“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী- ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।।”
মানবতার স্বার্থে, মানবতার কল্যাণে কিছু মানুষ সারা জীবনই নিজের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে কাজ করে গিয়েছেন। সেসব মহৎহৃদয় মানুষের জন্যই আজও হয়তো পৃথিবীর কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে সকাল হলে নতুন ধানের মিষ্টি ঘ্রাণে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ঠিক তেমনই আবহমান বাংলার এক প্রাচীন রীতিতে চলমান গ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে ভূষিত ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের প্রতিটি মুহূর্তে।
প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত সুলতানী, মোঘল, নবাবী কিংবা ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে এদেশ শাসন করে গেছে। কিন্তু প্রাচীন বাংলার গ্রাম্য সমাজের খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। যে সমাজব্যবস্থা হাজার বছর ধরে বাংলায় টিকে ছিল, ইংরেজ আমলে তাতে একটু একটু পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও মানুষের মধ্যে গেঁথে যাওয়া কুসংস্কার, প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব, হানাহানি কিংবা বিদ্বেষ সবসময়ই বয়ে এসেছে সময়ের হাত ধরে।
বাংলার মানুষের জাগরণ এবং সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে চিন্তা করে যাওয়া এক ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এ উপন্যাসে তিনি একটি প্রত্যন্ত গ্রামের গল্প বলেছেন। সেখানে অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কারে জর্জরিত একদল মানুষ জমিদারি প্রথার দরুন শোষিত হওয়াকেই নিজেদের ভবিতব্য ধরে নিয়ে বেঁচে রয়েছে কালের প্রবাহে। এর মাঝে ইংরেজদের কর্তৃক অত্যাচারের উদাহরণ তো ছিলই। উপন্যাসে ইংরেজ সরকারের নজরবন্দী যতীনের আটক থাকার ব্যাপারে বলা হয়েছে,
“উনিশশো চব্বিশ খ্রিষ্টাব্দে বিশেষ ক্ষমতাবলে ইংরেজ সরকারের প্রণয়ন করা আইন- আটক আইন। নানা গণ্ডি বন্ধনে আবদ্ধ করিয়া বিশেষ থানার নিকটবর্তী পল্লীতে রাজনৈতিক অপরাধ সন্দেহে বাঙালী তরুণদের আটক রাখার ব্যবস্থা হইয়াছিলো। বাংলা সরকারের সেই আটক-আইনের বন্দী যতীন।”
উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অসামান্য নিপুণভাবে বাংলার মানুষের সংকীর্ণ মনোভাব তুলে ধরেছেন। যেমন, কিছু কিছু মানুষ শুধু নিজের স্বার্থে ইংরেজদের পক্ষ নিতেও দ্বিধাবোধ করেনি।
এই মানুষগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই জীবনে নতুনভাবে বাঁচার কিংবা নতুন স্বপ্ন দেখার প্রবণতা নেই। সবাই আছে প্রকৃতির দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে। এদের মাঝেও দুয়েকজন মানুষের জন্ম হয়, যারা সকলের জন্য হয়ে ওঠে আশার আলো। পণ্ডিত দেবনাথ ঘোষ তেমনই একজন। তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এবং গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখে সবসময় পাশে থাকার এক অসামান্য গুণের জন্য একসময় তিনি সাধারণ গ্রাম্য পণ্ডিত থেকে ক্রমেই সকলের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠেন।
উপন্যাসের শুরুতে পণ্ডিতের উপস্থিতি কম থাকলেও এক পর্যায়ে তিনি সবক্ষেত্রেই তার দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। এমনকি গ্রামে কলেরা শুরু হলে যখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না, তখন তার উপস্থিতি যেমন তার চরিত্রের দৃঢ়তা ফুটিয়ে তোলে, তেমনি এই কাজের জন্য তাকে সর্বস্ব বিসর্জনও দিতে হয়। কলেরায় মারা যায় তার স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তান। মূল গল্পের বাইরেও কেন্দ্রীয় চরিত্রদের ঘিরে লেখকের বিভিন্ন রূপক প্রকাশক গল্পের আনয়ন মূল গল্পের স্রোতকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। তরুণ মজুমদার ১৯৭১ সালে উপন্যাসটি নিয়ে একটি সিনেমাও করেছেন।
তবে পণ্ডিত দেবু ঘোষের সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল গ্রামের মানুষের প্রতি জুলুম করা শ্রী হরি পালের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। অনিরুদ্ধ কিংবা জগন ডাক্তারও শ্রী হরির বিরুদ্ধে যথেষ্ঠ সোচ্চার ছিল, কিন্তু পণ্ডিতের শক্তিশালী অবস্থান তাকে বাকিদের থেকে এগিয়ে রেখেছে। পুরো উপন্যাস জুড়ে শ্রী হরি পাল, পরে যিনি নাম পরিবর্তন করে শ্রী হরি ঘোষ করেছেন, ছিলেন কেন্দ্রীয় খলনায়কের ভূমিকায়। তার জীবনের লক্ষ্যই ছিল, গ্রামের মানুষদের উপরে তার প্রভাব বিস্তার করা এবং এজন্য যত রকমের কুটিল পন্থা অবলম্বন করা যায়, সে চেষ্টা করা।
গ্রামের কেন্দ্রে অবস্থিত চণ্ডীমণ্ডপ নিয়ে তার কুটিল রাজনীতি এবং রাতের অন্ধকারে পুরো একটি গ্রাম্য পাড়ায় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি তার চরিত্রের ভয়াবহতার রূপ স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে। ক্রমশ বড়লোক হয়ে ওঠা শ্রী হরি, তার টাকার জোরে একসময় পুরো গ্রামের জমিদারি কিনে নিলে গল্পের মোড় অনেকটাই ঘুরে যায়। তখন পণ্ডিতকে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করে, যা পাঠককে সাধারণ একটি গ্রামেও রাজনৈতিক শক্তির প্রবল রূপ প্রকাশ করে।
দুর্গা চরিত্রটি সকলকে আরেকবার ভাবাবে। সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে তার জীবিকার উৎস সঠিক না হলেও পণ্ডিতের পরে মানুষের সেবা করায় তার অবদান ছিল অসামান্য। গ্রামের মানুষের বিপদে-আপদে তার এগিয়ে যাওয়া এবং নিজের উপার্জিত টাকায় অন্যকে উপকার করার প্রবণতা চরিত্রটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এদের বাইরেও মহামহোপাধ্যায় শিবশেখর ন্যায়রত্ন কিংবা দ্বারকা চৌধুরীর মতো শুভ্র ব্যক্তিত্বের মানুষের উপস্থিতি পাঠকের মনে গ্রামের প্রবীণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ ছাপ রেখে যাবে সহজেই।
তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ এবং ‘পঞ্চগ্রাম’ দুটি ভিন্ন উপন্যাস হিসেবে আমরা পড়ি। আসলে কিন্তু দুটো দুই খণ্ডে লেখা একই উপন্যাস। এক অংশের নাম ‘চণ্ডীমণ্ডপ’, অপর অংশের নাম ‘পঞ্চগ্রাম’। এই দুই অংশের একসঙ্গে সাধারণ নাম ‘গণদেবতা’। কিন্তু ‘চণ্ডীমণ্ডপ’ অংশের নামকরণ হয় ‘গণদেবতা’ আর সে নামেই উপন্যাসখানা মশহুর। কিন্তু তা বলে ‘গণদেবতা’ এই খণ্ডাংশের নয়, দুই খণ্ড মিলে নাম। পঞ্চগ্রামের বর্ণনা দেওয়া যাবে অন্য কোনো একদিন।
উপন্যাসের মাঝামাঝি সময়ে, কলকাতা থেকে আসা যতীন ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এদেশের যুব সমাজের প্রতিবাদের প্রতীক। গ্রামের অন্যান্যদের চেয়ে শিক্ষায় অনেক এগিয়ে থাকা এই চরিত্রটি বুঝেছিল, পণ্ডিত দেবু ঘোষকেই এগিয়ে আসতে হবে পিছিয়ে পড়া এই গ্রাম্য সমাজের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে।
ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই গ্রামটির মতোই এদেশের মানুষকে টিকে থাকতে হয়েছে প্রকৃতির সাথে কিংবা শোষকগোষ্ঠীর সাথে লড়াই করে। তারাশঙ্করের সহজ-সরলভাবে ফুটিয়ে তোলা জীবনের বর্ণনা ‘গণদেবতা’ থেকে আমরা গণমানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে নিজেদের দায়িত্ববোধেরই শিক্ষা পাই।