকতাসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসে মুগ্ধতা ছড়ায়।
উপন্যাসের বাকি চরিত্রগুলোর মধ্যে আলাদা করে র্যাঁবেয়ার কথা বলতে হয়। ফরাসি এই সাংবাদিক তার প্রিয়তমাকে রেখে ওরাওঁ শহরে এসেছিলেন তথ্য সংগ্রহের জন্য। কিন্তু পুরো শহর লকডাউনের ফলে তাকে আর তার নিজ শহরে ফিরতে দেয়া হয়নি। মহামারীতে পর্যুদস্ত শহরে জীবন বিষিয়ে উঠে তার। ফলে নতুন করে অস্তিত্বের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হয় তাকে। পড়তে পড়তে একসময় মনে হতে পারে র্যাঁবেয়া যেন সেই আলজেরিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছে, যাকে জোর করে ফরাসিদের পদতলে রাখা হয়েছে এবং সে নিজ দেশে ফেরা অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
গণমাধ্যমে স্বাধীনতা, অবাধ তথ্যপ্রবাহ এসব যে কেবলই মিথ কিংবা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা কথা, তা উপন্যাসে উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। সরকারি প্রোপাগান্ডা প্রচারে সিদ্ধহস্ত শহুরে গণমাধ্যমগুলো জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলে প্রতিনিয়ত। সরকারের পরিকল্পিত শোষণের সম্মতি উৎপাদনে এদের জুড়ি মেলা ভার।
উপন্যাসের শেষে গিয়ে কমে আসে মহামারীর প্রকোপ। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মহামারীর রাজত্বের শেষটায় শহরে মানুষের আগের মতো প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে। যেন উপনিবেশ থেকে মুক্তি কিংবা নাৎসিদের পরাজয় বরণ শেষে বেঁচে থাকা মানুষগুলো স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এই শেষটাই কি চিরন্তন? সেই প্রশ্ন লেখক রেখে গিয়েছেন পাঠকের সামনে।
ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামু জীবনে দেখেছেন অনেক উত্থান-পতন। আলজেরিয়ার জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। একসময় ফ্রান্সে গিয়েছেন। এরই মধ্যে আবার বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। কিন্তু কামু তার পেশাগত দায়িত্ব ইস্তফা দেননি। দুঃসময়েও কোঁবা নামের একটি নিষিদ্ধ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, লেখা সংগ্রহ করতেন।
তার সাহিত্যকর্ম খুব বেশি নয়, কিন্তু সবগুলোই একেকটি মাস্টারপিস। ১৯৫৭ সালে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন এই মহান সাহিত্যিক। সহজসরল ভাষায় কীভাবে ইতিহাসের সাথে সুক্ষ্ম রাজনৈতিক চেতনা মিশিয়ে দূরুহ ঘরানার সাহিত্যকেও সর্বসাধারণের পাঠযোগ্য করে তোলা যায়, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহে আলবেয়ার কামু একজন বিশেষজ্ঞ। ‘দ্য প্লেগ’ ঠিক সে ঘরানারই একটি উপন্যাস, যেটি আপনি এক বসায় পড়ে শেষ করতে চাইবেন!