সিনেমার নামটা ‘চোকড’ কেন, তা নির্দিষ্টভাবে বোঝা যায় না সিনেমা শেষ করা সত্ত্বেও, অনেকগুলো কারণ থাকার জন্য। ‘চোকড’ (Choked) শব্দের অর্থ রুদ্ধ হয়ে আসা, বিশেষ করে টুঁটি চেপে আসা। কেউ যখন গলা চেপে ধরে, তখনই এ অনুভূতির অবকাশ ঘটে। সিনেমার মূল চরিত্র সারিতা মঞ্চের সামনে উপবিষ্ট অনেক অনেক দর্শকের সামনে গান গাইতে পারে না, গাইতে গেলে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। হয়তো এ কারণে সিনেমার নাম ‘চোকড’।
আবার সারিতাদের রান্নাঘরের সিঙ্কের নিচে পাইপটি পানির সাথে সাথে পলিথিনে মোড়ানো টাকার রোলে ভরে যাচ্ছে হঠাৎ করেই। এটিও এমন নামের একটা কারণ হতে পারে। নাকি ২০১৬ সালে মোদি সরকারের নেওয়া নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত যে মধ্যবিত্ত পরিবারের নিঃশ্বাস চেপে দেবার উপক্রম করেছিল, তার জন্যই এ নাম? তবে পরিচালকের যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে পাক্কা দু ঘণ্টা তিনি একটি চাপা উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তা দিয়ে দর্শকের দম আটকে রাখবেন, তাহলে বলতেই হয় নামকরণটি যথার্থ।
সিনেমা শুরু হয় একটা দুর্দান্ত দৃশ্য দিয়ে। সারিতাদেরই ভবনের এক ফ্ল্যাটে কেউ একজন অব্যবহৃত বাথরুমের সিঙ্কের ভেতর টাকার অনেকগুলো বাণ্ডিল জমা করতে শুরু করে। দৃশ্য জুড়ে মানুষটা কে বোঝা যায় না, তবে তার ব্রিফকেস ভর্তি টাকা। ক্যামেরা ঢুকে পড়ে সেই টাকার রোলে ভর্তি সিঙ্কের ভেতরে, সেখান থেকে ক্যামেরা চলে যায় আলো ঝলমলে এক ডিস্কো লাইটের উপর। ডিস্কো লাইটে ক্যামেরা আর ব্যাকগ্রাউন্ড বলিউডের ক্লাসিক মিউজিক বাজতে থাকে, আর এর পরপরই আমরা সরাসরি ঢুকে পড়ি সারিতার জীবনে; তার স্বামী সুশান্ত আর ছেলে সমিরকে নিয়ে, তাদের ছোটোখাটো ভাড়া বাসায়। উপরোক্ত দুই দৃশ্যই পরবর্তী সময়ে সিনেমা জুড়ে প্রকট হয়, মূল প্লটের খাতিরেই।
মুম্বাইয়ের ব্যস্ত নগরীতে সারিতা কাজ করে সরকারি এক ব্যাংকের ক্যাশিয়ার হিসেবে। স্বামী এ মুহূর্তে বেকার, চেয়েছিল গানের জগতে ক্যারিয়ার গড়তে। কিন্তু স্বপ্নের নগরীতে ক’জনের স্বপ্নই বা আর সত্যি হয়! তাই ফি বছর চাকরি ধরছে আর ছাড়ছে, থিতু হতে পারছে না কোথাও। সারিতার একার বেতনে সংসারেও টানাটানি চলছে প্রতিনিয়ত। ভালোবাসার সংসারে হানা দিয়েছে টাকা, দু’জনের কথোপকথনে ভালোবাসা আলাপের বদলে জায়গা করে নিয়েছে টাকা, টাকা আর টাকা। বাড়ছে দ্বন্দ্ব, দিনের পর দিন ঝগড়াও।
সবকিছু দেখতে দেখতে সারিতা যখন চূড়ান্তরূপে হাঁপিয়ে উঠেছিল, মাঝরাতে আর ঘুমুতে পারছিল না, তখনই হঠাৎ দৈব উপহারের মতো রান্নাঘরে সিঙ্কের নিচের জমে থাকা ময়লা পানির সাথে উঠে আসে দু বাণ্ডিল টাকা! রাতের আঁধারে টর্চ জ্বালিয়ে অবিশ্বাসের সাথে সারিতা টাকাগুলো গুনে দেখে। পরেরদিন ব্যাংকে গিয়ে ভালোমতো যাচাই করে দেখে, ওগুলো আসল কি না। আসল বুঝতে পেরে তার চোখেমুখে ভেসে ওঠে খুশির ঝিলিক। পরদিন একই সময়ে আবার পানির সাথে ভেসে উঠল আরো ক বাণ্ডিল। সবার অলক্ষ্যে পাওয়া টাকার বরাতে সারিতা আবার নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনতে শুরু করে। তবে তার কল্পনায় ছিল না, তার দেখা নতুন স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে এক অকল্পনীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে ভেঙে যেতে পারে।
২০১৬ সালে মোদি সরকারের নেওয়া ৫০০ আর ১০০০ রুপির নোট বাতিলের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তার নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগণের উপর যে প্রভাব পড়েছিল, তার একটা আংশিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এ সিনেমায়। মূল প্লট হিসেবে না হলেও অনেকটা সাবপ্লট হিসেবে ঐ বিষয়টিকে পর্দায় আনার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই মোদিকে ঐ সিদ্ধান্তের জন্যে তখন নায়কের আসীনে বসিয়েছিলেন। সিনেমাতেও দৃশ্যগুলো এসেছে যে তখন মোদিকে কীরকম বাহবা দেয়া হয়েছিলো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার জন্যে।
অনেকেরই আশা জেগেছিল এই ভেবে যে নিম্ন-মধ্যবিত্তের সুদিন আসবে। কিন্তু আদতে কতটা কার্যকরী হয়েছে সে সিদ্ধান্ত, সে বিষয়ে মন্তব্য বর্তমান সময়ের অর্থনীতিবিদরাই দিয়েছেন। বিরোধীদের মতে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের বলির পাঁঠা হতে হয়েছিল অনেক নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর দরিদ্র পরিবারকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাঘব বোয়ালরা কিন্তু ঠিকই মোটাদাগে আড়ালে রয়ে গেছে বেলাশেষে, কারণ বাজারের ৫০০ আর ১০০০-এর নোট সিংহভাগই ব্যাঙ্কে ফেরত চলে এসেছে। কিন্ত যারা দিনে এনে দিনে খায়, কিংবা জীবিকা নির্বাহ করে প্রতিদিনকার কাজকারবারে, তাদের উপর রীতিমতো ঝড় বয়ে গিয়েছিল ঐ সময়টাতে। আর যখন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে সিনেমা বানালেন কাশ্যপ, তখন রীতিমতো ভারতীয় দর্শকদের রোষানলে পড়লেন তিনি। শুনতে হলো প্রোপাগান্ডার আরোপ, ‘গুগল’ করলে দেখতে পাবেন রেটিংয়েরও বেহাল অবস্থা। অথচ সিনেমার মূল লক্ষ্য যেটা ছিল, তা অনেকেরই অলক্ষ্যে রয়ে গেল।
আদতে ‘চোকড’ একপ্রকারে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের স্যাটায়ারই ছিল। নোট বাতিলের কারণে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, আবার অনেক নতুন নতুন ক্যাশলেস পেমেন্ট সিস্টেমের উত্থান হয়েছে। সিনেমা জুড়ে ঐ ব্যাপারগুলোকেও খোঁচা মারার কমতি করা হয়নি। তবে এসব কারণে যারা সিনেমাকে রাজনৈতিক দোষে দোষী বলছেন, তাদের জন্য কাশ্যপ জবাব দিয়েছেন এই বলে যে, পরিচালকের রাজনৈতিক দর্শন আর সিনেমার চরিত্রের দর্শন এক হওয়া জরুরি নয়। বরঞ্চ নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হয়েছিল, তখন তিনি নিজেই সাধুবাদ জানিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ছাড়াও ‘চোকড’ একটি স্বতন্ত্র সিনেমা, যার গল্প বলা হয়েছে সারিতার দৃষ্টিকোণ থেকে। সেখানে ঐ সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিজীবনে কী প্রভাব ফেলেছে, সেটা দেখানো হয়েছে। টাকা পাওয়ার ঘটনার প্রভাব সারিতার জীবন থেকে একসময় উবে যায়, ঠিক যেমন জনগণের বাস্তব জীবন থেকে একসময় উবে যায় নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রভাব।
টেকনিক্যাল দিক থেকে সিনেমাটা দুর্দান্ত, যা কাশ্যপ থেকে অনুমিতই। শুরুর দিকে টাইটেল দেখানোর সময় অরিজিনাল স্কোরের সাথে একজনকে ড্রাম বিটের ক্রেডিটও দেয়া হলো। কেন দেয়া হলো, তা অবশ্য একটু পরেই পরিষ্কার হলো। পুরো সিনেমার শুরু থেকেই ক্রমাগত ড্রামের বিট ব্যবহৃত হয়েছে দৃশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। ২০১৫ সালের অস্কারজয়ী সিনেমা ‘বার্ডম্যান’ যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে থাকব সিনেমা জুড়ে ড্রামের বিট কীভাবে পুরো অভিজ্ঞতাকে অন্য একটা ধাপে নিয়ে যেতে পারে।
বিশেষ ধরনের আবহসঙ্গীত ব্যবহারের কারণে শুরু থেকেই একটা অন্যরকম ভাব এসেছিল সিনেমা থেকে। সিনেমাতে কমেডি দৃশ্যেরও কমতি ছিল না, যেখানে গানের বাছাই বেশ ভালোভাবে কাজে এসেছে। সিনেমাটোগ্রাফিও নজর কাড়া, বিশেষ করে টাকার রোলগুলো বাঁধার সময় দু মিনিটের একটা ট্রেকিং শট বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। সিনেমার সম্পাদনাও প্রশংসনীয়।
সিনেমার মূল চরিত্র সারিতার ভূমিকায় সাইয়ামি খের দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তার চোখেমুখে সারাক্ষণ একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করতে, যা তার চেহারায় ফুটে উঠেছে। চিন্তায় আর অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে তার চোখের নিচে কালি জমে গেছে, যা সিনেমার প্লটকে করে তুলেছিল তার চরিত্রের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। সংসারের ভার, অনাকাঙ্ক্ষিত টাকার ভারে নুয়ে পড়া ব্যাংক ক্যাশিয়ারের চরিত্রে দ্যুতি ছড়িয়েছেন নবাগতা সাইয়ামি। সাথে সিনেমা জুড়ে চমৎকার সহযোগিতা দিয়েছেন সুশান্ত চরিত্রে রোশান ম্যাথিউ। তামিল সিনেমায় নিয়মিত হলেও প্রথম হিন্দি ফিচারে স্বচ্ছন্দ পারফর্ম করেছেন তিনি। সাথের অন্য চরিত্ররাও পূর্ণাঙ্গ সহায়তা দিয়ে গেছেন।
এই সিনেমা দেখতে বসলে চিরাচরিত অনুরাগ কাশ্যপ পাবে না দর্শক; কারণ, এখানে রক্তারক্তি, খুনখারাবি নেই। গালিগালাজও হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সরকারের নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে সাধারণ পরিবারের মাঝে ঝড় বইয়ে দিতে পারে, তারই একটা গল্প কিছু রূপকার্থে তুলে ধরা হয়েছে। সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত টাকা আসার ঘটনাটিকে ব্যবহার করা হয়েছে একটা দারুণ সাসপেন্সের প্লট হিসেবে। তবে হ্যাঁ, শেষদিকে একটু তাড়াহুড়ো হয়েছে, সেটা মানা যায় এবং কিছুটা অদ্ভুত আর প্যাঁচানোও হয়ে গিয়েছিল বটে। কিন্তু এ বিষয়টি একপাশে রাখলে সর্বোপরি সিনেমা হিসেবে ‘চোকড’ গুরুত্বপূর্ণ। সিনেপ্রেমী যে কারো জন্যেই একটা ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা হতে পারে ‘চোকড’।