গল্পটায় যে সমস্যাটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা এখনকার সময়েও প্রাসঙ্গিক। (পরিবেশ) দূষণ যেমন একশো বছর আগেও একটা সংকট ছিল, বর্তমানেও তা আছে। বরং এখন এই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে-
নরওয়েজিয়ান সাহিত্যিক হেনরিক ইবসেনের নাটককে সিনেমার ছাঁচে ঢালা প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এমনটাই বলেছেন কিংবদন্তীতুল্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। ধর্ম আর বিজ্ঞানের চিরাচরিত দ্বন্দ্ব সমাজকে কী করে অস্থিতিশীল করে তোলে, সমাজের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে তার বিচারবুদ্ধি থেকে কীভাবে দূরে ঠেলে দিতে পারে, সে উপাখ্যানই বর্ণিত হয়েছে সত্যজিতের শেষ জীবনের সিনেমাগুলোর একটি, গণশত্রু-তে। গণশত্রু আমাদের উপমহাদেশের ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সমান্তরাল বৈপরীত্যের রূপালী দলিল।
এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট দৈর্ঘ্যের গণশত্রু ১৯৮৯ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে মুক্তি পায়। কলকাতার সিনেমাহলগুলো তখন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছিল না। সিনেমা চলার সময় ফ্যান ঘোরার শব্দের কারণে সাউন্ড-ট্র্যাকের মাধুর্য হারানোর অভিযোগে সত্যজিত সে বছর কলকাতায় ‘গণশত্রু’কে মুক্ত করেননি। কিন্তু সিনেমাটা আগাগোড়া কলকাতা কেন্দ্রিক। আরও বিস্তৃত করে বললে, এ গল্প আমাদের সবার- বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ আর কুসংস্কারে অন্ধ উপমহাদেশীয়দের। ইবসেনের নাটককে প্রায় অক্ষত রেখে একেবারে খাঁটি ভারতীয় উপমহাদেশের আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন সত্যজিৎ রায়।
সিনেমার গল্পের কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের ছোট শহর চণ্ডীপুর। এ শহরের একজন ডাক্তার হচ্ছেন অশোক গুপ্ত। স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার ছিমছাম সংসার। রোগীদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি টের পান, চণ্ডীপুরে হঠাৎ করে জন্ডিসের প্রকোপ বেড়েছে। শহরের সবচেয়ে জনবহুল স্থান ভবানীপুরের পানি কলকাতা থেকে পরীক্ষা করিয়ে গুপ্ত টের পান, ঐ এলাকার পানীয় জলের উৎসগুলো জন্ডিস রোগের জীবাণুতে ভর্তি। ভবানীপুরে অবস্থিত, চণ্ডীপুরের গৌরবের প্রতীক ত্রিপুরেশ্বর মন্দিরের ভূ-অভ্যন্তরস্থ পাইপ লাইনে ফাটল ধরে এমন ঘটনা ঘটেছে। আর সেই মন্দিরের পানি সাধারণ মানুষ নিয়মিত পান করছে। এরকম চলতে থাকলে এলাকায় জন্ডিস মহামারী আকারে দেখা দেবে ভেবে ন্যায়নিষ্ঠ ডাক্তারের সামাজিক দায়িত্ববোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি চান, মন্দিরটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে জলাধার সংস্কার করা হোক।
কিন্তু, এ মন্দির যে শহরের ধর্মব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের বাড়তি আয়ের এক নির্ঝঞ্ঝাট উৎস! তারা কেন চাইবে মন্দির বন্ধ হোক, এতে করে যে তাদের সাকার নারায়ণ বেচে নগদ নারায়ণ প্রাপ্তিতে ব্যাঘাত ঘটবে! ডাক্তার গুপ্ত বুঝতে পারলেন, চণ্ডীপুরকে বাঁচানোর এই মহৎ কাজে গুটিকয় মানুষ ছাড়া আর কেউই তার সাথে নেই। শহরের প্রগতিশীল মানুষেরা থেকে শুরু করে তার আপন ভাই, সবাই নিজেদের স্বার্থরক্ষায় মরিয়া। আর এখানেই ঘটে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ – ডাক্তার অশোক গুপ্তের দশা এমনই হয়, তিনি হয়ে ওঠেন তথাকথিত গণশত্রু।
গণশত্রু-কে আগাগোড়া ট্র্যাজেডি বলা হয়তো যাবে না। কিন্তু সিনেমাটি পুরাদস্তুর ট্র্যাজেডি হতে পারতো। ইবসেনের নাটকে ট্র্যাজেডিতেই সমাপ্তি ঘটেছিল। একটা কথা আছে, ‘যার জন্য চুরি করি, সে-ই বলে চোর’। ডাক্তার অশোকের হয়েছে সেরকম অবস্থা। তিনি চেয়েছিলেন চণ্ডীপুরের মানুষগুলো ভালো থাকুক। তার জন্য তিনি শহরের রুই-কাতলাদের সাথে লাগতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই শহরবাসীই শেষ অব্দি তাকে দোষী সাব্যস্ত করে গণশত্রু বলে আখ্যায়িত করল। ইবসেন তার নাটক শেষ করেছেন এরকম একটা পরিস্থিতিতে। তার নাটকের প্রোটাগনিস্ট ডক্টর স্টকমানকে শেষ দৃশ্যে বলতে শোনা যায়, “পৃথিবীতে সেই লোকই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী যার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই, একদম কেউ।”
মিসেস স্টকমান: কী হবে? টম! কী হবে?
ডক্টর স্টকমান: আমি জানি না। কিন্তু সবাই একটা কথা মনে রেখো। তোমরা সত্যের জন্য লড়াই করছ। আর সেজন্যই তোমরা একা এবং তোমাদের শক্তি ওতেই নিহিত। আমরা হচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ।
ডক্টর স্টকমান: …আর শক্তিশালীদের অবশ্যই একা চলাটা শিখতে হবে।
ইচ্ছে করলে সত্যজিৎ স্টকমানের শেষ কথাটা রাখতে পারতেন তার সিনেমায়। তাতে হয়ত একটা বার্তা দর্শককে দেওয়া যেতে পারতো, কিন্তু তাহলে পুরো সিনেমায় সত্যজিতের স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু থাকত না। সেজন্য তিনি তার স্ক্রিপ্টে কিছুটা অদলবদল ঘটালেন। সমাপ্তিটা নিজের মতো করে টানলেন। ডাক্তার অশোক গুপ্ত যখন ব্যর্থ, পরাজিত, আর কোনো আশা দেখছেন না চণ্ডীপুরকে বাঁচানোর জন্য, এমনকি শহর ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া তার সামনে আর তখন কোনো পথই খোলা নেই, তখনই তার কিছু কাছের মানুষ ও সমাজের কিছু প্রগতিশীল তরুণ-তরুণী তার সমর্থনে এগিয়ে আসে। একটা নতুন আশার আলো ফুটে ওঠে, আবার নতুন করে শুরু করার প্রেরণা পান ডাক্তার গুপ্ত। হয়তো সত্যজিৎ নিজেই এমন চেয়েছেন। অসুস্থ হয়ে অর্ধ দশকের মতো পড়ে থাকার পর আবারও সিনেমায় নেমেছিলেন তিনি। তাই হয়তো তিনি নিজেই আশার আলো দেখেছিলেন, ভেবেছিলেন আবারও ‘নতুন করে করব শুরু’। কিন্তু সে আর হলো কই! তিনটের বেশি সিনেমাতো আমাদের আর দিতে পারলেন না।
গণশত্রু আমাদের ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এক সপাট চপেটাঘাত। রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা, অস্থির ও নিষ্ফলা রাজনীতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও সমাজের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে সত্যজিৎ কিছুটা ক্ষুণ্ণ ছিলেন। তার জীবনীকার অ্যান্ড্রু রবিনসন সত্যজিৎ রায় দ্য ইনার আই বইতে সত্যজিতের এই মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।
চারপাশটা দেখে আমার মনে হয় মানুষের মধ্যে এখন আর আগের মতো সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, উদারতা, যুক্তিবোধ ও ন্যায়বোধের বালাই নেই। মানুষ এখন দুর্নীতিকে জীবনের সাথে মিলিয়ে ফেলেছে, এই অপরিহার্য পাপের সাথে নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নিয়েছে। ভোগবাদে মত্ত হয়ে আমরা জীবনের প্রশান্তিকে সহজেই ত্যাগ করছি। হয়তো প্রথমদিকে আমরা খানিকটা প্রতিবাদের চেষ্টা করি বটে কিন্তু ভেতর আর বাইরেরকার ক্রমাগত চাপে একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে চুপ করিয়ে দিই।
মনুষ্যত্বের এই অবক্ষয় সত্যজিৎকে হতাশ যেমন করেছিল, ঠিক তেমনি তার মনকে আন্দোলিত করেছিল এই অধঃপতন নিয়ে কথা বলার জন্য। রাজনীতিকে কিছুটা এড়িয়ে চলতেন সত্যজিৎ। প্রতিদ্বন্দ্বী-তে রাজনীতি বনাম ব্যক্তির দ্বন্দ্ব দেখিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন, রাজনীতি যে সমাজের খুব একটা উপকারে আসছে না। গণশত্রু-তে এবার দেখালেন সমাজে জেঁকে বসা মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশালী ও তাদের সাথে তাল মেলানো সরকারি আমলারা কীভাবে নিজেদের স্বার্থের জন্য সাধারণ জনগণের সাথে সম্পূর্ণ প্রতারণা করতে পারে। ডাক্তার অশোকের এই কাজ তথা সমাজের প্রতি অপরিসীম দায়বদ্ধতার জেরে নিজের এত বড় ক্ষতি স্বীকার করার ব্যাপারটা দর্শকের কাছে নিছক গল্প, উপন্যাস বা সিনেমায় সম্ভব বলে মনে হতে পারে।
কারণ, আজকালকার দুনিয়ায় এরকম নিঃস্বার্থ হিতবাদীদের কথা ভাবা দুষ্কর। কিন্তু সত্যজিৎ নিজেও তো একদিক থেকে ডাক্তারের প্রতিচ্ছবি। তিনি ইচ্ছে করলেই ফিল্ম বানিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাতে পারতেন। তিনি ইচ্ছে করলে হলিউডে নাম লেখাতে পারতেন, কিন্তু অনেক অফার তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শুধু বাংলায় তার শেকড় বলে। নিজের সিনেমার সঙ্গীতায়োজনের জন্য তিনি কখনো পয়সা নেননি। তার স্ত্রী বিজয়া রায় জানিয়েছেন, সত্যজিতের অর্থের প্রতি কোনো নিরর্থক লালসা ছিল না। এই সততা, নিজ সমাজ, মানুষের প্রতি এই দায়বোধ তাকে বিমুখ করেনি। ঠিক যেমনটা ডাক্তার অশোককেও শেষ অব্দি নিরাশ হতে হয়নি।
অনেকেই মনে করেন সত্যজিৎ গণশত্রু-তে হরিদাস চরিত্রের মাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। শহরের প্রগতিশীল পত্রিকা বলে পরিচিত জনবার্তার সম্পাদক হরিদাসকে আমরা দেখি প্রথমদিকে ডাক্তার গুপ্তকে সমর্থন করতে। হরিদাসও চায়, তার শহরের দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দিতে। কিন্তু একটা সময় সেও পরাজিত হয় অসৎ শক্তির কাছে। ডাক্তার অশোকের তেজোদ্দীপ্ত লেখা ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করে। কিন্তু হরিদাসের এহেন আচরণ হলুদ সাংবাদিকতা, নাকি সেল্ফ সেন্সরশিপ, সেটাও ভাবার বিষয়। হরিদাস মনে মনে ডাক্তারের মেয়েকে ভালোবাসে। হরিদাস যদি রানুকে মনে মনে কামনা করে, তবে তাতে দোষের কী আছে? ভালোবাসা কি অপরাধ? আর ভালোবাসার মানুষকে দেখতে চাওয়াটাও কি অপরাধ? মোটেই নয়। কিন্তু হরিদাস যখন রানুর মন জয় করতে ব্যর্থ হয়, তখন সে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয় লেখাটা ছাপাবে না বলে।
তার এই অপ্রাপ্তি হয়তো ডাক্তার অশোকের ওপর থেকে তার সমর্থন তুলে নেয়, যা তার নৈতিক স্খলন। কিন্তু পাশাপাশি আরেকটা ব্যাপারও তাকে ভাবতে হয়। মফস্বলে একটা কাগজ চালাতে গেলে অনেক বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়- এটা হরিদাসের নিজের স্বীকারোক্তি। সুতরাং প্রভাবশালীদের কথায় কিছুটা সায় না দিয়ে একজন সম্পাদক হিসেবে তার পত্রিকাকে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব কাজ। এই ব্যাপারটা অনেকটা সেল্ফ সেন্সরশিপ তৈরি করে নেয়। ফলে অনেক সময় একটি আপাত প্রগতিশীল পত্রিকার পক্ষেও পুরোপুরি জনগণের পক্ষে হয়ে কথা বলাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটাই বাস্তবতা আর এই বাস্তবতাটাকেই সত্যজিৎ তুলে ধরেছেন। যদি এই অংশটুকু সিনেম্যাটিক করতে চাইতেন, তাহলে হয়তো আমরা হরিদাসকে সব বাধা সত্ত্বেও ডাক্তার অশোকের পক্ষে কলম ধরতে দেখতাম।
১৯৮৩ সালে ঘরে বাইরে সিনেমার শ্যুটিং-এর সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হন সত্যজিৎ। রোগটা তাকে এতটাই কাবু করে ফেলে যে প্রায় অর্ধ দশক সিনেমা বানানো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। শেষে ১৯৮৮ সালের শেষদিকে তার শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলে ডাক্তাররা তাকে পুনরায় সিনেমা বানানোর অনুমতি দেন কিন্তু সাথে শর্ত জুড়ে দেন কাজ করতে হবে ইনডোরে। সেজন্যই সত্যজিতের শেষ তিনটে সিনেমা, গণশত্রু, আগন্তুক, ও শাখা-প্রশাখার বেশিরভাগ কাজ হয়েছিল ইনডোরে। এর মধ্যে সবার আগে তিনি বানিয়েছেন গণশত্রু। যেহেতু কাজটা ইনডোরেই করতে হবে তাই সত্যজিতের মনে হলো নাটক থেকে সিনেমা বানানোই হবে সবচেয়ে উপযুক্ত। কারণ নাটক মানেই ইনডোর; বাড়তি সেট, অতিরিক্ত চরিত্রের বালাই নেই। হেনরিক ইবসেনের অ্যান এনিমি অভ দ্য পিপল-কে বেছে নিলেন তিনি।
যেহেতু আমাকে স্টুডিওর ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকতে হতো, তাই আমি মনে মনে নাটক নিয়ে কাজ করার চিন্তা করলাম। কলেজে থাকতে আমার ইবসেনের লেখার সাথে পরিচয় হয়েছিল। তার এনিমি অভ দ্য পিপল-এর কথা আমার স্মরণে এল। আমি আবার পড়লাম। মনে হলো এই নাটকটা নিয়ে এই সময়ে এসেও কাজ করা সম্ভব। গল্পটাকে আধুনিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পুরাদস্তুর ভারতীয় রূপ দেওয়া যায়।
ইবসেন ১৮৮১ সালে গোস্টস নামে একটা নাটক লিখেছিলেন। নাটকের বিষয়বস্তু ছিল উনিশ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগের সমালোচনা। অজাচার, কুসংস্কার, গোঁড়া ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি তীব্র কটাক্ষ হানা এই নাটক সমাজে রোষের সৃষ্টি করে। গণপ্রতিবাদের মুখে পড়তে হয় ইবসেনকে। দর্শকদের এমন প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের প্রতিউত্তরে পরের বছর ইবসেন তার অ্যান এনিমি অভ দ্য পিপল রচনা করেন।
সত্যজিৎকেও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। ১৯৬০ সালে সত্যজিৎ দেবী নির্মাণ করেন। এই সিনেমায় তিনি বাঙালি হিন্দুদের কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে তুলে ধরেন। ফলে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ও হিন্দুধর্ম অবমাননা করার অভিযোগ ওঠে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। ক্যারিয়ারের শেষে এসে গণশত্রু দিয়ে তারই জবাব দেন সত্যজিৎ।
সিনেমায় ডাক্তার অশোক গুপ্তের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নির্লোভ, সৎ, ন্যায়পরায়ণ, দায়িত্ববান ডাক্তারের চরিত্রের সাথে সৌমিত্রের সৌম্য চেহারা বেশ মানিয়ে গেছে। ডাক্তারের ভাই, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নিশীথ গুপ্তের চরিত্রে ধৃতিমান ছাড়া আর কাকেই বা চিন্তা করা যায়! এ চরিত্রটি সিনেমায় মূল খলনায়ক। কিন্তু সে ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এখানে পেশীশক্তি প্রদর্শন বা মারদাঙ্গার কোনো সুযোগ নেই বরং প্রচ্ছন্ন হুমকিতে ভরা কঠোর সংলাপই একমাত্র হাতিয়ার। আর সে কাজটাই খুব দক্ষতার সাথে করেছেন ধৃতিমান। তার ভাবলেশহীনমুখে সংলাপ ছুঁড়ে মারার ভঙ্গিটা তাকে আদতে খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ভদ্রবেশী, বিদ্বান হলেও তিনি যে দুর্জন, সেটা তার নির্বিকার মুখভঙ্গি আর সংলাপের জোরে নিঃসন্দেহে শতভাগ প্রকাশ করতে পেরেছেন ধৃতিমান। দীপঙ্কর দে, মমতাশঙ্কর সবাই তাদের নাম রেখেছেন। আর এই চরিত্রগুলোর মধ্যে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও অভিনয় দক্ষতা দিয়ে নিজের চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শুভেন্দু চ্যাটার্জি।
অনেক সমালোচকই গণশত্রুকে সত্যজিতের সবচেয়ে নিম্নমানের চলচ্চিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ হচ্ছে, এই সিনেমায় সত্যজিতের স্বভাবজাত নিগূঢ় আর্ট বা মন্তাজের খেলা নেই। আবার কিছু সহচরিত্রের অভিনয় খুব একটা মানসম্পন্ন ছিল না। এটা সত্য বৈকি, সিনেমায় লোকেশন আর প্রকৃতিকে নিয়ে উঁচু মাপের কাজ করতেন সত্যজিৎ। তার প্রতিটি দৃশ্যই দর্শককে কিছু না কিছু বার্তা দিত। আর লোকেশনের পারফেকশনের জন্য সারাজীবন তিনি কম দৌড়ঝাঁপ করেননি। পথের পাঁচালী, গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর জন্য যেমন বাংলা মুলুকের বন জঙ্গলে, গাঁওগেরামে ছুটে বেড়িয়েছেন, তেমনি সোনার কেল্লা বা হীরক রাজার দেশে বানানোর জন্য রাজস্থানের মরুভূমি চষে বেড়িয়েছেন। গুপী গাইন বাঘা বাইন ও হীরক রাজার দেশে বানানোর সময় সার্কাসের বাঘকে শুটিংয়ে রাজি করাতে তাকে যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছিল। একেই বলে শুটিং বইয়ে সত্যজিৎ লিখেছিলেন,
গত পঁচিশ বছরে আমাকে ছবির শুটিংয়ের জন্য ভারতবর্ষের নানান জায়গায় যেতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে তিনটে ছবিতে-গুপী গাইন বাঘা বাইন, সোনার কেল্লা আর জয় বাবা ফেলুনাথ। বীরভূমের গ্রাম, বেনারসের অলিগলি আর ঘাট, সুদূর পশ্চিম রাজস্থানের মরু অঞ্চল, সিমলার বরফের পাহাড় ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় শুটিং করতে গিয়ে আমাদের যে সব অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারই কয়েকটার কথা বলা হয়েছে এই বইতে।
সুতরাং সত্যজিতের একজন ভক্ত হিসেবে, তার সিনেমার অনুগত দর্শক হিসেবে যে কেউ গণশত্রু বা শেষ বয়সের বাকি দুটো ইনডোর সিনেমার সেট নিয়ে, ক্যামেরার কাজ নিয়ে অনুযোগ করতে পারে। এই সিনেমায় সত্যজিৎকে পুরোপুরি ক্যামেরার গৎবাঁধা ব্যাকরণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। কিছু ধরাবাঁধা ক্লোজআপ, মিডশটের ভেতরেই আটকে ছিল পুরো সিনেমা। ক্যামেরা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করেননি পরিচালক। এমনকি শেষ দৃশ্যে যখন ঘরের বাইরে ডাক্তার গুপ্তের সমর্থনে জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন প্রগতিশীল মানুষেরা, তখন শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডে মিছিলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মিছিল দেখানোর মতো বাড়তি ঝামেলায় যাননি পরিচালক। গণশত্রুর সেটে সত্যজিতের দিকনির্দেশনার একটা ভিডিও রয়েছে ইন্টারনেটে।
ঐ ক্লিপে দেখা যায় তিনি বসে, দাঁড়িয়ে তার কুশীলবদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তার কথা বলায় আর আগের মতো জোর নেই, কিছুটা যেন জড়িয়েও যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, ফ্রেম ঠিক করে দিচ্ছেন বটে, কিন্তু বেশিরভাগ কাজ তার সহকারীরাই করছে। তবে গণশত্রুর প্রাণ ক্যামেরা বা সিনেমাটোগ্রাফিতে নয়, বরং সংলাপে আর গল্পে। সবসময় যে প্রকৃতি আর পরিবেশ দিয়ে সিনেমার গল্পকে বলতে হবে, তা মানতে নারাজ সত্যজিৎ। বরং কখনো কখনো মানুষের মুখের ছবি, তার প্রতিক্রিয়া, ভাষা এসবও সর্বোচ্চ ভাব প্রকাশ করতে পারে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ও তা নিয়ে স্বার্থের রাজনীতি সেসময় যেমন ছিল, তা আজও বহাল তবিয়তেই আছে। সত্যজিৎ কি জানতেন, শুধু পানি বা পরিবেশ দূষণ নয়, ধর্মের বাড়াবাড়ি নিয়ে তার এই সিনেম্যাটিক কটাক্ষপাত আজও প্রাসঙ্গিক হবে? ধর্মের প্রতি অন্ধভক্তি আজও যে আমাদের সমাজে নিয়মিত কলুষ সৃষ্টি করছে, তা জানতে পারলে সত্যজিৎ হয়তো অবাক হতেন না।গণশত্রুর সমাপ্তিলগ্নে স্টকমানের মতোই ডাক্তার অশোকও নিজেকে সত্যের লড়াইয়ে সম্পূর্ণ একা আবিষ্কার করেন, ভীষণ আক্ষেপে তাকে বলতে শুনি, “আর সংগ্রামের শক্তি নেই।”
স্টকমানের সাথে অশোকের পার্থক্য হলো অশোক পুনরায় তার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক এই সময়ে এসে, আমাদের সমাজের এই ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্বে অশোকের চেয়ে স্টকমানকে বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় যেখানে সত্যের সারথিরা বারবার পরাভূত হচ্ছেন। আর আমাদের রাজনৈতিকদের অবস্থা হয়েছে কিছুটা ডাক্তারবাবুর মতো। না, অশোক গুপ্তের দেশপ্রেমের বিন্দুমাত্র বোধও এদের মধ্যে নেই। কিন্তু এনাদের দশাও অশোকবাবুর বলা আরেকটি সংলাপের মতো, “আমি জনগণের শত্রু হতে পারি, কিন্তু আমার অনেক বন্ধু।” রাজনীতির পিণ্ডি চটকানো এই মানুষগুলো আসলেই অনেক সময় জনগণের শত্রু হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তারপরও তারা তাদের চারপাশে হরিদাসদের মতো অনেক বন্ধু পেয়ে যায়। কী নিদারুণ সিনেম্যাটিক বৈপরীত্য!
শেষ করব সিনেমার একেবারের শেষ দৃশ্যটি দিয়ে। ডাক্তার গুপ্তের বাড়ির বাইরে তার নামে জয়ধ্বনি উঠেছে। বাড়ির বৈঠকখানায় মিডশটে দেখানো হচ্ছে খুশিতে উদ্বেলিত ডাক্তার তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, “আমরা এখানেই থাকব, এখানেই তো আমার কাজ।” এরপর ট্র্যাকিং শটে ক্যামেরা বৈঠকখানা থেকে সরে গিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে টেবিলের ওপর পাশাপাশি রাখা স্টেথোস্কোপ ও চরণামৃতের বোতলে স্থির হলো। এরপর জুম করে এই দুটো আপাত দ্বান্দ্বিক বস্তুকে ফোকাস করল ক্যামেরা। তারপর কয়েক সেকেন্ড স্থির থেকে দৃশ্যটিকে কালো করে ফেড আউট করা হলো। ঠিক এখানেই সত্যজিৎ তার সিগনেচার রাখলেন। এই দৃশ্যটিই তার সিনেমার চূড়ান্ত বার্তা- ধর্ম আর বিজ্ঞান সবসময় পাশাপাশি থাকবে, এ অগত্যা। আর এই দুই উপাদান পাশাপাশি থেকেই আমাদের সমাজকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিবে। সত্যজিৎ কিন্তু শটটাকে ফ্রিজ করেননি, তাহলে হয়তো বলা যেত ধর্ম আর বিজ্ঞান পাশাপাশি চললে আমাদের সমাজের বিকাশও থেমে যাবে। তার সিনেমার থিম ছিল আশা। ডাক্তার গুপ্তের জয়ের আশাই তাকে তার সংগ্রামের পথে এতদূর টেনে এনেছিল। তাই সেই আশার জয়গান গেয়েই সত্যজিৎ তার সিনেমা শেষ করেছেন।