ওং কার-ওয়াই: অন্য বিশ্বের অনন্য পরিচালক

নিয়মিত সিনেমা দেখলেও ওং কার-ওয়াই নামটা আপনার কাছে একদম নতুন লাগতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনি এতদিন হলিউডের গণ্ডিতেই আটকা পড়ে থাকেন। তবে তাকে আপনি দেখেছেন, অনুভবও করেছেন। না চিনলে কাউকে অনুভব করা তো দূরের কথা, দেখা যায়? হ্যাঁ, যায়।

২০১৭ সালের অস্কারের সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে বিজয়ী ব্যারি জেনকিন্সের ‘মুনলাইট’ কিংবা সোফিয়া কোপোলা পরিচালিত ‘লস্ট ইন ট্রান্সলেশন’- এই দুই চলচ্চিত্রের উপর একজনের প্রভাব রয়েছে; ওং কার-ওয়াই। গত ৩০ বছরে তিনি যত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তার কোনোটিতেই চিত্রনাট্যকে প্রাধান্য দেননি। চিত্রনাট্য তার জায়গামতো রয়েছে তবে সেটা নন-লিনিয়ার স্টাইলে।

ওং কার-ওয়াই; Image Source: Medium

নন-লিনিয়ার স্টোরিটেলিং তার চলচ্চিত্রের প্রধান বিষয় নয়। বরং, চারপাশের দৃশ্যায়ন, আবহসঙ্গীত, প্রতিদানহীন ভালোবাসা, নিয়ন আলো; এসবই হয়ে উঠেছে তার চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়। তার প্রায় সবগুলো চলচ্চিত্র হংকং কেন্দ্রিক। তবে, তার সমসাময়িক হংকংয়ের অন্যান্য পরিচালক থেকে তাকে যে বিষয়টি আলাদা করেছে, তা হচ্ছে তিনি একজন বহিরাগত মানুষের দৃষ্টিতে তার চলচ্চিত্রগুলোয় হংকংকে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া, তিনি নিজেকে একজন পরিচালক হিসেবে দেখতে নারাজ। নিজেকে তিনি বরং ক্যামেরার পেছনে থাকা একজন অডিয়েন্স মেম্বার হিসেবে দেখতেই স্বাছন্দ্যবোধ করেন।

তার জন্ম হয় তার সাংহাইয়ে, ১৯৫৮ সালে। পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মার সাথে হংকংয়ে চলে আসেন। কিন্ত, সেখানে প্রচলিত ক্যান্টোনিজ ভাষা না জানায় নতুন বন্ধু বানানো তো দূরের কথা, কারো সাথে ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারতেন না। তার মায়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমন সময় চলচ্চিত্র হয়ে উঠে মা-ছেলের জন্য আশ্রয়স্থল। 

ওং কার-ওয়াই পরে বলেন,

“চলচ্চিত্র এমন কিছু, যা বুঝতে ভাষার প্রয়োজন হয় না। চলচ্চিত্র নিজেই একটা বৈশ্বিক ভাষা, যা গড়ে উঠে অনেকগুলো ছবির সম্মিলনে।”

হংকংয়ের নিউ ওয়েভ সিনেমা ডানা মেলতে শুরু করে ১৯৭৯ সালে। পশ্চিম বিশ্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যান হুই, সুই হার্ক, প্যাট্রিক টামের মতো পরিচালকরা এমন সব চলচ্চিত্র বানাতে শুরু করেন, যা হংকংয়ের মূলধারার চলচ্চিত্রগুলো থেকে তাদের আলাদা করে, একটা নতুন পরিচয় পাইয়ে দেয়। ঠিক এ সময়ে একজন পরিচালক হিসেবে ওং কার-ওয়াইয়ের যাত্রা শুরু হয়। গ্রাফিক্স ডিজাইন বিষয়ে গ্র‍্যাজুয়েশনের পর ১৯৮১ সালে তিনি স্থানীয় ব্রডকাস্টার টিভিবি’র স্ক্রিপরাইটার ট্রেনিং স্কিমের জন্য সাইন করেন। এক বছর পর তিনি নিয়মিত চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করেন, যার মধ্যে একটি ছিল তার গুরু প্যাট্রিক টাম পরিচালিত ‘ফাইনাল ভিক্টরি’। এ সিনেমা তাকে ১৯৮৭ সালে ১৭তম হংকং ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসে সেরা চিত্রনাট্যকার বিভাগে মনোনয়ন এনে দেয়।

জন উ পরিচালিত ‘অ্যা বেটার টুমরো’ হংকংয়ে গ্যাংস্টার জনরাকে বক্স অফিসে হিট বানিয়ে দেয়। মুক্তি পাওয়ার দুই বছর পর, ১৯৮৮ সালে ‘অ্যাজ টিয়ারস গো বাই’-এর মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে ওংয়ের অভিষেক ঘটে। এই চলচ্চিত্রটিই ওংয়ের ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্রগুলোর ভিত গড়ে দেয়। প্লটনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের বদলে তিনি বরং ছবি ও মেজাজের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রগুলোয় গল্প বলায় মনোযোগ দেন। ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ডেইজ অভ বিয়িং ওয়াইল্ড’-এ তিনি প্রথমবারের মতো পূর্ণরূপে এই কারসাজি দেখান।

১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে হংকংয়ে বছরে প্রায় ২০০টির মতো সিনেমা মুক্তি পেত। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সফলতার জন্যই কেবল ওংকে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র বানাতে বাধ্য হতে হয়নি। তার ‘ডেইজ অভ বিয়িং ওয়াইল্ড’ বক্স অফিসে বাজেভাবে ফ্লপ করলেও সমালোচকরা চলচ্চিত্রটির খুব প্রশংসা করেন, যা তাকে ওই সময়ের অগ্রদূতদের একজন করে তোলে।

সিনেমাটোগ্রাফার ক্রিস্টোফার ডয়েল এবং আর্ট ডিরেক্টর উইলিয়াম চ্যাংকে সঙ্গে নিয়ে ওং একটি অনন্য ভিজুয়াল ল্যাংগুয়েজ ও অ্যাস্থেটিক বানান। তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোয় ছবি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে; সংলাপগুলোকেও যেন মনে হয় মুহূর্তের স্ন্যাপশট। ওংয়ের ক্ষেত্রে একটা অভিনব ব্যাপার হচ্ছে, তিনি স্ক্রিপ্ট না লিখেই শ্যুটিং করা শুরু করেন। স্ক্রিপ্ট লেখার আগে সর্বপ্রথম লোকেশনগুলো স্কাউট করেন। একইসাথে তিনি আবেগ সম্পর্কিত ও শারীরিক শূন্যস্থানের ধারণা নিয়ে গবেষণা করতে পছন্দ করেন। 

ষাটের দশক কিংবা আধুনিক নগর, যে পরিপ্রেক্ষিতেই তার চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হোক না কেন- তার প্রতিটি চলচ্চিত্র বৈশ্বিক। এর প্রমাণ হচ্ছে, আপনাকে তার চলচ্চিত্রগুলো উপভোগ করতে হংকংয়ের ইতিহাস কিংবা চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুই জানতে হবে না। কোনো না কোনো কারণে আপনার সেগুলো ভালো লাগবেই, হোক সেটা সিনেমাটোগ্রাফির জন্য, কিংবা হোক ব্যবহৃত গানের জন্য। তবে, তার চলচ্চিত্রগুলো পুরোপুরি বুঝতে হলে কিছুটা হলেও এর পেছনের ইতিহাস জানতে হবে অথবা গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করতে হবে। ‘চাংকিং এক্সপ্রেস’-এর কথাই ধরা যাক। প্রথম দেখায় এটাকে আর দশটা রোমান্টিক কমেডির মতোই মনে হতে পারে। তবে আসলে এটা যে নিজের পরিচয় ও দুশ্চিন্তার মতো জটিল বিষয়গুলো অন্বেষণ করেছে, তা বুঝতে হলে আগে চিন্তা করতে হবে।

চলুন এবারে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, ওং কার-ওয়াইয়ের অন্যতম পাঁচটি চলচ্চিত্র।

১. ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০)

কিছু চলচ্চিত্র রয়েছে, যা প্রত্যেকবার দেখার পর আপনি সেই চলচ্চিত্র সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পারেন কিংবা সেই চলচ্চিত্র আপনাকে প্রতিবার নতুন কিছু সম্পর্কে ভাবাতে বাধ্য করে। এটিও তেমনই একটি চলচ্চিত্র। আশ্চর্যজনক হলেও এটা সত্যি যে, ২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ রোমান্টিক জনরার হওয়া সত্ত্বেও এতে নেই কোনো চুমু খাওয়ার দৃশ্য কিংবা কোনো তথাকথিত ‘১৮+ দৃশ্য’।

‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ সিনেমার একটি দৃশ্য; Image Source: Senses of Cinema

ভালোবাসা বলতে আমরা সচরাচর অন্যান্য চলচ্চিত্রে যা দেখি, এখানে সেটা একদম ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে, শুধু ভালোবাসাই এর মূল বিষয় নয়। একাধারে স্মৃতি, হারানো সুযোগ, ট্যাবু, একাকিত্ব, সময়ের নিষ্ঠুরতা এ চলচ্চিত্রের থিম। মূল দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন টনি লিউং চিউ-ওয়াই এবং ম্যাগি চিউং। এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য টনি ২০০০ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান।

২. হ্যাপি টুগেদার (১৯৯৭)

‘হ্যাপি টুগেদার’ সিনেমার একটি দৃশ্য; Image Source: Asian Movie Pulse

গল্পটা দু’জন সমকামী পুরুষ ও দু’জনের মধ্যকার ভালোবাসা নিয়ে। প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ওং কার-ওয়াইয়ের নিয়মিত দুই কোলাবরেটার টনি লিউং ও লেজলি চিউং। আর্জেন্টিনা কতটা সুন্দর, ক্রিস্টোফার ডয়েলের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফিতে ফুটে উঠেছে। একটা সাধারণ গল্পের কতটা অসাধারণ উপস্থাপন হতে পারে, ওং কার-ওয়াই এ চলচ্চিত্রে সেটাই দেখিয়েছেন। এ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি কান উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান আর হংকং ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসে টনি লিউং লুফে নেন তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেরা অভিনেতার পুরস্কার।

৩. ফলেন অ্যাঞ্জেলস (১৯৯৫)

ওং কার-ওয়াইয়ের সবচেয়ে আবেগময় চলচ্চিত্র বোধকরি এটা। তিনজন অদ্ভুত মানুষকে নিয়ে তিনটি ভিন্ন গল্প এবং মাঝেমধ্যে এই তিনজনের একে অপরের জীবনে পদার্পণ, এ নিয়েই চলচ্চিত্রটি। আমরা মানুষেরা যে একদল অগোছালো বিশৃঙ্খল প্রাণী, সেটাই যেন সুনিপুণভাবে এখানে দেখানো হয়েছে।

নিয়ন আলোয় সজ্জিত হংকং; Image Source: Tumblr

মূল চরিত্র তিনটিতে অভিনয় করেছেন লিওন লাই, তাকেশি কানেশিরো ও মিশেল রেইস। নব্বই দশকে রাতের বেলা নিয়ন আলোয় হংকংকে কত সুন্দর লাগত, শুধু তা দেখার জন্য হলেও একবার এই চলচ্চিত্রটি দেখা উচিত। ‘ফলেন অ্যাঞ্জেলস’-এ থাকা একটি ভিডিও মন্টাজ যে কারো মন ভারাক্রান্ত করে তুলবে।

৪. ২০৪৬ (২০০৪)

‘২০৪৬’ সিনেমার একটি দৃশ্য; Image Source: BUF

‘ইন দ্যা মুড ফর লাভ’-এর সিক্যুয়াল এটি। মূল চরিত্রে যথারীতি টনি লিউং থাকলেও ম্যাগি চিউং শুধুমাত্র ক্যামিও রোলে ছিলেন। মূল চরিত্রে থাকা অন্যরা হলেন ঝ্যাং জিয়ি, ফেই ওয়াং। ‘২০৪৬’-এ অভিনয় করে হংকং ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসে টনি লিউং জিতে নেন তার পঞ্চম সেরা অভিনেতার পুরস্কার।

৫. চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪)

‘ফলেন অ্যাঞ্জেলস’-এর এক বছর আগে মুক্তি পেলেও এই দুই চলচ্চিত্রকে ওং কার-ওয়াই একটি চলচ্চিত্র হিসেবে দেখতে বলেছেন। মূল চরিত্রগুলোয় অভিনয় করেছেন টনি লিউং, ফেই ওয়াং, ব্রিজিট লিন ও তাকেশি কানেশিরো। এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য হংকং ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসে টনি লিউং জিতে নেন তার ক্যারিয়ারের প্রথম সেরা অভিনেতার পুরস্কার। কোয়েন্টিন টারান্টিনোর প্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর একটি ‘চাংকিং এক্সপ্রেস’।

‘চাংকিং এক্সপ্রেস’ সিনেমার একটি দৃশ্য; Image Source: Variety

বিবিসি’র করা ১০০টি সেরা বিদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায় ওং কার-ওয়াইয়ের তিনটি চলচ্চিত্র রয়েছে। ‘হ্যাপি টুগেদার’ ৭১ নম্বরে, ‘চাংকিং এক্সপ্রেস’ ৫৬ নম্বরে ও ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ ৯ নম্বরে। ২০১৬ সালে বিবিসির করা জরিপে বিংশ শতাব্দীর সেরা ১০০ চলচ্চিত্রের তালিকায় ‘ইন দ্যা মুড ফর লাভ’ দ্বিতীয় স্থান পায়।

Related Articles

Exit mobile version