হরর জনরা হলিউডের সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রভাবশালী জনরার মধ্যে অন্যতম। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত হলিউডের অগ্রগতিতে যুগে যুগে প্রভাব ফেলেছে এই হরর জনরা। এককালে বক্স অফিসের সাফল্যের সাথে হররের ওতপ্রোত সম্পর্ক ছিল। ব্লকবাস্টারের খ্যাতি অর্জন করার সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল একটি হরর মুভি তৈরি করা। এইচবিও’র The Sopranos সিরিজে এই সূত্রে বেশ মজাদার এক স্টোরিলাইনও ছিল। হলিউডের যুগপরিবর্তনের সাথে হররের চেহারাও পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তিত হওয়ার সক্ষমতার কারণেই আজও হরর জনরা প্রচন্ডরূপে জনপ্রিয়, ঠিক যেমন ছিল এক শতাব্দী পূর্বে। রবার্ট ওয়াইন, এফ. ডব্লিউ. মার্নাউ থেকে শুরু করে স্ট্যানলি কুব্রিক, আলফ্রেড হিচকক হয়ে ওয়েস ক্রেভেন, স্যাম রেইমি পার হয়ে বর্তমানকালে হরর এসেছে রবার্ট এগার্স, এরি এস্টার, জর্ডান পীলদের হাতে। আজ আলোচনা হাল আমলের হরর মুভির অন্যতম উল্লেখযোগ্য পরিচালক জর্ডান পীলের ফিল্মোগ্রাফি নিয়ে। তিনটি সম্পূর্ণ মৌলিক এবং ভিন্নধারার হরর মুভি দিয়ে কীভাবে এই গুণী পরিচালক হলিউডে নাম করে নিচ্ছে তাই হবে আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু।
হরর জনরার বিবর্তনের স্রোতে বর্তমানে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক ধারা, যার নাম সোশ্যাল থ্রিলার। হরর ফিল্মের ট্রোপগুলো ব্যবহার করে হররের ভয়াবহতাকে প্রয়োগ করা হয় আধুনিক সমাজব্যবস্থার বাস্তবতায়। জর্ডান পীলের ২০১৭ সালের ব্রেকআউট হিট ‘Get Out’ মুক্তি পাওয়ার পর পরই এই নতুন হররের নামকরণ হয়। এদিক থেকে চিন্তা করলে আধুনিক হররের অগ্রদূত হিসেবে পীলকে খুব সহজেই বিবেচনা করা যায়। পরিচালনার জগতে প্রবেশ করার পেছনে পীলের প্রেরণাই ছিল হররের মাধ্যমে বর্তমান সমাজে চলতে থাকা হাজারও অসমতা, অন্যায়-অবিচারের মুখে আয়না তুলে ধরা। আজ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া তিনটি ফিল্মের মাধ্যমে তিনি ঠিক সেই কাজটিই করে চলেছেন। তবে তার ফিল্মগুলো কোনো দিক দিয়েই একস্থানে স্থবির বসে নেই। প্রতিবারই মৌলিক এবং নতুন আইডিয়ার সাথে তার অকৃত্রিম ফিল্মমেকিং স্টাইলের মিশ্রণে উপহার দিয়ে চলেছেন একের পর এক অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা।
‘Get Out’ ছিল জর্ডান পীলের প্রথম ফিচার ফিল্ম। লেখনী, পরিচালনা এবং প্রযোজনা- সবক্ষেত্রেই এটি ছিল পীলের সিনেমা। এখানেই দর্শকরা প্রথম পরিচিত হয় এই ভিন্নধারার শিল্পীর কাজের সাথে। ড্যানিয়েল কালুইয়া আর জর্ডান পীলের পরিচালক-অভিনেতা জুটিও এখান থেকেই শুরু। এই মুভিতে পীল ফোকাস করেছেন রেসিজম বা বর্ণবাদের হররের উপর। তবে গতানুগতিক রেসিজম নিয়ে মুভিতে যেরকম হরর এলিমেন্ট থাকে (আগুন দিয়ে ক্রস জ্বালানো বা দাসত্বের ভয়াবহ রূপ), সেসব এলিমেন্ট নিয়ে ছিল না এই মুভির গল্প। বরঞ্চ, পীলের নজর ছিল নিত্যদিনের বর্ণবাদী আচরণ, ‘রেসিস্ট’ ট্যাগ থেকে বাঁচার জন্য শ্বেতাঙ্গদের ভন্ড সহানুভূতির হরর, কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির পদে পদে চলতে ফিরতে নিয়মিত বর্ণবাদের মাইক্রোএগ্রেশনের হরর। ‘ক্যাজুয়াল রেসিজম’ নিয়ে হাজারও ড্রামা, কমেডি মুভি রয়েছে যা এই ইস্যুর উপর আলোকপাত করে। এসব মুভি-সিরিজ উপভোগ্য বা শিক্ষণীয় হলেও ক্যাজুয়াল রেসিজমের যে বাস্তব, ভয়ংকর একটি দিক রয়েছে তা উপলব্ধি করানোর জন্য হরর জনরার তুলনা হয় না।
জর্ডান পীল তাই হররের সম্পূর্ণ উপযুক্ত ব্যবহার করেছেন এই আতঙ্কময় বাস্তবতা তুলে ধরতে। ড্যানিয়েল কালুইয়া অভিনীত ক্রিসের ভয়কে প্রত্যেক দর্শকের একদম হৃদয়ের ভেতরে অনুভব করিয়েছেন। পীলের কমেডি ব্যাকগ্রাউন্ড তার ফিল্মমেকিংয়ে আরেক আকর্ষণ যোগ করে। ‘গেট আউট’ বেশ মজাদার একটা মুভি, বিখ্যাত টুইস্টের আগপর্যন্ত। দর্শকদের গল্পে মগ্ন করার জন্য হিউমার প্রচন্ড কার্যকরি এক উপাদান, স্কেচ-কমেডি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা পীলের কাছে যা ডালভাত। কমেডিক কিছু মুহুর্তের ফলে দর্শকরা খুব সহজেই গেট আউটের গল্পে ঢুকে যেতে পারে, যার কারণে টুইস্টটার পরে হরর মোমেন্টগুলো প্রচন্ড ইফেক্টিভ হয়।
গেট আউটের সাংকেন প্লেসের হররের পর জর্ডান পীল নিয়ে আসেন তার দ্বিতীয় ফিল্ম ‘Us’। এতে পীল হররের মাত্রা বাড়িয়ে এবার নিয়ে যান মনুষ্যত্বের দ্বৈত সত্তা থেকে সৃষ্টি হওয়া হররে। লুপিতা নিয়োঙ্গো অভিনীত অ্যাডেলেইডের পরিবার এই মুভিতে মুখোমুখি হয় নিজেদের ডপলগ্যাঙ্গারের। নিজের অনুরূপ আরেক ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়ার ভয়ের সাথে পীল যোগ করেন বর্ণবাদ, আর্থিক বৈষম্য আর মানুষের সত্যিকার রূপের সাথে জড়িত ভয়াবহ বাস্তবতা। এই মুভিতে আমরা দেখতে পাই প্রত্যেক আমেরিকানের রয়েছে দুটি সত্তা। একজন উপরের জগতে স্বাভাবিক পরিবেশে বড় হয়, আরেকজন আন্ডারগ্রাউন্ডে বেঁচে থাকার কোনো উপকরণ ছাড়া জীবনযাপন করে। এই দুই সত্তার মাঝে সংঘর্ষে পীল যেন দর্শকদের নিজেদের মানবতা, নৈতিকতাকেই প্রশ্নে তুলে ধরে! ছন্নছাড়াভাবে জীবনযাপন করা এই ‘টেদার্ড’ পরিবারকে আমরা স্বভাবতই গল্পের ‘ভিলেন’ হিসেবে গণ্য করি, কারণ তারা আমাদের প্রোটাগনিস্টদের ক্ষতি করতে চাচ্ছে। কিন্তু এই টেদার্ড ব্যক্তিদের কোনো হাতই ছিল না নিজেদের এই বাস্তবতার জন্য। তার উপর পীল যোগ করেছে লুপিতা নিয়োঙ্গো অভিনীত অ্যাডেলেইডের টুইস্ট। এসব মিলিয়ে উইলসন পরিবারের ভয়াল এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দর্শকদের চরম উপভোগ্য এক হরর গল্পের পাশাপাশি আমাদের আর্থিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রিভিলেজ, পক্ষপাতিত্ব ও নৈতিকতা নিয়ে কিছু চিন্তা করার মতো প্রশ্ন করেই জর্ডান পীল শেষ করেছেন তার দ্বিতীয় ফিল্ম।
‘গেট আউট’, ‘আস’-এর পর পীল হাজির হলেন তার তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় ফিল্ম নিয়ে- ‘NOPE’। আকার-আকৃতির দিক থেকে ‘নোপ’ পীলের আগের দুই মুভি থেকে অনেক বড়। সত্যিকার অর্থে ব্লকবাস্টার সিনেমায় হাত দিলেন এবার এই পরিচালক। তবে, স্বভাবতই পীল ব্লকবাস্টারের মধ্যেও নিজের ছাপ, নিজের সিনেম্যাটিক ছোঁয়া দিয়ে ‘নোপ’কে পরিণত করলেন এক মডার্ন হরর মাস্টারপিসে। এলিয়েন ইনভেশন হররের মধ্যে নিয়ে আসলেন চলমান বিনোদন মাধ্যম, পপ কালচার নিয়ে তীক্ষ্ণ, সময়োপযোগী এক কমেন্টারি। ব্লকবাস্টার স্পেক্ট্যাকলের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিলেন এই স্পেক্ট্যাকল, চোখধাঁধান প্রদর্শনীর অশুভ দিক।
‘নোপ’ সিনেমায় রয়েছে দুটি ভূমিকা। প্রথম ভূমিকায় আমরা দেখতে পাই স্টিভেন ইউন অভিনীত রিকির সাথে ঘটে যাওয়া ‘গোর্ডি’ ইনসিডেন্টের কিছু দৃশ্য। ‘গোর্ডি’ ঘটনার মধ্য দিয়ে পীল দেখিয়েছেন- দর্শক মাতাতে হলিউডের যারপরনাই প্রচেষ্টার অন্ধকার দিক। আকর্ষণীয়, চাকচিক্যময় বিনোদনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কঠিন কিছু সত্যকে দিনের আলোতে নিয়ে এসেছেন রিকির চরিত্রের মধ্য দিয়ে।
সিনেমার দ্বিতীয় ভূমিকায় রয়েছে আমাদের প্রোটাগনিস্ট, ওজের পূর্বপুরুষ এলিস্টার হেয়উডের ইতিহাস। পীল এই মুভির জন্য কল্পনা করে নিয়েছেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম ফিল্মে রেকর্ড করা দৃশ্য ছিল ঘোড়ার পিঠে চলমান একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি। তবে আজও সেই কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির নাম কেউ জানে না, তিনি নেই হলিউডের কোনো ইতিহাসের পাতায়। এই ভূমিকার মধ্য দিয়ে পীল হাজির করেছেন তার দ্বিতীয় ভাষ্য- কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিভা এবং অবদানকে হলিউড কীভাবে যুগের পর যুগ উপেক্ষা করে এসেছে! হরর এবং কমেডির নিখুঁত মিশেলে ব্লকবাস্টার মুভির চাকচিক্যের মধ্য দিয়ে এই কঠিন সত্যগুলো পীল হাজির করেছেন দর্শকের সামনে।
সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা করা হলিউডের অতি সত্য এবং লজ্জাজনক এক ইতিহাস। তবে এই হলিউডের মুভি, টিভি সিরিজই হতে পারে এসব না বলা গল্পকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম। যেমনটা হয়েছিল ২০১৯ সালের ‘Watchmen’ সিরিজের মধ্য দিয়ে। ডেমন লিন্ডেলফ এই সিরিজে তুলে ধরেছেন আমেরিকার টালসা শহরে ঘটে যাওয়া বিস্মৃত এক ভয়াবহ দাঙ্গার ঘটনা। পীলও নিজের ফিল্মোগ্রাফির মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের দর্শকদের মাঝে নিয়ে আসছেন উপেক্ষিত এসব গল্প এবং চরিত্রকে।
পর পর তিনটি অসাধারণ হরর সিনেমার মধ্য দিয়ে জর্ডাল পীল প্রমাণ করেছেন এই জনরায় তার অসীম শৈল্পিক বোধশক্তি। নতুন ধারার হরর ভক্তদের উৎসুক আগ্রহের সময় এখন এই শিল্পীর পরবর্তী কাজের অপেক্ষায়।