জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বা অন্তর্দর্শনের এক অনন্য উপায় বই পড়া। একটি ভালো মানের বই আপনার জীবনকেই বদলে দিতে পারে। বড় বড় জ্ঞানী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বা সফল ব্যবসায়ীদের জীবনেও রয়েছে বইয়ের ইতিবাচক প্রভাব। তারা বই পড়েন এবং বইকে অন্তরে ধারণ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে জনপ্রিয় করে তোলা মার্ক জাকারবার্গ জীবনে একটি লক্ষ্য পূরণের জন্যই কাজ করে চলেছেন, তা হলো বৈশ্বিক যোগাযোগ স্থাপন। তার এই লক্ষ্য পূরণে ফেসবুকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি আরও দৃঢ় যোগাযোগ স্থাপনের জন্য গড়ে তুলেছেন ফেসবুক ভিত্তিক বই সংঘ। এ সংঘের উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ইতিহাস, প্রযুক্তি ইত্যাদি সম্পর্কিত বইগুলোর তালিকা তৈরি করে দুই সপ্তাহে একটি বই পড়ে শেষ করা।
এই পাঠের সময়ে পড়া তালিকার কিছু বইকে ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ সকলের পড়া উচিত বলে মনে করেন। তেমনই কয়েকটি বই নিয়েই এখন কথা হয়ে যাক।
১) দ্য মুকাদ্দিমাহ – ইবনে খালদুন
ইসলামিক ইতিহাস রচয়িতা হিসেবে খ্যাত ইবনে খালদুন ১৩৭৭ সালে ‘দ্য মুকাদ্দিমাহ’ বইটি রচনা করেন। আরবি ভাষায় রচিত বইটির ইংরেজি অনুবাদকৃত বইটির নাম ‘দ্য ইন্ট্রোডাকশন’। ঐতিহাসিক নথিপত্র ঘেঁটে বিশ্লেষণ করে সহজ এবং সাবলীল ভাষায় গোঁড়ামিগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি মানবতার উন্নয়নে পার্থিব উপাদানগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে এই বইটিতে। এটি রচনার মাধ্যমে জ্ঞানের অনেকগুলো পথের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
খালদুন রচিত বইটির প্রথম পরিপূর্ণ অনুবাদ করেছিলেন ফ্রাঞ্জ রোসেনথাল। এই অনুবাদগ্রন্থটি ১৯৫৮ সালে তিনটি খন্ডে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রকাশের পরপরই প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছুদিনের মাঝেই সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলে। এর প্রায় ১০ বছর পর ১৯৬৯ সালে রোসেনথালের সেই অসাধারণ অনুবাদগ্রন্থটির প্রথম সংক্ষেপিত সংস্করণ এক খন্ডে প্রকাশিত হয়। এই সংক্ষেপিত সংস্করণে রোসেনথালের অনুবাদের মূল অংশগুলোর সাথে সমসাময়িক ব্রুস বি. লরেন্সের কিছু ভূমিকাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বইটি পড়লে আপনি ইসলামিক ইতিহাসের সূচনালগ্নের তথ্যের পাশাপাশি আদিম যুগ এবং মধ্যযুগের ইতিহাসগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে যাবেন।
২) দ্য নিউ জিম ক্রো – মাইকেল অ্যালেক্সান্ডার
ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এবং গণ অধিকার বিষয়ক আইনজীবী মাইকেল অ্যালেক্সান্ডার তার বইটিতে সেই আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণপ্রথার মর্মান্তিকতা তুলে ধরেছেন। এই বর্ণপ্রথার পুনরুত্থানের ফলে মিলিয়ন মিলিয়ন আফ্রিকান- আমেরিকান, অর্থাৎ নিগ্রো শ্রেণীভুক্তদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তারপর তাদেরকে যখন কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তখন গণ অধিকার আইনের পরোয়া না করেই তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের অধিকার।
বইটিতে নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে খুব বড় ভূমিকা পালন করেছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত হবার পর বইটি ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এর সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় নাম ধরে রাখে।
৩) হোয়াই ন্যাশনস ফেইল – ড্যারন অ্যাসেমগলু এবং জেমস রবিনসন
অর্থনীতিবিদ ড্যারন অ্যাসেমগলু এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেমস রবিনসনের ১৫ বছরের গবেষণার মূল বিষয় তুলে ধরা এই বইটি ২০১২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটিতে দু’ধরনের সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এবং কোনটির ক্ষেত্রে কী ধরনের অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাকারবার্গের মতে, বইটি পড়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার উৎস সম্পর্কে জানা যাবে।
৪) ওয়ার্ল্ড অর্ডার – হেনরি কিসিঞ্জার
৯১ বছর বয়সী হেনরি কিসিঞ্জার তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাময় জীবন থেকে আন্তর্জাতিক ঐকতান এবং বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার গোড়াপত্তন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি তুলে ধরেছেন ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ বইটিতে। এতে বিশ্লেষিত হয়েছে একুশ শতকের চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে, আর তা হলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, আগ্রাসন, দ্বন্দ্ব ইত্যাদিকে সামনে রেখে বিনিময়যোগ্য আন্তর্জাতিক বিন্যাস সৃষ্টি করা যায়।
ইতিহাসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে যার মতো করে সভ্যতাকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। প্রত্যেকেই নিজেদেরকে বিশ্বের কেন্দ্র মনে করেন এবং কিছু বিন্যাস প্রকরণ নির্ধারণ করেন সকলের জন্য প্রযোজ্য বলে। যেমন ধরুন চীন। তাদের শাসকেরা তাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী বৈশ্বিক বিন্যাস নির্ধারণ করে সকলের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। ইউরোপিয়ান শাসকেরা এসে আবার সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিলেন। আবার ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় সবকিছু আবার পাল্টে গেল। এভাবেই সত্যিকার অর্থে ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ বলে কিছুই নেই। এই বিষয়টি খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন হেনরি কিসিঞ্জার।
জাকারবার্গ বলেন,
“সারা বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি সম্পর্কে এই বইটি। আমাদের সন্তানদের জন্য এমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং আমি সেই দিনগুলো সম্পর্কেই ভাবছি”।
৫) দ্য ভ্যারাইটিস অব রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স – উইলিয়াম জেমস
টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্টারনেট এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলোসোফি’র বর্ণনানুযায়ী, আমেরিকান দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী দার্শনিক উইলিয়াম জেমস। এই বইটিতে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কীভাবে মানুষের মাঝে ধর্মীয় চেতনা গড়ে ওঠে এবং কীভাবে মানুষ এই ধর্মীয় চেতনাকে জীবনের অর্থ করে তোলে, চলার পথের শক্তিতে পরিণত করে এবং সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
বেশ কিছু অধ্যায় রয়েছে বইটিতে। জাকারবার্গ বলেন,
“যখন আমি ‘স্যাপিয়েন্স’ অধ্যায়টি পড়ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল মানুষের জীবনে ধর্মীয় অনুভূতি সত্যিই অদ্ভুত, এবং এটি এমন একটি বিষয়, যা সম্পর্কে জানতে অনেক গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে”।
৬) ক্রিয়েটিভিটি ইনকর্পোরেটেড – ক্যাটমুল
পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ডিজনির অধিষ্ঠাতা ক্যাটমুল। ছোটবেলা থেকেই ডিজনির মতো প্রতিষ্ঠানের অ্যানিমেটর হবার স্বপ্ন দেখে বড় হওয়া মানুষটি ডিজনির অধিষ্ঠাতা। নিঃসন্দেহেই বেশ দীর্ঘ যাত্রা। এই যাত্রাকালে তাকে অ্যানিমেটর বলা চলে না, কেননা তিনি তা ছিলেন না! বরং তিনি এমন ধরনের প্রযুক্তির নকশা করেছে, যার মাধ্যমে পিক্সারের চলচিত্রগুলোকে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ক্যাটমুল তার ক্যারিয়ারকে উৎসর্গ করেছেন অন্যদের ভেতরের সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তুলতে। ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে সহকর্মীদের সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া ভালো হয়। এতে করে অন্যের মাঝে সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তোলা যায়। ক্যাটমুল নিজে কখনো বড় বড় উক্তি দেননি, বরং এমন কাজ করে চলেছেন যাতে অন্যেরা তাকে নিয়ে বা তার কাজ সম্পর্কে বলে থাকেন।
পিক্সার স্টুডিওকে গড়ে তোলা, সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, নিজের ভিতরের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে অন্যের সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তোলা এবং সাফল্যপ্রাপ্তির গল্প ক্যাটমুয়েল তার নিজের ভাষায় তুলে ধরেছেন তার এই বইটিতে। সম্পূর্ণ বইয়ে তার মূল বক্তব্য ছিল, কর্মীদের স্বাভাবিক সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে। এই বইটি পড়ে এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে যে মহান উদ্যোগী মনোভাব কাজ করে সে সম্পর্কে যেমন জানতে পারবেন, তেমনি জানতে পারবেন কর্মক্ষেত্রে সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনশক্তির জাগরণ সম্পর্কে।
৭) দ্য স্ট্রাকচার অব সায়েন্টিফিক রেভল্যুশন – থমাস কু’ন
পদার্থবিদ রচিত দর্শন বিষয়ক বই যদি পড়তে চান, তাহলে এই বইটি অবশ্যই পড়তে হবে এমন। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত এ বইটিতে খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে বিজ্ঞানের আবির্ভাব এবং আধুনিক যুগের সূচনা কীভাবে হলো। সামজিক উন্নয়নে কীভাবে বিজ্ঞানের পথ বিস্তৃতি হয়েছে এবং হচ্ছে তা জানতে এই বই সকলেরই পড়া উচিত।
ফিচার ইমেজ- forbes.com.mx