ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে বাইরের দেশগুলোর মৌলিক পার্থক্যের প্রশ্নে খুব সম্ভবত যে প্রসঙ্গটি সামনে আসবে, তা হলো নারী স্বাধীনতা। শুধু দৈহিক লিঙ্গের কারণেই মানবজাতির একটি অংশকে কীভাবে শারিরীক, মানসিক ও ইচ্ছের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হয় তার স্পষ্ট উদাহরণ এ নারীরা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সে বাস্তবতার প্রকৃতি আরো বেশি প্রকট। পোশাক থেকে শুরু করে ঘর থেকে বের হবার সময় পর্যন্ত নির্ধারিত তাদের জন্য। স্বাবলম্বী একজন নারীরও স্বেচ্ছায় জীবন-যাপনের অধিকারকে এখানে অনেক সময় ব্যঙ্গ করা হয় ‘নারীবাদী’ নাম দিয়ে। বাস্তবতারই এহেন দৃশ্যেরই উপস্থাপন দেখা যায় থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার সিনেমায়।
স্বাধীনচেতা এক নারীকে ঘিরে গল্পের আবর্তন। কেন্দ্রীয় চরিত্র রুবা হক; গল্পের শুরুতে যাকে দেখা যায় সরু অন্ধকার গলি ধরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হেঁটে যেতে। শুরুতেই এক ধাক্কা। প্রেক্ষাপট যখন ঢাকা, তখন রাতের অন্ধকারে একা একা শহরে হেঁটে বেড়ানো মেয়েটির পরিচয় কী? কেনই বা সে ভীত কদমে হেঁটে চলেছে রাস্তায়? ‘মার্জিত’ বলে পরিচিত পোশাক পরিহিত মেয়েটিকে যখন স্বাভাবিক ভাবনার কোনো কাতারেই ফেলা যাচ্ছে না, তখন প্রশ্নের দোলাচলে দ্বিধান্বিত দর্শককে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন খোদ টহলরত পুলিশরা।
রুবা এখন থানায়। পুলিশ কর্মকর্তার একের পর এক ছুটে আসা প্রশ্নের উত্তরের সাথে সাথে সমাধান হচ্ছে সকল দ্বন্দ্বের। রুবার সাথে মুন্না নামের একজনের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আছে, মুন্না এখন জেলে। পারিবারিকভাবেও সম্পর্কের নানা দোলাচলে থাকা রুবা যেতে পারছে না বাবা কিংবা মায়ের কাছে।
থানায় রাত কাটিয়ে আসার পর খালাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি আশ্রয় নেয় রুবা। কিন্তু সেখানেও খালাতো বোনের শ্বাশুড়ির কুশ্রী আচরণের পরও থেকে যেতে হয় তাকে। কেননা সেখানে একটি মেয়ের একা থাকার জন্যে বাসা পাওয়া দুষ্কর। অনবরত চেষ্টায়ও একটা বাসা যোগাড়ে অপারগ হয়ে শেষ অব্দি রুবাকে নিতে হয় ছলনার আশ্রয়। একজন বাড়িওয়ালার চরিত্রহীনতার সুযোগ নিয়ে বাসা ঠিক করে ফেলে রুবা। সাথে পূর্বপরিচিত একজনের সাহায্যে চাকরিও ঠিক করে ফেলে সে।
গল্পের মোড় এবার ঘুরতে থাকে। টিকে থাকার সংগ্রাম করে চলা মেয়েটি এখন স্বাবলম্বী। ঘটনাচক্রে বর্তমানে সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা পুরাতন বন্ধু তপুর সাথে যোগাযোগ ঘটে পুনরায়। অনেকটা ইচ্ছে পূরণ দেবতার রূপেই হাজির হয় সে। বাসা থেকে শুরু করে মুন্নার কেস পর্যন্ত সবটাতে রুবাকে সাহায্য করে করে তপু৷ জীবনসংগ্রাম শেষ হলে শুরু হয় মানসিক জটিলতা। গল্পটি এবার হয়ে ওঠে একটি মেয়ের ইচ্ছেপূরণের গল্প।
মানুষ দ্বন্দ্বে পূর্ণ জীবনে শেষ আশ্রয় হিসেবে ভালোবাসাকেই বেছে নেয়। মুন্নার সাথের মানসিক ও শারিরীক দূরত্বের এ সুযোগ ও নিঃস্বার্থ বন্ধু হিসেবে সবটা জুড়ে তপুর সহযোগিতা স্বাভাবিকভাবেই রুবার মাঝে তার প্রতি এক আকর্ষণের সৃষ্টি করে। কিন্তু জটিলতা বাড়ে যখন ইচ্ছেপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ১৩ বছরের রুবা মানসিকভাবে বারবার বিবেকের রূপ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় রুবার। মায়ের প্রতি যে ক্ষোভ আর ঘৃণা থেকে এতগুলো বছরের দূরত্বকে মেনে নিয়েছে সে, যে ঘৃণার কারণে চরম সংকটেও মায়ের মুখাপেক্ষী হতে দেয়নি; সেই একই ঘটনা এখন ঘটছে তার নিজের জীবনেই।
এরই মাঝে তপুরই সহযোগিতায় মুন্না বেরিয়ে এলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। এতদিন দূরে থেকে যে বিবেকের টানাপোড়নে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে রুবা আজ তারই সামনে দাঁড়িয়ে সে। একদিকে রুবা অন্যদিকে মুন্না, কাকে বেছে নেবে সে? ‘নৈতিকতা’কে না কি মনের ইচ্ছেকে?
পরিচালক সূক্ষ্মভাবে ফ্রেমিং, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়কে তুলে ধরেছেন। প্রথম অংশে পুরনো ঢাকা ও দ্বিতীয় অংশের শ্যুটিং নতুন ঢাকায় করার মাধ্যমে সচেতনভাবে এ দুইয়ের মাঝে একটি পার্থক্য তৈরি করেছেন তিনি। পুরনো নগরের মানুষকে রূপায়ন করা হয় সনাতন ও সংকীর্ণ চেতনার মানুষ হিসেবে। সেখানকার সরু ও নোংরা গলিও হয়ে ওঠে তারই প্রতীক। আর তার ঠিক বিপরীতে দেখা যায় নতুন ঢাকাকে। বিভিন্ন সুযোগের হাতছানি ও নতুন করে বাঁচার প্রতীক হয়ে ওঠে ঝা-চকচকে ফ্ল্যাট ও পরিচ্ছন্ন রাস্তা। অর্থাৎ পুরনো ঢাকার সনাতন চিত্রের বাইনারি অপজিশন হিসেবে প্রতীকায়িত করা হয় নতুন ঢাকাকে। আবার পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেও নিজেদের অনুভূতি দাবিয়ে রাখার যে প্রচেষ্টার সময় পেছনে বাজে রণসঙ্গীত ‘চল, চল চল…’ এর বাজনা। এভাবে নানান উপায়ে পরিচালক ঘটনাকে করে তুলে ধরেন আরো বাস্তবসম্মতরূপে। সবচেয়ে চমৎকারভাবে রূপায়ন করা হয়েছে জেল থেকে ফেরার পর রুবার সাথে মুন্নার দৈহিক সম্পর্ক দেখানোর সময় একদিকে বিছানার ওপর থাকা ম্যানিকিনের সাথে মুন্না, অপরদিকে বাইরের ঘরে বসে ১৩ বছর বয়সী ও বর্তমান রুবার কথোপকথন। শরীরের সাথে মনের যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে ওঠে তারই চিত্রায়ন করা হয়েছে এ দৃশ্যের মাধ্যমে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ২০০৯ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় নির্মিত হয় সিনেমাটি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উপন্যাস অবলম্বনে পরিচালক ও আনিসুল হক যৌথভাবে স্ক্রিপ্ট রচনা করেন। সিনেমাটি ৮৩তম অস্কারে অংশগ্রহণের জন্যেও মনোনীত হয়।
“থাকার জন্যে বসুন্ধরার চেয়ে ভালো জায়গা ঢাকায় নাই, বুঝলি?” – সিনেমাটিতে দেখা যায় এরকম স্যুডো-বিজ্ঞাপন। মুন্নার জেল থেকে ফিরে আসাটাও অনেকটা টাকার জোরই মনে হয়। ১৪ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী রীতিমত চুটকিতেই এখানে বেরিয়ে আসে তপুর হস্তক্ষেপে। এ নিয়ে আলাপের সূত্রে বলা যায়, সমাজকাঠামোয় আজ সারা বিশ্ব যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে অর্থনীতিই সবকিছুর পরিচালক। থাকার জন্যে ভালো বাসা হোক কিংবা অপরাধের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হোক, অর্থই যে এখন সবখানে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে তা বলাই বাহুল্য।
তবে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন যে আদতে একজন মানুষকে সক্রিয় করে তোলে তা সিনেমাটিতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। প্রথমে কোনো চাকরি ছাড়া দিশেহারা রুবা আশ্রয়ের জন্যে হাজারও অপমান সহ্য করেছে। অথচ স্বাবলম্বী হবার পর তার পুরনো বন্ধুর কথা মনে পড়েছে এবং তার সাথে যোগাযোগের পথ প্রশস্ত হয়েছে। আবার মুন্নার প্রতি তার পূর্ববর্তী অনুভূতির পরিবর্তনের কথা মুন্নাকে জানানোর জন্যে রুবার যে সাহসের প্রয়োজন ছিল তারও মূল কারণ সক্রিয়তা। তবে আজও সমাজে নারীর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর ভয়ঙ্কর বক্তব্য শুনতে হয় তারও উপস্থাপন হয়েছে একাধিকবার।
প্রযুক্তির উৎকর্ষে আধুনিক জীবনে সম্পর্কের জটিলতা, বিবেক ও মনের মাঝের দ্বন্দ্বে অনবরত যুদ্ধ করা এক নারীর সমাজে টিকে থাকা সংগ্রাম ও মানসিক জটিলতার গল্প থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। বিবেক ও ইচ্ছের দোলাচলে সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা জীবনে নিয়ত সংগ্রামই ছিল সিনেমাটির মূল কাহিনী, যা পরিচালক তার নির্মাণশৈলী ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সফলভাবে।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/