বেশিরভাগ মানুষ যেখানে গতানুগতিকভাবে কাজ করে যায়, সেখানে অল্প কিছু মানুষ স্রোতের বিপরীতে কাজ করে। তারা আগের তৈরি পথে না হেঁটে তৈরি করে নিজেদের পথ। কালে কালে এই সৃজনশীল মানুষেরাই পৃথিবীকে দেখিয়েছে নতুন আশার আলো। এজন্যই সৃজনশীল হওয়ার গুরুত্ব এত বেশি! এখন প্রশ্ন আসতে পারে- সৃজনশীল হওয়ার উপায় কী? কীভাবে সৃজনশীলতাকে বিকশিত করা যায়? এ বিষয় নিয়ে ‘Mastering Creativity’ নামে খুব সুন্দর একটি বই লিখেছেন জেমস ক্লিয়ার। ছোট এই বইটিতে তিনি সৃজনশীলতার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। চমৎকার সেই বইটি নিয়েই আলোচনা করা হবে আজ।
পরিশ্রম সৃজনশীলতাকে পূর্ণতা দান করে
আমরা সাধারণত মনে করি, প্রতিভাবানরা খুব একটা পরিশ্রম করেন না। তারা যেটা করেন সেটাই অসাধারণ হয়ে যায়। কিন্তু তাদের সেই অসাধারণ কাজের পেছনে থাকে অনেক ভুল ও ব্যর্থতা এবং সেগুলো জয় করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম। পাবলো পিকাসোকে একবার এক মহিলা কলম ও কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমাকে কিছু একটা এঁকে দিন। পিকাসো অল্প সময়ের মধ্যে একটা অসাধারণ আর্ট করে দিলেন। তারপর বললেন, এটার দাম এক মিলিয়ন ডলার। মহিলা বললেন, এটা তো আপনি মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডে এঁকেছেন। পিকাসো বললেন, ত্রিশ সেকেন্ডে এই কাজটি করার জন্য আমাকে ত্রিশ বছর ধরে কাজ করতে হয়েছে।
মার্কাস জুসাক তাঁর বিখ্যাত বই ‘The book theif’ বইটি লিখেছেন প্রায় তিন বছর ধরে। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাই তিনি ১৫০-২০০ বার লিখেছেন। বইটি প্রথমে তিনি মৃত ব্যক্তির কথায় লিখেছেন। তারপর লিখেছেন প্রধান চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি অতীত-বর্তমান সবদিক দিয়েই চেষ্টা করেছেন। কোনো কিছুই তার মন মতো হচ্ছিলো না। অবশেষে জুসাক মৃতের দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি লেখেন, বইটি বেস্টসেলারে পরিণত হয়। এর উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রও বানানো হয়।
ভাগ্য পরিশ্রমীদের সহায় হয়
কেউ বলতে পারে, সৃজনশীল মানুষেরা সফল কারণ তারা ভাগ্যবান। সাফল্যে যদিও ভাগ্যের হাত আছে, কিন্তু ভাগ্য তখনই হাতে ধরা দেয় যখন সেই ভাগ্যের জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করা হয়। পিকাসো কিংবা জুসাকের উপর ভাগ্য তখনই সহায় হয়েছিলো, যখন তারা তাদের সর্বোচ্চ পরিশ্রম করেছিলেন। শোন্ডা রাইমসের মতে,
“আপনি স্বপ্ন দেখেন বলে কিন্তু স্বপ্ন সফল হয় না। কঠোর পরিশ্রমের কারণে সব কিছু হয়। কঠোর পরিশ্রমের ফলে পরিবর্তন আসে। স্বপ্নকে ছাড়ুন। স্বপ্নবিলাসী না হয়ে কাজের মানুষ হোন। আপনার স্বপ্ন হয়তো আপনি জানেন। কিন্তু আপনি সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারছেন না, কারণ আপনি জানেন না আপনার কী ভালো লাগে। সত্যি কথা হচ্ছে, আপনার জানার দরকারও নেই। আপনাকে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কিছু না কিছু করতে হবে। সুযোগ লুফে নিতে হবে। নতুন কিছুর জন্য তৈরি থাকতে হবে। এটা আপনি যেমনটা চান ঠিক ওরকমই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নির্ভুল কিছু সবসময় একঘেয়ে, আর স্বপ্ন সত্যি নয়। শুধু কাজ করে যান।”
যত বেশি কাজ করবেন সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে
আপনি যত বেশি কাজ করবেন আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। এই নিয়মকে বলে ‘ইকুয়েল অড রুল’। মনোবিজ্ঞানী কেইথ সিমন্টন এই তত্ত্বটি দেন। এ তত্ত্বমতে, যেকোনো বিজ্ঞানীর অসামান্য কিছু আবিষ্কার করা কিংবা সাধারণ কিছুর আবিষ্কার করার সম্ভাবনা সমান। অন্য কথায়, আপনি আপনার সাফল্য নিয়ে ভবিষৎবাণী করতে পারেন না। তাই আপনি যেটা করতে পারেন তা হলো বেশি বেশি কাজ তৈরি করা। ফলে অনেকগুলো কাজ থেকে কিছু কাজ খুব ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য আপনাকে এমন অনেক কাজ করতে হবে যা আপনার মন মতো নয়। কিন্তু আপনি যদি অসাধারণ কিছু তৈরি করতে চান তাহলে আপনার নিজেকে সাধারণ কিছু করার অনুমতিও দিতে হবে। সাধারণ আইডিয়াগুলো আপনার মাথা থেকে বের হয়ে গেলে অসাধারণ আইডিয়াগুলো আসার সুযোগ পাবে। তাই শুধু কাজ করে যান। আপনি যদি শুধুমাত্র কালজয়ী কাজ করতে চান, তাহলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন। তাই আপনার করে যাওয়া কাজের কোনটি কালজয়ী হবে আর কোনটি হবে না সেটাকে সময়ের উপর ছেড়ে দিন।
কাজের জন্য মনের উপর নির্ভর করবেন না
সৃজনশীল কাজ করার জন্য মনের ইচ্ছের উপর নির্ভর করবেন না। মন থেকে যখন উৎসাহ আসবে, যখন মনে লেখার ভাব আসবে তখনই লিখবেন এমনটা যেন না হয়। এমন হলে কাজটাই আর কখনও শেষ করা হবে না হয়তো। কারণ আমরা খুব কম সময়ই মন থেকে উৎসাহ পাই কাজ শুরু করার জন্য। এক্ষেত্রে উল্টোটা সত্যি। কাজ শুরু করার পর একটা ভালো লাগা শুরু হয়। তখন কাজ শেষ করার জন্য একটা উৎসাহ জাগে। তাই দেখা গেছে কাজ শেষ করার চেয়ে কাজ শুরু করা খুব কঠিন।
কাজের শুরু করুন ভালো কোন অভ্যাস দিয়ে:
অভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস। আপনাকে যদি প্রতিটি কাজ করার আগে চিন্তা করতে হয় যে কাজটা করবো কিনা তাহলে খুব অসুবিধা। এজন্য কিছু কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট অভ্যাস থাকা উচিত, বিশেষ করে আপনার সৃজনশীল কাজের জন্য। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী টোয়াইলা থর্পার বলেন,
“আমি একটা অভ্যাসের মাধ্যমে আমার দিন শুরু করি। সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠি। আমি ব্যায়ামের কাপড় পরি, আমার সোয়েট শার্ট আর টুপি পরি। আমি আমার ম্যানহাটনের ঘরের বাইরে হাঁটি। ট্যাক্সি ডাকি এবং ড্রাইভারকে 91 স্ট্রিট, ফার্স্ট এভিনিউ, পাম্পিং আয়রন জিমে নিয়ে যেতে বলি। অভ্যাস এটা নয় যে আমি জিমে গিয়ে ভার উত্তোলন কিংবা ব্যায়াম করি। অভ্যাস হলো আমি ড্রাইভারকে যখন নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে বলি। এটা একটা সহজ কাজ। কিন্তু প্রতিদিন সকালে এটা করতে করতে এটা অভ্যাস হয়ে যায়। বার বার করা সহজ হয়। এর ফলে জিমে উপস্থিত না হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এটা আমার রুটিনের একটা অংশ এবং এতে চিন্তা করার একটা বিষয় কমে গেলো।”
নিজের জন্য সীমাবদ্ধতা তৈরি করুন
আমাদের সৃজনশীলতা তখনই সবচেয়ে বেশি কাজ করে যখন আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। ড. সুসকে বেনেট সার্ফ একবার চ্যালেঞ্জ করেছিলেন শুধুমাত্র পঞ্চাশ শব্দ ব্যবহার করে ছোটদের একটি মজার বই লেখার জন্য। ড. সুস এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে লিখলেন বেস্টসেলার ‘গ্রিন এগস এন্ড হ্যাম’ । অনেকে হয়তো মনে করতেন, পঞ্চাশ শব্দ ব্যবহার করে বই লেখা সম্ভব না। কিন্তু সুস এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। আমাদের নিজেদেরকে নিজেদের এভাবে চ্যালেঞ্জ করা উচিত। এটা হতে পারে প্রতিদিন আধা ঘণ্টা ব্যায়াম করা কিংবা সপ্তাহে দুটি আর্টিকেল লেখা। এরকম বাঁধাধরা অবস্থায় সৃজনশীলতা খুব বেশি কাজ করে।
পেশাদার মনোভাবের হোন
একজন পেশাদার এবং একজন অপেশাদারের মধ্যে পার্থক্য হলো পেশাদার লোক নিয়মিত কাজ করেন। আপনি আপনার স্বপ্ন ও লক্ষ্য জানেন। কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণ করার জন্য আপনাকে নিয়মিত কাজ করে যেতে হবে। পেশাদারভাবে কাজ করে যাওয়া কষ্টের। কারণ এমন সময় আসবে যখন আপনার রুটিন মেনে কাজ করতে ইচ্ছে করবে না। মনে হবে সবকিছু ছেড়ে দিই। কিন্তু যখন আপনার ইচ্ছে করছে না, যখন সবকিছু আপনার প্রতিকূলে, তখন কাজের সাথে লেগে থাকাই আপনাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে। এটাই পেশাদারী মনোভাব।
এই মনোভাব অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে তিনটি পদক্ষেপ নিন।
১) আপনি কীসে পারদর্শী হতে চান তা ঠিক করুন। অনেকে জানেনই না তারা কী করতে চান।
২) আপনার উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করার জন্য রুটিন ঠিক করুন। তবে ফলাফলের উপর ভিত্তি করে রুটিন করবেন না। যেমন এক সপ্তাহে পাঁচ কেজি ওজন কমানো। পাঁচ কেজি ওজন কমানো কোনো কাজ না। এটা করা আপনার হাতে নেই। কিন্তু প্রতিদিন এক ঘণ্টা ব্যায়াম করা- এটা আপনি করতে পারেন। এর ফলাফল হিসেবে হয়তো আপনার ওজন কমতে পারে।
৩) আপনার রুটিনের সাথে এক সপ্তাহ লেগে থাকুন। রুটিন তৈরি করা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো রুটিন অনুযায়ী কাজ করা।
সৃজনশীলতাকে সঠিকভাবে বিকশিত করার জন্য এটাকে কাজে লাগানো উচিত। ধারালো ছুরি যেমন ব্যবহার না করতে করতে ভোঁতা হয়ে যায়। ঠিক তেমনি অনেক সৃজনশীল মানুষও আলসেমির কারণে তাদের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে পারেন না। সৃজনশীলতাকে বিকশিত করার উপায় একটিই। আর তা হলো কাজ করা এবং তাতে লেগে থাকা।
ফিচার ইমেজ: medium.com