মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের (MCU) আজ প্রায় ১১ বছর হতে চলল। অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিন মারভেল কেভিন ফাইগিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে তাদের নতুন সিনেমাটিক ইউনিভার্সের রূপরেখা প্রকাশ করেছিল। তখন কেউই হয়তো ভাবেনি তারা এতদূর আসতে পারবে। এক্স-মেন আর ফ্যান্টাস্টিক ফোরে’র চরিত্রগুলো ছাড়া, এখন পর্যন্ত মারভেলের অসংখ্য চরিত্রের দেখা মিলেছে MCU-তে। গত বছর তো স্পাইডার-ম্যানকেও ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে সনির এন্টারটেইনমেন্টের কাছ থেকে।
শুধু যে পরিচিত চরিত্রগুলোর আগমন ঘটেছে তা কিন্তু না। সেই ২০০৮ সালের তাদের প্রথম সিনেমা থেকে শুরু করে মারভেল এই সিনেমাটিক ইউনিভার্সকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে যে, আদৌ অন্য কোনো ফ্রাঞ্চাইজ সে উচ্চতায় পৌছতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। তাদেরই এই সাফল্যে মুগ্ধ দর্শক-ভক্ত-সমালোচক সবাই। আর আমাদের আজকের লেখায় অল্প বিস্তর আলোচনা করবো মারভেলের এই সিনেমাটিক ইউনিভার্সর প্রথম পর্বের ছয়টি সিনেমা সম্পর্কে।
আয়রন ম্যান
অভিনেতা রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে যখন আয়রন ম্যান তথা টনি স্টার্ক চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে কাস্ট করা হয়েছিল, তখন অনেকেই সেটাকে নেহায়েত বোকামি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের খুবই মন্থর একটা সময় পার করছিলেন রবার্ট। তবে পরিচালক জন ফেবারু টনি স্টার্ক হিসেবে রবার্টকে বেছে নিয়েছিলেন এক বিশেষ কারণে। রবার্টের জীবনের সবচেয়ে ভাল কিংবা খারাপ দুই অবস্থার কোনোটাই দর্শক আর ভক্তদের অজানা নেই। অল্প বয়সেই অ্যালকোহল আর ড্রাগে আসক্ত হয়ে যাওয়ার পর প্রথম জীবনে তাকে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল। ড্রাগ পুনর্বাসন থেকে ফিরে আসার পর সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তিনি তার ক্যারিয়ারে ব্যালেন্স নিয়ে এসেছিলেন, রূপকার্থে অনেকটা টনি স্টার্কের জীবনের মতই। আর সেই ব্যাপারটাই পরিচালক ফেবারুর মনে ধরেছিল।
হয়তো রবার্ট ডাউনির কাছে এভাবে ফ্রাঞ্চাইজের প্রথম সিনেমা, তার উপর টনি স্টার্কের মত চরিত্র তুলে দেওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। আর সেই ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপেই হয়েছিল মারভেলের সাফল্যের অবতার। রবার্টের কাস্টিং নিয়ে গুঞ্জন তোলা সেইসব সন্দেহভাজনদের চুপ করিয়ে দিয়ে সেই সিনেমাটি বক্স অফিসে বয়ে এনেছিল বিরাট সাফল্য। তার অভিনয়ে মুগ্ধ দর্শক-ভক্ত-সমালোচক সকলেই। সিনেমাটি প্রমাণ করে দিয়েছিল একটি সুপারহিরো চরিত্রের প্রথম সিনেমার সাফল্যের জন্য সুপারম্যানের সমান জনপ্রিয়তার প্রয়োজন হয় না। ১৪০ মিলিয়ন ডলারের বাজেটের সিনেমাটি বক্স অফিসে আয় করেছিল প্রায় ৫৮২.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সবচেয়ে বড় কথা হল, এই সিনেমা টনি স্টার্কের চমৎকার এক অরিজিন স্টোরি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এর পাশাপাশি মারভেলের সিনেমাটিক ইউনিভার্সের প্রথমার্ধের খেলাকে (ফেজ- ওয়ান) দিয়েছিল দুর্দান্ত এক সূচনা।
দ্য ইনক্রিডিবল হাল্ক
প্রথম ফেজের দ্বিতীয় সিনেমা হিসেবে মারভেল বেছে নিয়েছিল হাল্কের চরিত্রকে। তবে আয়রন ম্যানের মত, সেই হাল্ক সিনেমাটি কোনো অরিজিন স্টোরি ছিল না। এতে তুলে ধরা হয়েছিল ড. ব্যানারের হাল্ক হওয়ার কিছুদিন পরের কাহিনী। ব্রুস ব্যানার গামা রেডিয়েশন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে সম্মুখীন হওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছিল সিনেমাটি।
কিন্তু সমস্যা হলো, মারভেল গত ১১ বছরে এমন সব সিনেমা উপহার দিয়েছে যে দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক সিনেমাটি সেই তালিকা অনেকটা বেমানান বলা চলে। প্রথমত সিনেমাতে ব্রুস ব্যানার হিসেবে অভিনেতা নর্টন বেশ ভাল অভিনয় করলেও হাল্ক হিসেবে ততোটা প্রত্যয়জনক ছিলেন না, যতোটা ভক্তরা আশা করেছিল। আর সে কারণেই এড নর্টন এই যুগের অসাধারণ অভিনেতাদের একজন হওয়া সত্ত্বেও হাল্ক হিসেবে ভক্তদের মনে জায়গা করে নিতে পারেননি। তাছাড়া সিনেমাটির চিত্রনাট্য বেশ দুর্বল ছিল। আর সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমা হিসেবে এটি ছিল খানিকটা বেসুরা ও হতাশজনক। দর্শক-সমালোচক কারোরই মন জোগাতে অক্ষম সেই সিনেমাটি বক্স অফিসেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ১৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের পরিপ্রেক্ষিতে সিনেমাটির মোট আয় মাত্র ২৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আয়রনম্যান টু
২০১০ সালে মুক্তি পায় MCUএর তৃতীয় ও আয়রন ম্যানের দ্বিতীয় সিনেমা আয়রন ম্যান টু। এই সিনেমার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, এক সিনেমাতেই অনেক কিছু করার প্রচেষ্টা। হয়তো প্রথম সিনেমার তুলনায় এর প্লট এবং ভিলেন দুটোই বেশ দুর্বল ছিল। তবে এর মাধ্যমে এই ইউনিভার্স নিয়ে মারভেলের বৃহৎ পরিকল্পনার ব্যাপারটি বেশ পরিষ্কার হয়ে আসে।
তাছাড়া এই সিনেমাতেই টনি স্টার্কের ‘বেস্ট পাল’ জেমস রোডি ওয়ারমেশিনের ম্যান্টল তুলে নেয় এবং প্রথমবারের মতো দেখা মিলে ব্ল্যাক উইডো নাতাশা রমানফের। আয়রন ম্যান টু সিনেমার জন্যে বাজেট ছিল ২০০ মিলিয়ন ডলার এবং সিনেমাটি বক্স অফিসে আয় করেছিল ৬২৩.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
থর
আয়রন ম্যান ২ এর পর মারভেলের চোখ যায় ভূমণ্ডলের বাইরে। প্রথমবারের মতো তাদের অমনিবাসে আগমন ঘটে নর্স পুরাণের দেবতা অডিন, থর ও লকিদের। যদিও এই সিনেমাটির কাহিনী হিসেবে থরের অরিজিনকে প্রাধান্য দেয়া হয়, তবে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকে এলিয়েন ও দেবতাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। আর সিনেমার কাহিনী এতটা আহামরি কিছু ছিল না। তবে ইউনিভার্সের জন্যে পরবর্তী অ্যাভেঞ্জারস সিনেমার জন্যে চমৎকার একটি রাস্তা তৈরি করে দেয়। এতে দেখা মেলে অ্যাভেঞ্জার্সদের আরেক সদস্য হক আইয়ের এবং ছয় ইনফিনিটি স্টোনের একটির।
সিনেমায় থর হিসেবে নিয়ে আসা হয় অখ্যাত এক অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা ক্রিস হেমসওয়ার্থকে। এছাড়াও তার সাথে অভিনয় করেছেন প্রখ্যাত অভিনেতা অ্যান্থনি হপকিন্স, টম হিডলস্টন ও সবার পছন্দের অভিনেত্রী নাটালি পোর্টম্যান প্রমুখ। মজার ব্যাপার হল, শুটিং সেটে যখন ক্রিস আর হপকিন্স তাদের বর্ম পরে পরস্পরের মুখোমুখি হন তখন হপকিন্স অস্ফুটে বলে উঠেন, “ঈশ্বর! এই পোশাক পরার পর মনে হয় না আমাদের অভিনয় করার কোন প্রয়োজন আছে”। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১১ সালে। কমিকসভক্ত ছাড়াও সাধারণ দর্শক ও সমালোচক মহলে সমানভাবে সমাদৃত হয়েছিল সিনেমাটি। এর বাজেট ছিল ১৫০ মিলিয়ন ডলার এবং বক্স অফিসে আয় করেছিল প্রায় ৪৫০ মিলিয়িন ডলার।
ক্যাপ্টেন আমেরিকা: ফার্স্ট অ্যাভেঞ্জারস
২০০৮ থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত মোট চারটি সিনেমার পর এবারে পালা আসে, ইউনিভার্সে প্রথম অ্যাভেঞ্জারস ক্যাপ্টেন আমেরিকার। পূর্ববর্তী ফ্যান্টাস্টিক ফোরের হিউম্যান টর্চের অভিনেতা ক্রিস ইভান্সকে নিয়ে মারভেল সাজায় ক্যাপ্টেন আমেরিকার অরিজিন স্টোরি। ক্রিস ইভান্সের পর্দায় প্রথম আগমন ছিল দুর্দান্ত। আর এর মধ্য দিয়ে দর্শকরা পরিচিত হন বীরপুরুষ স্টিভ রজার্সের সাথে।
এছাড়াও সিনেমায় দেখা মিলে তার বন্ধু বাকি বার্নস, পেগি কার্টার ও মারভেল কমিকসের এক ভয়ংকর ভিলেন রেড স্কালের ও তার গোপন সংঘের সাথে। বিশেষ করে রেড স্কালের সেই গোপন সঙ্ঘ তথা হাইড্রা পরবর্তীতে অমনিবাসের মূল গল্পে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
২০১১ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি সমালোচকদের প্রশংসার পাশাপাশি বক্স অফিসে আয় করে নিয়েছিল প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মজার ব্যাপার হল ক্যাপ্টেন আমেরিকা চরিত্রটি ক্রিস ইভান্সের অভিনয় জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিলেও তিনি প্রথমে সিনেমায় অভিনয়ই করতে রাজী হননি। তিনবার করে প্রত্যাখ্যান করার পর শেষে রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের অনুরোধে তিনি চরিত্রটি নিতে সম্মতি জানান। আর দুঃখের ব্যাপার হল, এই সিনেমায় ক্যামিও হিসেবে হাজির হওয়ার কথা ছিল উলভারিন ও ম্যাগনিটোর। কিন্তু এই চরিত্রদুটির স্বত্ত্ব ফক্স স্টুডিওর কাছে থাকার কারণে, সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি।
দ্য অ্যাভেঞ্জারস
দীর্ঘ চার বছরে মোট ৫টি সিনেমা দিয়ে বেশ কিছু চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর ২০১২ সালে পর্দা ওঠে মারভেলের প্রথম পর্বের শেষ ও বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা দ্য অ্যাভেঞ্জারসের। গত দুই সিনেমায় দেখানো মাইন্ড স্টোন ও টেসেরাক্টের সাহায্যে লকি আক্রমণ করে পৃথিবীতে। আর তার হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে শিল্ডের ডিরেক্টর নিক ফিউরি অ্যাভেঞ্জারসদের সমবেত করে। কমিকস ভক্তদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন অ্যাভেঞ্জারসদের একসাথে দেখার। এই সিনেমার মাধ্যমে সেই স্বপ্ন বেশ সফলতার সাথেই পূরণ হয়। তাছাড়া এভাবে ক্যাপ্টেন আমেরিকা, আয়রন ম্যান, থর আর হাল্কদের নিজস্ব আলাদা সিনেমায় দেখার পর এভাবে একসাথে দেখার ব্যাপারটি ভক্ত থেকে শুরু করে দর্শকদেরও দেয় এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
এই সিনেমার মূল উদ্দেশ্যই ছিল পরবর্তী আক্রমণ থেকে পৃথিবীর রক্ষার্থে অ্যাভেঞ্জারদের প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের ইউনিভার্সটি আরও বিস্তৃত করে দেয়া, যা পরিচালক জশ হেডন তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। সিনেমার অন্যতম বড় আকর্ষণ ছিল হাল্ক। এই সিনেমার মাধ্যমে মারভেল হাল্ক চরিত্রে ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাদের প্রথম পছন্দ মার্ক রোফালোকে। দ্য ইনক্রিডেবল হাল্ক দিনেমার জন্যে পরিচালক লুইস লেটেরিয়ার প্রথম চেয়েছিলেন মার্ক রোফালোকেই। কিন্তু তার শিডিউলজনিত জটিলতার কারণে তিনি বাধ্য হয়েই এড নর্টনকে কাস্ট করেন। নর্টনের হাল্ককে সেভাবে মনে না ধরলেও মার্ক রাফালোর হাল্ক ও ব্রুস ব্যানার দুটোই ভক্তদের মুখে ফোটায় পরিতৃপ্তির হাসি।
মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের প্রথম পর্বের শেষ সিনেমা হিসেবে দ্য অ্যাভেঞ্জারস মুক্তি পেয়েছিল ২০১২ সালের আগস্ট মাসে। ভক্ত-দর্শক-সমালোচকদের বিপুল প্রশংসাতো ছিলই, এর পাশাপাশি সিনেমাটি বক্স অফিসে আয় করে নেয় প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!