অপরাধীদের কি আলাদা কোনো জগৎ আছে? যদি থেকে থাকে, সেই জগতেও কি এই পৃথিবীর মতো প্রতিনিয়ত আলো আঁধারের খেলা চলতে থাকে, নাকি নিকষ কালো আঁধারে সর্বদা ডুবে থাকে সেই জগৎ? উত্তর হয়তো একেকজনের কাছে একেকরকম শোনাবে। কারো কাছে মনে হবে— সেই জগত আলো ঝলমলে, মৃত্যুই সেখানে একমাত্র আঁধার। বাইরের জাঁকজমকময় পৃথিবী তাদের অন্তরাত্মাকে ক্রমাগত কলুষিত করার দরুণ সবাই সেখানে আত্মতৃপ্তির সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত, একটুকরো প্রশান্তিই যেন সেখানে মুখ্য বিষয়। এটা তাদের অধিকার, অপরাধ নয়। আবার কেউ বলতে পারে, আঁধার তাদের গ্রাস করে নিয়েছে। যে আঁধারে তাদের জন্ম, সেই আঁধারেই মৃত্যু নিহিত! তারা অসুস্থ ,তারা অপরাধী।
আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। অতীত রোমন্থন করলে বুঝতে পারি, ছোট-বড় বেদনাগুলোই আমার জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতেও আমাকে পথ দেখাবে বেদনা। আমি সেই পথে হাঁটি না এখন, রাস্তাগুলো আপনা-আপনিই সামনে নিয়ে যায় আমাকে। সময়ের বিবর্তনে এগিয়ে যাই সম্মুখপানে। এই বেদনার ওপর ভিত্তি করেই সব কর্মপরিকল্পনা ঠিক করি আমি। আমিই সেই ছায়াশ্বাপদ। সাক্ষাৎ যমদূত। আর আমার সঙ্গী বেদনা। মৃত্যু অবধি বেদনা! আঁধার যাত্রা শুভ হোক বন্ধুগণ।
শন ম্যাকেভয়, পেশায় একজন খুনের গোয়েন্দা। এক হিমশীতল রাতে ডেনভার পুলিশ তার নিজ গাড়িতে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে। গাড়িতে পাওয়া যায় একটি চিরকুট, যাতে লেখা— “নেই সেথা স্থান বা সময়।” অদ্ভুত এই লেখার মর্মার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয় পুলিশ। আনুষঙ্গিক সকল আলামত ঘেঁটেও কোনো কূলকিনারা খুঁজে না পেলে আত্মহত্যার তকমা লাগিয়ে কেসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য, টেরেসা লফটন নামের এক সুন্দরী তরুণীর দ্বিখণ্ডিত লাশের তদন্তের দায়িত্বে ছিল শন ম্যাকেভয়।
জ্যাক ম্যাকেভয় শন ম্যাকেভয়ের যমজ ভাই। রকি মাউন্টেইন নিউজে দীর্ঘদিন ধরে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে আসছে সে। পেশাদারিত্বের খাতিরে কিংবা রক্তের টানে; আপাতদৃষ্টিতে শনের মৃত্যু তার কাছে আত্মহত্যা মনে হলেও তার অন্তরাত্মা সেটা মানতে নারাজ। তাই পুলিশ তদন্তের ইস্তফা টানলেও নিজ উদ্যোগে তদন্ত শুরু করে দেয় জ্যাক। তার অনুসন্ধানী নজরে উঠে আসে প্রায় একই প্যাটার্নের আরো চারজন গোয়েন্দার আত্মহত্যার ঘটনা। এবার চিরকুটের মর্মার্থ উদ্ধারে সফল হয় জ্যাক। আত্মহত্যার ঘটনা কাকতালীয় মনে হলেও লেখক এডগার অ্যালান পো’য়ের কবিতার পঙক্তি লিখে যাওয়া কোনোভাবেই কাকতালীয় হতে পারে না। উল্লেখ্য, মারা যাওয়ার পূর্বে প্রত্যেকেই শনের মতো বীভৎস কোনো খুনের কেসের তদন্তে নিয়োজিত ছিল।
অচেনা একাকী পথে, যাত্রী
যেখানে শুধু শঙ্কা আর ভয়
এক ছায়াশ্বাপদ, যার নাম রাত্রি
আঁধারে রাজাসনে রয়।
সদ্য আগন্তুক আমি এ দেশে
পেরিয়ে এসেছি ছায়াময়
এক সীমান্ত আজ পৃথিবীর শেষে
অদ্ভুত, নেই সেথা স্থান বা সময়।
এবার পুরোদমে তদন্তে নামে এফবিআই। শর্তসাপেক্ষে তাদের দলে ঠাঁই হয় জ্যাকের। তার বুদ্ধিদীপ্ত তদন্তের পর এটা সহজেই অনুমেয় যে, আত্মহত্যা নয়, বরং তাদেরকে খুন করা হয়েছিল। এফবিআই-এর ধারণা, কোনো সিরিয়াল কিলারের বলির পাঁঠা তারা। এফবিআই সিরিয়াল কিলারের নাম দেয় ‘পোয়েট’। পোয়েটকে ধরার জন্য কোমরবেঁধে নেমে পড়ে তারা। ওঁৎ পেতে থাকা পোয়েটও যেন থেমে নেই! শুরু হয়ে যায় আলো-আঁধারির খেলা। শেষ হাসি কে হাসবে? আলো, নাকি আঁধার? জানতে হলে পড়তে হবে মাইকেল কনেলির ক্রাইম থ্রিলার উপন্যাস ‘দ্য পোয়েট’।
মাইকেল কনেলি পেশাগত জীবনে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে তিনি পুরোদস্তুর লেখক। মূলত ক্রাইম এবং মিস্ট্রি ঘরানার থ্রিলার লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দ্য পোয়েটকে তার সেরা কাজগুলোর মধ্যে একটি ধরা হয়। বইয়ের ক্যাটালগিং ওয়েবসাইট গুডরিডসে ক্রাইম রহস্য ঘরানার সেরা ১০০ বইয়ের তালিকায় বেশ উপরের দিকে জায়গা করে নেয় বইটি। ‘দ্য পোয়েট’ প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৯৬ সালে। তাই গল্পের প্লট সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে লেখা, বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির ছাপ গল্পে দেখা যায় না।
শুরুর দিকে গল্প কচ্ছপগতিতে এগোতে থাকলেও পাঠক কাহিনীর যত গভীরে প্রবেশ করবে, মস্তিষ্কে পাঠের ক্ষুধা সমানুপাতে তত বাড়বে। এই বইয়ের কাহিনী হয়তো আর দশটা টানটান উত্তেজনাময় থ্রিলার ধাঁচের না, বইয়ের পরতে পরতে উদ্বেগ-উত্তেজনা সৃষ্টি হবে না, কিন্তু তারপরও পাঠক ম্যাজিকের মতো শেষ অব্দি ডুবে থাকবে। কিছু না থেকেও যেন মনে হবে অনেক কিছু আছে। গল্পের পেছনেও একটা গল্প থাকে, যা পাঠকের মনোজগত নাড়িয়ে দেবে, কল্পনার জগতকে করবে প্রসারিত। মায়াশক্তির জালে বন্দী পাঠক গল্পের শেষাংশে এসেও জাল ছিঁড়ে বেরোতে পারবে না।
ক্রাইম রিপোর্টার জ্যাক ম্যাকেভয়কে গল্পে প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা যায়। বিষণ্নতায় ছেয়ে যাওয়া এই চরিত্রের মাঝে পেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট। প্রিয়জন হারানোর শোকে বিচলিত না হয়ে সুনিপুণ দক্ষতায় মরে যাওয়া কেসগুলোয় প্রাণের সঞ্চার করে সে। কর্মক্ষেত্রে নিজের খ্যাতি সুনাম অর্জনের ব্যাপারেও সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়, যা পাঠকের নজরে একটু দৃষ্টিকটু ঠেকলেও, গতিময় এই পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত মনে হবে।
জ্যাকের পর নারী চরিত্রে থাকা এফবিআই এজেন্ট র্যাচেলের কথা না বললেই নয়। গল্পে অনেকটা জুড়েই দেখা যায় তাকে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, বিবাহবিচ্ছেদ, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি একটা চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি করে। নারীরা যত চেষ্টাই করুক না কেন, দিনশেষে এই সমাজ, এই পৃথিবী শুধু পুরুষদেরই মনে রাখবে, পুরুষরাই এখানে সর্বশক্তিমান! শুধু র্যাচেল নয়, যেকোনো নারীর জন্য এই ধ্রুব সত্য মেনে নেওয়া অনেক পীড়াদায়ক, যা পরবর্তীতে ক্ষোভ এবং ঘৃণায় পরিণত হয়।
উইলিয়াম গ্ল্যাডেনকে খানিকটা রহস্যময় মনে হয়, তার সম্পর্কে বেশি কিছু না বলাই শ্রেয়। এছাড়া বাদবাকি যে চরিত্রগুলোর আবির্ভাব ঘটে, সবাইকে ঠিকঠাকই মনে হয়। গল্পের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার, ততটুকুই লেখক বর্ণনা করেছেন, কমতি কিংবা বাহুল্য ছিল না।
এবার অনুবাদ প্রসঙ্গে আসা যাক। পেটমোটা এই বইটির অনুবাদ করেন সালমান হক। সালমান হকের অনুবাদের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত, বিশেষ করে নিক পিরোগের ‘থ্রি এ এম’ সিরিজের মাধ্যমে। সাধারণত সাবলীল অনুবাদ করতে দেখা যায় তাকে। ভাষাশৈলীর ব্যাপারেও যথেষ্ট সচেতন থাকেন। গুরুগম্ভীর শব্দের ব্যবহার খুব একটা করেন না। দ্য পোয়েটের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। সালমান হকের সাবলীল অনুবাদ পাঠকের কাছে খুব সহজেই পাঠযোগ্য মনে হবে।
মানুষের জীবনের থেকে বড় রহস্য আর কিছু হতে পারে না। আজ হয়তো আপনি হাসছেন, কাল হয়তো আবার কাঁদবেন। মুদ্রার দুই পিঠ যেমন কখনও এক হয় না, মানুষের জীবনের গ্রাফও সবসময় সোজা থাকে না। ধাপে ধাপেই পরিবর্তিত হয়। জীবনে চলার পথে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সমস্যাবিহীন জীবন হতে পারে না। সমস্যাগুলো উৎরে ওঠার মধ্যেই জীবনের সৌন্দর্য নিহিত থাকে। আর জীবন সুন্দর হয়ে উঠলে, সুন্দর হবে এই সমাজ।
বই: দ্য পোয়েট
লেখক: মাইকেল কনেলি
অনুবাদক: সালমান হক
প্রকাশনী: বাতিঘর
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৪৭৬