জোহানেসবার্গ বিমানবন্দর থেকে অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইট ধরবেন স্টিভেন স্মিথ। মাসছয়েক আগেই ঘরের মাঠে জিতেছেন অ্যাশেজ। ব্যাটেও ছুটেছে রানের ফোয়ারা। তবুও শূন্য চোখে, ভাবলেশহীন হয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। তার চেহারাই বলে দিচ্ছিল, কিছুই ঠিক নেই তার। নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে এস্কর্ট করে নিয়ে যাচ্ছেন, চারপাশে ক্যামেরার শাটারের আওয়াজ। আবহটা এমন, যেন কোনো অপরাধীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
দেশে ফিরলেন স্মিথ। ডাকলেন সংবাদ সম্মেলন। অবশ্য সেই সংবাদ সম্মেলনটা ছিল একেবারেই আলাদা। যেখানে ছিল না সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন, ছিল না উইকেট-কন্ডিশন, ম্যাচের পরিকল্পনা নিয়ে জিজ্ঞাসা। আত্মবিশ্বাসে টুইটুম্বুর স্মিথ কাঁদলেন, ক্ষমা চাইলেন সবার কাছে। আলাদা সংবাদ সম্মেলনে একই কাজ করেন সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। ক্যামেরন ব্যানক্রফটও হেঁটেছেন সতীর্থদের পথে। এর আগে তিনজনেরই জুটেছে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা।
অথচ এর আগ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। যতক্ষণ না ব্যানক্রফট ট্রাউজার থেকে স্যান্ডপেপার বের করেছিলেন।
এই ঘটনার মূল সূতিকাগার কেপ টাউন টেস্ট। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের টেস্ট সিরিজের শেষ ম্যাচটাই বদলে দিয়েছিল অজিদের ক্রিকেটের গতিপথ। বল টেম্পারিং। সেই টেস্টে বল টেম্পারিং করেছিলেন ব্যানক্রফট। শিরিষ কাগজ বা স্যান্ড পেপার দিয়ে বলের বিকৃতি ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি, যা ধরা পড়ে টেলিভিশন ক্যামেরায়। সাথে যুক্ত ছিলেন স্মিথ-ওয়ার্নারও। সেই বল টেম্পারিং নির্বাসনে পাঠিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক, সহ-অধিনায়ক ও নতুন ওপেনারকে। সাথে পদত্যাগ করেছিলেন তৎকালীন কোচ ড্যারেন লেহম্যানও।
অস্ট্রেলিয়ার আছে ঐশ্বর্য্যমন্ডিত ক্রিকেটীয় রুপকথা, আছে বিশ্বজয়ের হরেক রকম গল্প। আছে সোনায় মোড়ানো ইতিহাস দম্ভ, দাপট, ক্রিকেটকে লালন করে পেশাদারিত্বের চূড়ান্ত নির্দশনও। এ কারণেই বলা হয় ‘মাইটি অস্ট্রেলিয়া’। সেই মাইটি, বিশ্বজয়ী, মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার গায়েই লেগেছে বল টেম্পারিংয়ের কালিমা। দেশটির কিংবদন্তি ক্রিকেটার থেকে শুরু করে সাধারণ ভক্ত-সমর্থকরাও মুখ ফিরিয়ে নেয় ক্রিকেট থেকে। বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড়; লজ্জা, প্রতারণা শব্দের আধিক্য।
সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়া। পেরিয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি, পাড়ি দিয়েছে বন্ধুর পথ, চড়াই-উৎড়াই। মন জয় করে ফিরে পেয়েছে ভক্তদের সমর্থন। অস্ট্রেলিয়ার এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটাই তুলে এনেছে স্ট্রিমিং সাইট অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও। ‘দ্য টেস্ট: এ নিউ এরা ফর অস্ট্রেলিয়াস টিম’। ১২ মার্চ মুক্তি পেয়েছে আট পর্বের এই ওয়েব সিরিজটি।
সাধারণত ড্রেসিংরুম, ড্রেসিংরুমের আবহ, টিম মিটিং, ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। গ্যালারি কিংবা টিভির সামনে বসে আর কতটুকুই বা টের পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই জিনিসগুলোরই পরিষ্কার একটা ছবি দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছে অ্যামাজন প্রাইম।
২০১৮ সালের অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে শুরু করে সর্বশেষ অ্যাশেজ সিরিজ, প্রায় ১৬ মাস ধরে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটকে ক্যামেরাবন্দি করেছেন অ্যামাজন প্রাইমের এক ক্রু। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ছুটে বেড়িয়েছেন ইংল্যান্ড, ভারত ও আরব আমিরাত। তারই ধারণ করা ভিডিওতে উঠে এসেছে অস্ট্রেলিয়ার এই রোলার কোস্টার রাইডের বিরাট একটা অংশ, যার বেশিরভাগ জুড়েই ছিল পর্দার আড়ালের দৃশ্যগুলো।
স্ট্র্যাটেজি মিটিং, ক্রিকেটারদের ভ্রাতৃত্ববোধ, দল নির্বাচন, ড্রেসিংরুম, ম্যাচের চিত্রপটের সঙ্গে বদলে একই ড্রেসিংরুমের বদলে যাওয়া, স্বপ্নের ব্যাগি গ্রীন, ক্রিকেটারদের জবাবদিহিতা, নেট সেশন, প্র্যাকটিস, টিম হোটেল, সাফল্যে উল্লাস আর ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়া ক্রিকেটাদের চেহারা, ক্রিকেটের সার্বিক উন্নয়নে কীভাবে কাজ করেন সাবেক ক্রিকেটাররা; সবই উঠে এসেছে আট পর্বের এই ওয়েব সিরিজে।
আট পর্বের এই ওয়েব সিরিজের শুরুটা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে দিয়ে। বল টেম্পারিং ইস্যুতে ভূলুন্ঠিত সম্মান পুনরুদ্ধারে ভগ্নপ্রায়, মানসিকভাবে ভেঙে পড়া এক দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি ২০১৮ সালের মে মাসে। দায়িত্ব নিয়েই বলেন, অস্ট্রেলিয়াকে আবারও গর্বিত করতে চান তিনি। অন্যদিকে স্মিথের রেখে যাওয়া টেস্ট অধিনায়কের চেয়ারটা দেয়া হয় অনভিজ্ঞ টিম পেইনকে। অথচ এর মাস দুয়েক আগেও ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ছক আঁকছিলেন তিনি মনে মনে। এক ঘটনা একইসাথে বদলে দিয়েছে অনেকগুলো মানুষের জীবন।
সেই অনভিজ্ঞ পেইনের ওপরই অস্ট্রেলিয়ার ভরসার হাত। পেইন নিজেও জানতেন কত বড় দায়িত্ব উঠেছে তার কাঁধে। যে দায়িত্ব পালন করেছেন ডন ব্র্যাডম্যান, ইয়ান চ্যাপেল, অ্যালান বোর্ডার, মার্ক টেলর, স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্কদের মতো ক্রিকেটাররা। ঠিক সেই কারণেই পেইন বলেছেন, “অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ।“
নতুন করে সব শুরু হলেও, ফলাফল কিছুতেই পক্ষে আসছিল না অজিদের। দায়িত্ব নেয়ার পর ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রথম সিরিজেই হোয়াইটওয়াশ হয় অজিরা। এমন একটা সিরিজ হারের পর কেমন হয় ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থা, ম্যাচ-পরবর্তী প্রেজেন্টেশনে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ট্রফি নিয়ে উল্লাস করতে দেখা ঠিক কতটা বেদনাদায়ক? ঘরের মাঠ কিংবা বিদেশ সফরে ম্যাচের পর ম্যাচ, সিরিজের পর সিরিজ হেরেছে অস্ট্রেলিয়া। একটা জয়ের জন্য কতটা মরিয়া ছিল সবাই? সব প্রশ্নের উত্তর ধীরে ধীরে পেয়ে যাবেন অ্যামাজন প্রাইমের এই ওয়েব সিরিজে।
এই ওয়েব সিরিজের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে আছে অ্যাশেজ সিরিজ, স্মিথ-ওয়ার্নারের টেস্টে প্রত্যাবর্তন। ইংল্যান্ডের দুর্গখ্যাত এজবাস্টনে অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে স্মিথ যখন ব্যাট করতে নামেন, বার্মি আর্মির দুয়োধ্বনিতে কেঁপে ওঠে চারপাশ। তবুও স্মিথ দমে যাননি। টেস্টে ফিরেই সবচেয়ে বড় মঞ্চে উজাড় করে দিলেন নিজের সেরাটা। হাঁকান সেঞ্চুরি, দ্বিতীয় ইনিংসেও তিন অঙ্কের ম্যাজিক সংখ্যা বসে স্মিথের নামের পাশে।
বার্মি আর্মি ছাড়াও স্মিথের যুদ্ধটা জমে উঠেছিল গতি তারকা জফরা আর্চারের সঙ্গে। লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্টে জমে ওঠে সেই লড়াই। একের পর এক বাউন্সারে স্মিথকে নাজেহাল করে দেন আর্চার। মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়লেও, আবার ফিরে আসেন স্মিথ। স্মিথের হার না মানা মানসিকতার একটা স্বচ্ছ ছবি দেখতে পাওয়া যাবে ‘দ্য টেস্ট’ ওয়েব সিরিজের মোড়কে করা ডকুমেন্টারি ফিচারে।
এছাড়া মার্নাস লাবুশেনের উত্থান, হেডিংলিতে স্টোকসের বীরত্বগাঁথা ব্যাটিং। আলাদা করে বলতে হবে ২০১৯ বিশ্বকাপের কথা। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে বিশ্বকাপযাত্রা থামে অস্ট্রেলিয়ার। সেই প্রতিশোধ অস্ট্রেলিয়া নিয়েছে ২০ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করে।
সিরিজের আট পর্বে যা যা দেখানো হয়েছে, তাতে ক্রিকেটভক্তদের মনের খোরাক হবেই। তবে ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থা, প্রথমবারের মতো ড্রেসিংরুমে যাওয়া, আরাধ্য ব্যাগি গ্রীনকে মাথায় চাপানো, সমালোচনা, অসম্ভব চাপকে জয় করে টানা পারফর্মের গল্প, পরিবার থেকে দূরে থাকার দিনগুলোকে হয়তো আরো কিছু স্ক্রিনটাইম দিতে পারতেন ডিরেক্টররা।
সর্বোপরি, সিরিজের নামকরণ সার্থক। সত্যিকারের টেস্ট উৎরেই ছুটেছে অস্ট্রেলিয়া। পেছনে ফেলে এসেছে দুঃস্মৃতি, ‘শেইম’, ‘চিটার’ তকমা, পেয়েছে নতুন সূর্যের দেখা। টিম পেইন হয়ে উঠেছেন নেতা। তাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছেন জাস্টিন ল্যাঙ্গার। একজন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারের জন্য সবচেয়ে বৈরি পরিবেশ ইংল্যান্ড, আর তার চেয়েও বৈরি বিখ্যাত বার্মি আর্মি।
সেখানে ‘ভিলেন’ হিসেবে অ্যাশেজ সিরিজ শুরু করে স্মিথ মাঠ ছেড়েছেন তাদেরই স্ট্যান্ডিং ওভেশন আর হাততালির আওয়াজে। এভাবেই বদলে গেছে অস্ট্রেলিয়া, ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো মুকুট। হয়েছে অজিদের পুনর্জন্ম। শুরু হয়েছে এক নতুন যুগ। স্মিথের ভিলেন হওয়া থেকে শুরু করে ওভালের সবুজ মাঠে অ্যাশেজ ট্রফি নিয়ে উল্লাস। এই দুই ঘটনার মাঝের চিত্রগুলোই অস্ট্রেলিয়ার ‘দ্য টেস্ট’।