রুশ ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিচার ফিকশন ফিল্ম কোনটি? কারো মতে ব্যাটলশিপ পতেমকিন, আবার কারো কারো মতে মিরর, স্টকার কিংবা ক্রেন্স আর ফ্লাইয়িং-এর নাম আসতে পারে। কিন্তু যদি প্রশ্নটি হয় প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে, তাহলে একবাক্যে সবার কাছ থেকে একটিই উত্তর আসবে— ম্যান উইথ অ্যা মুভি ক্যামেরা। এমনকি ‘সাইট এন্ড সাউন্ড’-এর সমীক্ষা তো বলছে প্রামাণ্যচিত্রের র্যাংকিং-এ জিগা ভার্তভের মুভিটিই সর্বকালের বিশ্বসেরা। যার কারণ চলচ্চিত্রটি ছবির সেট এবং অভিনেতা উপেক্ষা করে ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক মাইলফলকের জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলেন— হয়তো এই চলচ্চিত্র নির্মিত না হলে সিনেমাটোগ্রাফির ভাষা অপূর্ণ থেকে যেত। আধুনিক চলচ্চিত্রকে অন্য যেকোনো শিল্পমাধ্যম থেকে আলাদা করে তার স্বকীয়তাকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায় জিগা ভার্তভের এই পরীক্ষণ। যার সিনেম্যাটিক ভাষা নাটক ও সাহিত্যের ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। তাই তো চলচ্চিত্র সমালোচকগণ এক্সপেরিমেন্টাল প্রামাণ্যচিত্রটিকে ফিল্মের আদি আধুনিকতা হিসেবে দেখেন।
১৮৯৫ সালে লুমিয়ের ব্রাদার পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। কিন্তু অনেকেই পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র স্কুলের নাম জানি না। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের সাথে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও একাডেমিকভাবে তারা তখনও চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনার কথা ভাবেনি। এদিকে বলশেভিক বিপ্লবের ঠিক পর পরই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন চলচ্চিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে রুশ ভাষায়। তারা চেয়েছিল ফিল্মকে প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে- এতে তারা সফলও হয়। শৈল্পিক প্রোপাগান্ডা নির্মাণ করে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হন। ১৯১৯ সালে লেনিনের নেতৃত্বে মস্কো ফিল্ম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে যা সুদীর্ঘকাল “the All-Union Institute of Cinematography” নামে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়ে বর্তমানে Gerasimov Institute of Cinematography (VGIK) নামে সাফল্যের সাথে একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নির্মাতা সার্গেই আইজেনস্তাইন, জিগা ভার্তভরা এই স্কুলের অধীনে নির্মাণ করে গেছেন কালোত্তীর্ণ সব রুশ সিনেমা। প্রোপ্যাগান্ডা তকমা জুটলেও এসব ফিল্মের শিল্পমানকে বিশ্বসিনেমায় কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। উপরন্তু ম্যান উইথ অ্যা মুভি ক্যামেরাকে বর্তমান বিশ্বের সকল ফিল্ম স্কুল এবং ফিল্মের সব কোর্সে আবশ্যকীয় পাঠ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে- কেউ সিনেমাটোগ্রাফি শিখতে চাইলে এই ফিল্ম এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। কারণ এটি আধুনিক সিনেমাটোগ্রাফির প্রথম অভিধান।
ভার্তভের আনস্ক্রিপ্টেড ফিচার ডকু ফিল্মটি সোভিয়েত শহর মস্কো, কিয়েভ (বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী),খারকিভ এবং ওডেসা শহরের জনজীবনকে উপস্থাপন করে। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সোভিয়েত নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনের রোজকার কাজকর্ম এবং আধুনিক জীবনে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির নানামুখী প্রয়োগ দেখানো হয়। ম্যান উইথ অ্যা মুভি ক্যামেরাতে বিদ্যুতায়ন, শিল্পায়ন ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শ্রমিকদের কৃতিত্বের চিত্রায়নে নান্দনিকতা ফুটে ওঠে। মুভিতে Constructive Realism-এ সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর আগমনী বার্তা যেমন আছে, তেমন আছে জীবনাবসানের দৃশ্য। ব্যস্ত রাস্তা মানুষ আর যানবাহনের চলাচল, চলন্ত ট্রেন, ট্রাম, সিনেমা রিল আর আমাদের চোখের সাথে ক্যামেরার লেন্সের তুলনা দেখিয়ে ছবিটির ইতি টানা হয়। ভার্তভের ফিল্মটি পূর্বে নির্মিত বিশ্বের সকল চলচ্চিত্রের মূল কাঠামোকে পাশ কাটিয়ে নতুন সিনেমা ভাষার অনুসন্ধান করে। সৃষ্টি করে আধুনিক বিবিধ ক্যামেরা কৌশল। শট ধারণের বৈচিত্র্য আর নান্দনিকতা উদ্ভাবনের জন্য এই ফিল্ম আবিষ্কার করে সিনেমাটোগ্রাফির নতুন সব ব্যাকরণের, যা পরে অনুসৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী।
সিনেমার শুরুতে ফিল্মটির নির্মাণ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রয়েছে। যা হুবহু এরকম—
“The film is an experiment of real events without the help of inter-titles. Without the help of a story. Without the help of theatre. This experimental work aims at creating a truly international language of cinema based on its absolute separation from the language of theatre and literature.”
এবং এরপরেই ভার্তভ নির্মাতা কিংবা পরিচালক শব্দটি ব্যবহার না করে নিজের পরিচয়ে লেখক, তত্ত্বাবধায়ক এবং পরীক্ষক বলে ক্রেডিট টাইটেলে উল্লেখ করেন। সিনেমার প্রধান অপারেটর ছিলেন মিখাইল কাউফম্যান যাকে পর্দায় ক্যামেরা কাঁধে বয়ে বেড়াতে দেখা যায়। জুক্সটাপজিশনে থেকে সে শহুরে জীবনের গতিচিত্র অবিরত ধারণ করে। কিছু ফ্রেমে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ শট আছে। আছে আলোকচিত্র গ্রহণযন্ত্রের গোপন-অগোপন রকমারি কারসাজি! সিনেম্যাটিক ম্যাজিক!
প্রায় তিন বছরব্যাপী সর্বমোট ১,৭৭৫টি পৃথক শট দিয়ে সাজানো ফিল্মটির সবচেয়ে বড় সার্থকতা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচনে। মাল্টিপল এক্সপোজার , ফাস্ট মোশন, স্লো মোশন, ফ্রিজ ফ্রেম, ম্যাচ কাট, জাম্প কাট, স্প্লিট স্ক্রিন, ডাচ অ্যাঙ্গেলস, এক্সট্রিম ক্লোজ-আপ, রিভার্স ফুটেজ, স্টপ মোশন এনিমেশন, সেলফ রিফ্লেক্সিভ ভিজুয়্যালের মতো শৈল্পিক সব ক্যামেরা কৌশলের উদ্ভব ঘটে ম্যান উইথ অ্যা মুভি ক্যামেরার মাধ্যমে। সারগেই আইজেনস্তাইনের মন্তাজকে বিনির্মাণ করেছে এ প্রামাণ্যচিত্র। ধনাঢ্য তরুণীর বিউটি পার্লারের রূপচর্চা আর কয়লা খনিতে কাজ করা চেহারায় কয়লামাখা এক মেয়ের পর পর দৃশ্যায়নে পুনর্নির্মিত হয়েছে ঐতিহাসিক ব্যাটলশিপ পতেমকিনের মন্তাজ তত্ত্ব। এজন্য ভার্তভের কাজকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে পরবর্তী সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে ‘দ্য ম্যান হু হ্যাজ অ্যা ক্যামেরা (১৯৩৩)’।
চলচ্চিত্রের ব্যবহৃত শব্দ এবং সঙ্গীত চমৎকার দ্যোতনা সৃষ্টি হয়। গতিশীল ডকুমেন্টারিটির গতিময়তা আনয়নে মিউজিকের অবদান যে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার প্রমাণ আছে এতে। বিশেষ করে The Awakening of a woman ট্র্যাকটি তো বিশ্বজনীন হিসেবেই গৃহীত হয়েছে। শুরু থেকে দৃশ্যায়নের নানা পরীক্ষণ নিরীক্ষণ যেমন ছিল, তেমনি একযোগে ছিল সঙ্গীত এবং সম্পাদনার যুগোপযোগী নতুন নতুন আইডিয়া। এতে ছবিটি কেবল কতগুলো শহরের কথাই বলে না, বলে আর্ট অব ফিল্মের কথাও। যাতে সিনেমার পুরনো ধ্যানধারণাকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন নির্মাতা। বিপরীতে, নতুন অভিধান রচনা করতে যাওয়ার স্পর্ধা দেখানোয় তার জন্য একরকম মিশ্র সমালোচনা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল।
সিনেমা ভাষার নবপ্রাণ জাগরণী এ চলচ্চিত্রের শত মুগ্ধতা আর উচ্ছ্বসিত প্রশংসার বিপরীতে শুরুতে রুশ চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ খোদ সারগেই আইজেনস্তাইন একে “ক্যামেরার অর্থহীন দাপাদাপি” হিসাবে আখ্যায়িত করে ফিল্মের শিল্পমানকে উপেক্ষা করেছিলেন। আরেক ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাতা পল রোথা আরও সরাসরি বলেছিলেন যে ব্রিটেনে ভার্তভকে নিছক রসিকতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ ওতে একটি ক্যামেরা শুধু অন্য আরেকটি ক্যামেরার ছবি তোলে, যার সমস্তই প্রয়োজনহীন ছলচাতুরী। ফলে তারা একে গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। সুতরাং সামগ্রিক বিবেচনায় ফিল্মটি নিরর্থক তথা কোনো অর্থবাচকতা সৃষ্টিতে অসমর্থ।
পরিসমাপ্তিতে সমালোচনার ঊর্ধ্বে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে বলা যায়, এই সিনেমা সবার জন্য নয়। এটি চলচ্চিত্রবোদ্ধা আর চলচ্চিত্রপ্রেমী, যারা সিনেমাটোগ্রাফির বিভিন্ন টেকনিক আর শটবৈচিত্র্য নিয়ে প্রবলভাবে জানতে আগ্রহী, শুধুমাত্র তাদের জন্য। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ প্রকাশ না করেই বলা যায়— এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মটি সত্যিকারার্থেই তাদের জ্ঞানস্পৃহায় পর্যাপ্ত রসদ যোগাতে সমর্থ হবে।
চলচ্চিত্র : Человек с кино-аппаратом (Man with a movie camera)
পরিচালক : জিগা ভার্তভ
জনরা : নিরীক্ষাধর্মী প্রামাণ্যচিত্র
সাল : ১৯২৯