জীবনের নানা ব্যস্ততার মাঝে ধরুন আপনি সুযোগ পেলেন একটু বিশ্রাম নেবার। কিছুদিনের জন্য অবকাশ যাপনের জন্য পরিবারসমেত বেড়াতে গেলেন অন্য কোনো দেশে। ভাবলেন, সময়টাও কাটলো, আবার নতুন একটা জায়গাও ঘোরা হলো।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এমনই এক সময়ে সুনামির আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সবকিছু। প্রিয়জনের কাছ থেকে আপনি বিচ্ছিন্ন, অচেনা এক জায়গায় চিরচেনা জীবনটা তছনছ হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যেই!
কী করবেন আপনি?
এমনই একটি গল্প নিয়ে নির্মিত ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘দ্য ইম্পসিবল‘। জুয়ান অ্যান্টোনিও গার্সিয়া বেয়োনা কর্তৃক পরিচালিত এবং সের্গিও জি. সানচেজের চিত্রনাট্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় এই ডিজাস্টার ড্রামা সিনেমাটি। চলচ্চিত্রটি ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের সুনামির সময় মারিয়া বেলন এবং তার পরিবারের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এই সুনামিতে প্রায় ২,২৭,৮৮৯ জন প্রাণ মানুষ হারায়।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন নাওমি ওয়াটস, ইওয়ান ম্যাকগ্রেগর, টম হল্যান্ড প্রমুখ।
ডিসেম্বর, ২০০৪।
মারিয়া বেনেট (নাওমি ওয়াটস) এবং তার স্বামী হেনরি বেনেট (ইওয়ান ম্যাকগ্রেগর) সপরিবারে এসেছেন থাইল্যান্ডে তাদের বড়দিনের ছুটি কাটাতে। মারিয়াদের তিন সন্তান- লুকাস (টম হল্যান্ড), থমাস (সাইমন জসলিং) এবং সাইমন (ওওক্লি পেন্ডারগ্যাস্ট)।
থাইল্যান্ডের খাও লাকের সম্প্রতি উদ্বোধন করা অর্কিড বিচ রিসোর্টে অবকাশ যাপনে এসেছে তারা। আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতোই তাদের জীবন। থাইল্যান্ডের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া, বড়দিনে একে অন্যকে উপহার দেয়ার পাশাপাশি ছুটিতেও নিজেদের চাকরি নিয়ে চিন্তিত থাকা- খুবই সাধারণ মানুষ তারা।
সিনেমার প্রথম অংশেই জানা যায়, হেনরির চাকরির সুবাদে মারিয়ারা জাপানে থাকেন। চিকিৎসক মারিয়া তার ছেলেদের দেখাশোনা করার জন্য চাকরিতে বিরতি নিয়েছেন। কিন্তু খোদ হেনরির চাকরি যখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে, তখন মারিয়া পুনরায় চিকিৎসক হিসেবে ফিরে যাবার প্রস্তাব তোলেন।
ছুটির মাঝে জীবিকার চিন্তা শান্তিতে ব্যাঘাত আনলেও দুজনই চেষ্টা করেন তা ভুলতে, রিসোর্টের সুইমিং পুলে ছেলেদের সাথে সময় কাটাতে। বাবার সাথে খেলার ফাঁকে বল গড়িয়ে পুলের বাইরে চলে গেলে তা নিতে পা বাড়ায় দশ বছর বয়সী লুকাস। মারিয়া তখন বই পড়তে ব্যস্ত। এমন সময় দমকা হাওয়ায় মারিয়ার বইয়ের পৃষ্ঠা উড়ে যায়। কাচের দেয়ালে আটকে যাওয়া সেই পৃষ্ঠা তুলতে গিয়ে মারিয়া লক্ষ্য করেন, দেয়ালটা কাঁপছে। আকাশে পাখিরা উল্টোদিকে পালিয়ে যাচ্ছে।
বড় ছেলে লুকাস বল হাতে দাঁড়িয়ে দেখতে পায়, অদূর সমুদ্র থেকে বিশাল ঢেউ ধেয়ে আসছে তাদেরই দিকে। কেউ কিছু বোঝার আগেই সুনামির আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় বাড়ি-ঘর, ভেসে যায় মানুষজন। স্রোতের ধাক্কায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বেনেট পরিবার; একদিকে হেনরি আর তার ছোট দুই ছেলে, অন্যদিকে মারিয়া ও লুকাস।
সুনামির ভয়াবহতা থেকেও ভয়ংকর বিষয় হলো এতে বিচ্ছেদের বিভীষিকা। কল্পনা করুন, এমন এক দুর্যোগের সময় আপনি আপনার পরিবারের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। আপনার সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্নটা বাস্তবে পরিণত হয়েছে!
বেনেট পরিবারের গল্পটাও সেরকম। গোটা চলচ্চিত্রটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বেনেট পরিবারের দুটো অংশের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। একদিকে হেনরি, যে কি না ছোট দুই ছেলেকে নিরাপদ স্থানে পাঠাতে অপরের হাতে তুলে দিয়ে ধ্বংসস্তূপের মাঝে উদভ্রান্তের মতো খুঁজে যাচ্ছে তার স্ত্রী এবং বড় ছেলেকে। অন্যদিকে মারিয়া ও লুকাস, যারা এক অর্থে চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সুনামির আঘাতে বিচ্ছিন্ন হবার পর এই মা-ছেলে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে এক ভেঙে পড়া গাছের উপর। স্রোতে ভেসে আসা ডালে গেঁথে পা এবং বুকে আঘাত পায় মারিয়া। ক্লান্ত, আহত মাকে নিজের কাঁধে নিয়ে এবার মায়ের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় দশ বছরের লুকাস। স্রোত থেকে বাঁচতে মা এবং ভেসে আসা আরেক শিশুকে নিয়ে গাছে ওঠে সে।
এমন সময় স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে তাদের। মানবতার টানে একটি ভাঙা দরজার উপর মারিয়াকে শুইয়ে হাসপাতাল অব্দি নিয়ে যায় তারা। সেখানে লুকাস দেখে তাদের মতো শত শত মানুষ এসেছে, সুনামির আঘাতে আহত। এ সময় মুমূর্ষু অবস্থায় মারিয়া লুকাসকে হাসপাতালের অন্যদের সাহায্য করতে বলে।
মায়ের আদেশে লুকাস হাসপাতালের করিডোরে ঘুরতে থাকে, হাতে একটি কাগজ আর পেন্সিল। উদ্দেশ্য, মানুষকে তার স্বজনদের খুঁজে বের করতে সাহায্য করা। হাসপাতালের প্রতিটি রুমে, করিডোরে লুকাস যায় আর তার হাতের নামের লিস্ট আওরাতে থাকে। নানা ভাষার, নানা জাতির নাম।
লুকাসের সহযোগিতায় একসময় এক বাবা খুঁজে পান তার ছেলেকে। মাকে এই খুশির সংবাদ জানাতে ছুটে যায় লুকাস। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম রসিকতার শিকার হয় সে আবারও। তারপর?
বেনেট পরিবারের ভাগ্যের পরিণতি জানতে আপনাকে দেখতে হবে ‘দ্য ইম্পসিবল’। পরিচালক বেয়োনা এবং সানচেজ বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে কিছু পরিবর্তন এনেছেন। আসল বেলন পরিবার ছিল স্প্যানিশ, কিন্তু চলচ্চিত্রের বেনেটরা ইংরেজ। চলচ্চিত্রে সুনামির আঘাতের দৃশ্যায়ন ছিল যেমন চমৎকার, তেমনই ভয়ানক। পরিচালক সুনামির ভয়াবহতা এবং ক্ষয়ক্ষতি পর্দায় প্রদর্শন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। গাছের উপর আশ্রয় নেয়া মানুষের আর্তনাদ কিংবা সারি সারি লাশের মাঝে আপনজনকে খুঁজে বের করার বিভীষিকা- সবই পর্দায় এনেছেন বেয়োনা। তবে চলচ্চিত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বেদনার অনুপস্থিতির কারণে সমালোচিত হয়েছিল তা।
কিন্তু সবকিছুর উপর পারিবারিক বন্ধন এবং ধ্বংসের মাঝে জীবনের জয়গান ছিল চলচ্চিত্রের মূল প্রতিপাদ্য। সমালোচকদের কাছে বেশ প্রশংসা পায় এই ডিজাস্টার ড্রামা জঁনরার সিনেমাটি।
স্প্যানিশ ফিল্ম কোম্পানির সাথে সম্মিলিত উদ্যোগে নির্মিত সিনেমাটির চিত্রায়ণ শুরু হয় ২০১০ সালে, প্রায় দুই বছরে এর কাজ শেষ হয়। চলচ্চিত্রে মারিয়া বেনেটের ভূমিকায় নাওমি ওয়াটসের অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়। একজন ক্লান্ত, আহত এবং ভীত মানুষ হিসেবে মারিয়াকে দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না যে, তিনি নাওমি ওয়াটস।
হেনরি বেনেটের চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন ইয়ান ম্যাকগ্রেগর। অন্যের কাছ থেকে ফোন ধার নিয়ে স্ত্রীর বাবার কাছে স্ত্রী-পুত্রকে হারানোর সংবাদ দিতে গিয়ে হেনরির ভেঙে পড়াকে দেখলে মনে হবে যেন একজন শিশু সব হারিয়ে কাঁদছে। ভীত কিন্তু দায়িত্ববান লুকাসের ভূমিকায় ভবিষ্যতে স্পাইডারম্যান খ্যাত টম হল্যান্ডের অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। নিজের অভিনয়শৈলীর প্রমাণ তিনি দেখিয়েছেন বেশ অল্প বয়সেই।
২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া দ্য ইম্পসিবল ছবিটি বক্স অফিসে সাফল্য লাভ করে, প্রথম সপ্তাহে আয় করে নেয় প্রায় ১১.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলচ্চিত্রটি বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় এবং জয়লাভ করে। এ ছবির জন্য নাওমি ওয়াটস অস্কারের জন্য মনোনীত হন, অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হন তিনি এবং টম হল্যান্ড। ক্যাপ্রি আওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব, হলিউড ফিল্ম ফেস্টিভালসহ বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করে এটি।
প্রিয়জন পাশে থাকলে, তা পরিবার হোক বা বন্ধু, অনেক সময় শত বিপর্যয়কেও কাটিয়ে ওঠা যায়। প্রায় ২ ঘণ্টার এই চলচ্চিত্রটি আপনার মস্তিষ্কে আন্দোলন তুলবেই। ‘দ্য ইম্পসিবল’ বা স্প্যানিশে ‘লো ইম্পোসিবল’ (Lo Imposible) এক বাস্তব অসম্ভবকে জয় করার গল্প। এটি একটি পরিবারের গল্প, এটি বন্ধনের গল্প, এটি জীবনের জয়গানের গল্প।
চলচ্চিত্রের ট্রেলার