মাটির নিচে অন্ধকার এক কারাগার। নাম তার শ্যাতুদ্যফ। ফ্রান্সের সবচাইতে ভয়ংকর কারাগার। সূর্যের আলোর সামান্যটুকুও যেখানে প্রবেশ করতে পারে না। ভয়ংকর অপরাধীদের যেখানে স্থান, বিশেষ করে রাজদ্রোহী ও বিপ্লবীদের। সেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে ১৮-১৯ বছরের নিতান্তই সাধারণ এক কিশোরকে। যে জানেও না তার কী দোষ, কোন অপরাধে তাকে বন্দী করে রাখা হলো এ মৃত্যুগর্ভে। এক একটা দিন তার কাটে আশায়, হয়তো বা কোনো ব্যবস্থা হবে, হয়তো বা কেউ আসবে, উদ্ধার করবে তাকে এ মৃত্যুকূপ থেকে। আবার সে সূর্যের আলো দেখতে পাবে, ফিরে যেতে পারবে তার আনন্দময় জীবনে। ফিরে যেতে পারবে তার পরিবারের কাছে, তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে, যে অপেক্ষা করে আছে তাদের পরিণয়ের।
কিন্তু না, কেউ যে আসে না। দিন, মাস গিয়ে একটার পর একটা বছর কাটতে লাগল। ধীরে ধীরে সমস্ত আশা পরিণত হতে থাকল হতাশায়। কান্না, চিৎকার, আস্ফালন, অনুরোধ কোনোকিছুতেই যে টলানো যায় না। না কারাগারের প্রহরীকে, না ঈশ্বরকে। তার চারপাশের নিরেট কালো পাথরগুলোও যেন তাকে বিদ্রুপ করতে লাগল, তার সমস্ত কান্না, বিলাপ, হাহাকারকে উপেক্ষা করে চারপাশ ঘিরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
উপরোক্ত ঘটনাটুকু আলেকজান্দার দ্যুমা রচিত ‘কাউন্ট অফ মন্টেক্রিস্টো’র একটি অংশবিশেষ। বইটি রচিত হয় সিরিজ আকারে ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। উপন্যাসের সময়কাল ১৮১৫ থেকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ। সম্রাট নেপোলিয়ন ও তার পরবর্তী সময়ের ফ্রান্স ও ইটালীর পটভূমিতে বর্ণিত এক বিখ্যাত কাহিনী। অনেকের মতেই, এ যাবৎকালের রচিত সব রোমাঞ্চকর কাহিনীর মধ্যে অন্যতম এ কিশোর উপন্যাসটি। কোন নির্দিষ্ট জনরায় একে বাঁধা সত্যিই মুশকিল, কারন কি নেই এতে! থ্রিল, সাসপেন্স, রোমান্স, ড্রামা সবকিছুতে ভরপুর অনবদ্য এ উপন্যাসটি। এর সাথে আবার বাড়তি রোমাঞ্চ যোগ করেছে গুপ্তধনের সন্ধান। সব মিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য এক কাহিনী।
উপন্যাসটির রচয়িতা আলেকজান্দার দ্যুমা ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরাসী লেখক। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেছেন আইন বিষয়ে। তবে তিনি কখনো ওকালতি করেননি। বরং তিনি অনেক রোমান্টিক আর রোমাঞ্চকর বইয়ের এক বিখ্যাত লেখকে পরিণত হয়েছিলেন। যেমন- দ্য থ্রী মাস্কেটিয়ার্স, টুয়েন্টি ইয়ার্স আফটার, দ্য ভিকমট অফ ব্র্যাগেলন: টেন ইয়ার্স লেটার ইত্যাদি।
তার লেখা উপন্যাসের অনেকগুলোই ছিল ঐতিহাসিক উপন্যাস। যেমন, দ্য থ্রী মাস্কেটিয়ার্সে সপ্তদশ শতকের ফরাসী রাজা ত্রয়োদশ লুইয়ের আমলের রাজ দরবার ও রাজার পারিষদদের জীবনযাত্রার চমকপ্রদ কাহিনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তবে তার সবচাইতে বিখ্যাত উপন্যাস নিঃসন্দেহে কাউন্ট অফ মন্টেক্রিস্টো। এ উপন্যাসের ভাষা, লেখকের গল্প বলার রীতি, সহজবোধ্যতা ইত্যাদি সবকিছু একে দিয়েছে সাহিত্য ক্লাসিকের মর্যাদা।
এ উপন্যাসটি নিয়ে গত একশ বছর ধরে মাতামাতির শেষ নেই। আর তাই এটি নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য সিনেমা। মঞ্চে, টেলিভিশনের পর্দায় হয়েছে অগুণতি নাটক ও সিরিজ। সেই নির্বাক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রতি দু’চার বছর অন্তর অন্তরই বিভিন্ন দেশে এর উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যার মধ্যে সর্বশেষটি মুক্তি পেয়েছে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ডের মিলিত প্রযোজনায়।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এদমন্দ দান্তে। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিনা অপরাধে যাকে জেল খাটতে হয়। এছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হল বৃদ্ধ পাদ্রী, ফারিয়া। যার কাছেই এদমন্দ পায় আলোর সন্ধান। যে এদমন্দকে গড়ে তোলে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে। এদমন্দের বাগদত্তা, মার্সিদিজ, এদমন্দের সহকর্মী দ্যাংলার ও ফার্ণান্দ। এছাড়াও আরও বেশ কিছু চরিত্র রয়েছে যাদের উপস্থিতি এ উপন্যাসকে করে তুলেছে প্রাণবন্ত।
ষড়যন্ত্রের শিকার এদমন্দ তার যৌবনের এক বিশাল সময় কাটিয়ে দেয় অন্ধকার কারাগারে, একাকী, নিঃসঙ্গ। হঠাৎ একদিন সে আলোর সন্ধান পায়, দেখা পায় পাদ্রী ফারিয়ার। এই জ্ঞানতাপস বৃদ্ধকে পেয়ে এদমন্দ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। ফারিয়া তাকে উচ্চশিক্ষা দেয়। তাকে শেখায় জ্ঞান যে কেবল পুস্তকেই সীমাবদ্ধ তা নয়, সত্যিকারের জ্ঞান মানুষকে শেখায় কখন, কীভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। কীভাবে মোকাবেলা করতে হয় কঠিন থেকে কঠিনতম পরিস্থিতির, যখন অস্ত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। সত্যিকারের অস্ত্র হল মানুষের মস্তিষ্ক, আর তাতে শাণ দেওয়ার একমাত্র উপায় হল জ্ঞানচর্চা। তাহলেই যেকোন অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।
ফারিয়ার কাছ থেকে এদমন্দ শিক্ষা পায় সবরকম শাস্ত্রের, এবং একসময় সেই অন্ধকার মৃত্যুকূপ থেকে পালাতে সক্ষম হয় সে। যেন নতুন করে আবার সে জন্ম নেয়। কারাগারে ঢোকার সময় যে ছিল নিতান্তই আলাভোলা, অসহায় এক কিশোর, আজ এতগুলো বছর পর সে শিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মপ্রত্যয়ী এবং উদ্যমী এক যুবক। মুক্তির পর তার অন্তদৃষ্টি উন্মোচিত হয়। নিজের মধ্যেই সে নিজের অন্য এক রূপ দেখতে পায়, যা তাকে করে তোলে আরও আত্মবিশ্বাসী।
পৃথিবীকে সে দেখতে পায় সম্পূর্ণ এক ভিন্ন চোখে, যেখানে লোভ লালসা মানুষকে গ্রাস করেছে, হিংসায় মানুষ মানুষের চরম ক্ষতিসাধন করে, স্বার্থপরের মতো মানুষ মানুষকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। প্রতিশোধ স্পৃহা জ্বালিয়ে দেয় এদমন্দের মনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। সে লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করতে থাকে সে। ছুটে বেড়ায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে। দু’চোখ ভরে দেখে পৃথিবীটাকে। কারণ তার গুরু ফারিয়ার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা, ‘কেবল পুঁথিগত বিদ্যা নয়, সত্যিকারের জ্ঞানার্জনের জন্য চাই বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা।’ আর তাই অভিজ্ঞতা অর্জনে এদমন্দ কোন ত্রুটি রাখে না। এভাবে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পরিণত হয় সমাজের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিতে। এবার সে প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত তাদের বিরুদ্ধে, যাদের জন্য এতগুলো বছর তাকে অন্ধকার কারাগারে আটকে থাকতে হয়েছিল।
কিন্তু, প্রতিশোধ নেওয়াটাও কি সহজ? এর চাইতেও বড় প্রশ্ন, প্রতিশোধ নেওয়াটা কি প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ? ঈশ্বরের ইচ্ছার বৈপরীত্য? একটি মানুষের জীবন তো তার একক সম্পত্তি নয়, এর সাথে জড়িয়ে থাকে আরও বহু মানুষের জীবন, স্বপ্ন, আশা, আকাংখা। প্রতিশোধস্পৃহা কি অজান্তেই অনেকগুলো জীবনকে ধ্বংস করে দেয় না? উপন্যাসটি নিশ্চিতভাবেই পাঠকের মনে উদ্রেক ঘটাবে এমনি আরও বহু প্রশ্নের।
অনলাইনে ক্ল্যাসিক এই বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে