হলিউড সিনেমায় প্রাচ্যবাদের প্রকটতা: প্রেক্ষিত লরেন্স অভ অ্যারাবিয়া

পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘসময় ধরে প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যকে প্রত্যক্ষ শাসন করেছে। এই সময়টুকুর ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয় এখানকার স্থানীয়দের জন্য। কারণ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী কখনোই তাদের অধিকৃতদের ‘মানুষ’-এর চোখে দেখে না।

উপনিবেশবাদের ইতিহাস সবসময় অত্যাচারের ও শোষণের ইতিহাস। এ শোষণ ও অত্যাচার তখনই থামে, যখন শোষিতদের ঘুরে দাঁড়িয়ে চরম প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

কিন্তু শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি কি কখনো পরিবর্তিত হয়? উপমহাদেশকে দুশো বছর শাসন করে যে জাত্যাভিমান, আভিজাত্যবোধ পশ্চিমাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, তার রেশ কি এ সময়ে এসেও একেবারেই মুছে গেছে?

এ প্রশ্নের উত্তর তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু প্রাচ্য তথা এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যকে পশ্চিমারা যে এখনো একটি আপাত-নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে- তা প্রমাণিত হয় এসব অঞ্চলকে নিয়ে তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে।

পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রাচ্য, ও মধ্যপ্রাচ্যকে এই গুরুত্বহীন, নেতিবাচক, ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখাটাই হচ্ছে প্রাচ্যবাদ বা অরিয়েন্টালিজম। অরিয়েন্টালিজমের প্রবক্তা এডওয়ার্ড সাইদ। তিনি এ নামে একটি বইও লিখেন ১৯৭৮ সালে।

আজকের আলোচনাটি সিনেমা নিয়ে হলেও এটি কোনো সিনেমা রিভিউ নয়। বরং এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে কীভাবে হলিউডের লরেন্স অভ অ্যারাবিয়া সিনেমাটিতে অরিয়েন্টালিজমের বিভিন্ন উপাদান প্রোথিত রয়েছে। এ লেখাটি পড়ার আগে সিনেমাটি দেখে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

পশ্চিমাদের শিল্পকর্মে প্রাচ্যবাদের ছাপ; Jean-Léon Gérôme: The Snake Charmer, 1870

অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদ প্রসঙ্গে যে জলজ্যান্ত উদাহরণগুলো সর্বাগ্রে আমাদের মানসপটে ফুটে ওঠে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হলিউড সিনেমা। প্রাচ্যকে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যকে অপকৃষ্ট হিসেবে দেখানোর এই প্রবণতা থেকে হলিউডের যেকোনো গড়পড়তা নির্মাতা হতে শুরু করে ক্যাথরিন বিগলো অথবা স্টিভেন স্পিলবার্গের মতো মহামহিম ডিরেক্টর – কেউই কম যান না।

পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে মুসলিমরা সবসময় ‘আলাদা’, ‘বিপদজনক’, ‘বহিরাগত’, ‘ঊন’। এই তথাকথিত অরিয়েন্টদের ‘উদ্ধার’ করার দায়িত্বটা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। সিনেমা থেকে কিছু নমুনা তুলে ধরলেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে-

  • আরবদের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশরা লড়াই করছে (লরেন্স অভ অ্যারাবিয়া, ১৯৬২),
  • সোমালিয়ার মানুষদেরকে স্বৈরশাসনের যাঁতাকল থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ অব্দি দিয়ে দিচ্ছে মার্কিন সেনারা (ব্ল্যাক হক ডাউন, ২০০১),
  • আফগানিস্তানে দশ-বারো বছরের শিশুও কালাশনিকভ রাইফেল কাঁধে চলাফেরা করে (লোন সার্ভাইভর, ২০১৩),
  • ইরাকি মা তার শিশু সন্তানকেও যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করে (আমেরিকান স্নাইপার, ২০১৪)
  • অথবা কলোনিয়াল ইন্ডিয়ার সাধুরা তাদের উপাসনায় মানুষ খুন করে, জ্যান্ত মানুষের বুকে হাত ঢুকিয়ে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে আনে (ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য টেম্পল অভ ডুম, ১৯৮৪) 

হলিউড বা ব্রিটিশ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এরকম ভুরি ভুরি অরিয়েন্টালিস্ট ফিল্মের উদাহরণ দেওয়া যায়। আসলে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে হলিউড এখন পর্যন্ত যেসব ফিল্ম মধ্যপ্রাচ্যের পটভূমিতে নির্মাণ করেছে, সেগুলোতে অরিয়েন্টালিস্ট উপাদান থাকবে না, তা প্রায় অবিশ্বাস্য।

ইরাক, সিরিয়ায় মার্কিন আধিপত্যের কারণে এখানে সিনেমা বানানোর প্রচুর উপাদেয় মশলা বিদ্যমান, তাই পরিচালকরাও ঝাঁপিয়ে পড়েন ইয়াঙ্কি সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে এসব নিয়ে সিনেমা বানাতে। কারণ এই সেন্টিমেন্ট-কে ঝালিয়ে নেওয়ার একটা বড় হাতিয়ার হচ্ছে এসব যুদ্ধভিত্তিক অরিয়েন্টালিস্ট সিনেমাগুলো।

সেজন্য আমরা দেখি, ইতিহাসের পিণ্ডি চটকে মাইকেল বে পার্ল হারবার (২০০১) বানালেও তাতে খুব একটা বিচলিত হতে দেখা যায়নি মার্কিন দর্শকদের। সেজন্য ইতিহাসের সত্যতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি ঠিকই পুঁজি উঠিয়ে এনেছেন স্রেফ অরিয়েন্টালিজম আর মার্কিন সেন্টিমেন্টের জোরে।

শুধু মধ্যপ্রাচ্য, আরব বা মুসলিমদেরকেই নয় বরং এশিয়ার যেকোনো দেশকেই বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয় এসব অরিয়েন্টালিস্ট হলিউড ফিল্মে। যেমন হোয়াইট হাউজ আক্রমণ করলে তার পেছনে কলকাঠি নাড়ে কোনো নর্থ কোরিয়ান সন্ত্রাসী অথবা মার্কিন গোয়েন্দাকে মুখোমুখি হতে হয় কোনো ধুরন্ধর রাশান গুপ্তচরের।

লরেন্সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পিটার ও’টুল; Image Courtesy of Columbia Pictures Corporation

১৯৬২ সালে মুক্তি পায় ডেভিড লিন পরিচালিত ব্রিটিশ সিনেমা লরেন্স অভ অ্যারাবিয়া। বাঘা বাঘা সব অভিনেতার সমন্বয়ে তৈরি এই সিনেমাটি ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা, প্রত্নতাত্ত্বিক, লেখক থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স-কে নিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরবদের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এডওয়ার্ড লরেন্সের ঘটনাবহুল যুদ্ধদিনের গল্পই এই সিনেমার মূল প্রতিপাদ্য।

লরেন্সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পিটার ও’টুল। এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন অ্যালেন গিনেজ, জ্যাক হকিংস, অ্যান্থনি কুইন, ওমর শরীফ, ক্লড রেইনস প্রমুখ। সর্বকালের অন্যতম ক্লাসিক সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হলেও লরেন্স অভ অ্যারাবিয়াও প্রাচ্যবাদের ছোঁয়া থেকে বের হতে পারেনি!

দীর্ঘ চার ঘন্টার এই সিনেমাটিতে আরবদের দেখানো হয়েছে ন্যায়নীতিবোধহীন, উষ্ট্রচারী, নৃশংস হিসেবে। সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শরিফ আলি। সিনেমায় তার প্রবেশ দৃশ্যটির কথা বিবেচনা করা যাক। লরেন্স ও তার আরব গাইড মরুভূমিতে চলার সময় ক্লান্ত হয়ে একটি কূপ থেকে পানি পান করছেন।

এমন সময় তারা খেয়াল করেন, মরুভূমির দিগন্তরেখা থেকে উটে চড়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে কেউ একজন। যত কাছে আসছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে তার অবয়ব। তার উটের চারপাশে রাজ্যের কাপড় ঝোলানো, হাতে বন্দুক। তার পরনে আরবদেশীয় পোশাক, মুখে হিজাব। তবে সেই পোশাক দেখতে নিতান্ত করুণ, ধুলোর আস্তরণ পড়া।

শরিফ আলি যখন দেখেন লরেন্সের গাইড তার দিকে পিস্তল উত্তোলন করছেন, তখন তিনি তাকে গুলি করেন। তারপর তার ব্যাখা হিসেবে বলেন, গাইডটি তার কূপ থেকে জলপান করেছিল। দৃশ্যটি প্রায় এরকম।

গুলি চালানোর পর শরিফ আলি তার উট থামালেন। উট বসে পড়ল, তিনি উট থেকে নেমে মৃদুমন্দ পদক্ষেপে মৃতদেহটির কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর লরেন্সের দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন কন্ঠে বললেন,

– সে মরে গেছে।

– লরেন্স: হ্যাঁ। কেন (অবাক ও ক্রোধপরায়ণ গলায়)?

– (মুখাবরণ সরাতে সরাতে) এটা আমার কুয়ো।

– লরেন্স: এই কুয়োর পানি দিয়ে আমি তৃষ্ণা মিটিয়েছি।

– আপনাকে স্বাগতম।

– লরেন্স: সে (গাইড) আমার বন্ধু ছিল।

– ও ব্যাটা (অবাক গলায়)?

– লরেন্স: হ্যাঁ, ও!

মরুভূমির দিগন্তরেখা থেকে উটে চড়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে কেউ একজন; Image Courtesy of Columbia Pictures Corporation

দৃশ্যটিতে একজন আরব হিসেবে শরিফ আলিকে লোভী, স্বার্থপর, নৃশংস, খুনী, বর্বর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কেবল তার জলাধার থেকে অনুমতি না নিয়ে পানি পান করার জন্য সে আরেকজন আরবকে নির্দ্বিধায় খুন করে ফেলেছে এবং তা নিয়ে তার কোনো অনুশোচনা নেই। বরং তার ভাবলেশহীন কন্ঠে ‘হি ইজ ডেড’ বলা এটাই প্রমাণ করে যে, আরবদেশে এগুলো খুবই সাধারণ ঘটনা।

কিন্তু আবার ঠিক তাকেই পরমুহূর্তে লরেন্সকে তার কুয়ো থেকে পানি পানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে দেখি। শরিফ আলি তার স্বগোত্রীয়কে পানি পানের জন্য হত্যা করছে, আবার একজন বিদেশিকে একই কাজের জন্য স্বাগতম জানাচ্ছে – এই বৈপরীত্য পশ্চিমাদের চোখে খুবই স্বাভাবিক, কারণ একজন আরব একজন পশ্চিমাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেবে এবং ওই সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে তারা কৃতার্থ হয়ে যাবে; এটাই পশ্চিমাদের চিরায়ত ধারণা এবং এটাই প্রাচ্যবাদ।

দামেস্কাস দখলের আগে আকাবা দখলের জন্য লরেন্স জনা পঞ্চাশেক আরব ও শরিফ আলিকে নিয়ে নেফুদ মরুভূমি পাড়ি দিতে শুরু করে। আকাবা এর আগে ব্রিটিশরা নৌপথে দখল করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়, তাই লরেন্স ভেবেছিল স্থলপথে মরুভূমি পার হয়ে গিয়ে আচানক আকাবা দখল করে নেবে।

এই পাড়ি দেওয়ার সময় গাসিম নামক একজন আরব ক্লান্ত হয়ে উট থেকে পড়ে যায়। দলের বাকিরা যখন তার অনুপস্থিতি টের পায়, ততক্ষণে অনেক পেছনে পড়ে গেছে সে। তখন লরেন্স শরিফের কাছে জানতে চান, দলটি কেন থেমে গাসিমের জন্য অপেক্ষা করছে না। শরিফের উত্তর ছিল, থেমে কী হবে; কাল মধ্যদুপুরের মধ্যেই সে মরে যাবে!

তখন লরেন্স পেছনে ফিরে গিয়ে নাসিমকে উদ্ধার করার প্রস্তাব করেন। শরিফ আলি তাতে রাজি হন না। এ সময় আমরা আরেকজন আরবকে আমরা বলতে শুনি, ‘গাসিমের (মরার) সময় হয়ে গেছে, লরেন্স। এটাই তার নিয়তি।’

এদের কারও কথা না শুনে লরেন্স ঠিক করেন তিনি নিজে গিয়ে গাসিমকে ফিরিয়ে আনবেন এবং শেষ পর্যন্ত লরেন্স আর গাসিম দুজনই বহাল তবিয়তে ফিরে আসেন। আরবদের মাঝে লরেন্সের সম্মান বহুগুণে বেড়ে যায়।

শরীফ আলী (ডানে); Image Courtesy of Columbia Pictures Corporation

এই দৃশ্যটি সিনেমার প্রাচ্যবাদের চেতনায় ভরপুর আরেকটি অংশ। এখানে মৃত্যুই গাসিমের নিয়তি বলার মধ্য দিয়ে আরবদেরকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিসেবে যেমন প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনি গাসিমকে মরুর বুক থেকে ফিরিয়ে আনতে না যাওয়ার মাধ্যমে আরবদেরকে বন্ধু বা সহযাত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসাবোধ না থাকা এক নিষ্ঠুর জাতি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য, ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতির ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিপরীত চেতনা তুলে ধরা হয় আমেরিকানদের ক্ষেত্রে। যারা নেভি সিলদের নিয়ে বানানো হলিউডের অ্যাক্ট অভ ভ্যালর (২০১২) সিনেমাটি দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করবেন, শেষদিকে সন্ত্রাসীদের সাথে গুলিবিনিময়ের সময় একজন সিল কমান্ডো একটা পিনখোলা গ্রেনেডের ওপর শুয়ে প’ড়ে তার বাকি সতীর্থদের বাঁচান। জেনে রাখতে পারেন, এই সিনেমায় সন্ত্রাসীদের যে দুজন মাস্টারমাইন্ডকে দেখানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন চেচেন মুসলিম।

এই বৈপরীত্যের মূলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে একধরনের স্টিরিওটাইপ চিন্তাভাবনা, যার গোড়াপত্তন ঘটেছিল ঔপনিবেশিক যুগের শুরুতে। কারণ যেদিন থেকে পশ্চিমারা এই অঞ্চলগুলোতে উপনিবেশ গড়া শুরু করল, তখন থেকে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ভাবের উদয় হলো। তারা নিজেদেরকে উপনিবেশায়িত-জনগণের ত্রাতা হিসেবে বিচার করতে লাগলেন। সেজন্যই আমরা দেখি আরব যোদ্ধা গাসিমের জীবনদাতা হচ্ছেন শ্বেতাঙ্গ লরেন্স!

শুধু রক্ষাকর্তার ভূমিকাটাতেই সন্তুষ্ট থাকেনি তারা, অধিকৃতদের শিক্ষার ভারটাও সেই সাথে সাথে নিয়ে নিয়েছে উপনিবেশকারীরা। তাই তো শরিফ আলিকেও আমরা দেখি পশ্চিমা বই পড়ে রাজনীতি শেখার প্রয়াস করতে।

ওসব না শিখলে পরে যে তাদের সাথে প্যাঁচে কুলোবেন না, তা ঠিক বুঝে নিয়েছিলেন শরিফ আলি। কিন্তু তাতেও যে শেষরক্ষা হলো না। দামেস্কাস দখলের পরও তো তার ক্ষমতা আয়ত্তে রাখতে পারেননি আরবরা। শরিফ আলিও তার পশ্চিমা রাজনীতির জ্ঞানের জোরে কোনো সুরাহা করতে পারেননি। তাই তো দখলীকৃত দামেস্কাস ছেড়ে সবাই আবার ফিরে গেছেন।

অর্থাৎ আরব বর্বররা স্রেফ মরুভূমির কুয়োর দখল নিয়েই রাজনীতি করতে পারবে, শহর বা দেশ চালানোর মতো ঘিলু তাদের এখনো জন্মায়নি!

পিটার ও’টুল; Image Source: HANDOUT – KRT

প্রাচ্যবাদ উগরানোর একটি অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে পোশাক। প্রাচ্যবাসীর পোশাক কিম্ভূতকিমাকার বললেও কম বলা হয় না! পোশাকের ছিরি দেখলে হাসি পায়, উদ্ভট সব মুখোশ পরে, অদ্ভুত সব অলংকার গায়ে দেয়- এসব হচ্ছে পোশাক দিয়ে প্রাচ্যবাদ চর্চার উপায়।

লরেন্স যখন গাসিমকে মরুভূমি থেকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে আসেন, তখন শরিফ আলিও মুগ্ধ হয়ে যান। সেরাতে তিনি লরেন্সের ব্রিটিশ ইউনিফর্ম পুড়িয়ে দিয়ে লরেন্সকে আরবীয় আলখাল্লা পরতে দেন। তা পরে লরেন্স প্রায় আরব সেজে যান, লম্বা সাদা জোব্বায় শ্বেতাঙ্গ লরেন্সকে দারুণ মানিয়ে যায়, তিনি সঙ্গীদের অভিবাদন গ্রহণ করেন।

এই দৃশ্যটি দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এখানে আরবীয় পোশাককে সম্মানের আসনে বসানো হয়েছে। এমনকি আমরা লরেন্সকে সেই পোশাক স্বাভাবিকভাবে নিতে দেখি। এমনকি লরেন্স তার কমান্ডার জেনারেল অ্যালেনবির সামনেও সেই আরবীয় পোশাকই পরে থাকেন।

কিন্তু এডওয়ার্ড সাইদ এটাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মনে করেন প্রাচ্যের মাঝে কোনো পশ্চিমার বাস করা, প্রাচ্য সংস্কৃতিকে জানার প্রশংসা করা বা জানার চেষ্টা করার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে প্রাচ্যদের নিয়ে আরও গভীরভাবে জানা, যেন তাদেরকে আরও বেশি করে বশীভূত করে রাখা যায়।

আকাবা দখলের আগে ক্যাম্পে অবস্থানকালীন একরাতে ক্যাম্পের মধ্যে একটি খুন হয়। একজন আরব যোদ্ধা আরেকজন আরব যোদ্ধাকে মেরে ফেলে। শরিফ আলি’র একজন অনুসারী, অডা’র একজন অনুসারীকে খুন করে এবং তাদের নিয়মানুযায়ী খুনীকেও গুলি করা হবে।

বিব্রত লরেন্স তখন আরেকজন আরবের কাছ থেকে পুরো ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করেন। লরেন্সের প্রশ্নের জবাবে ওই আরব উত্তর দেন, ‘চৌর্যবৃত্তি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কোনো কারণ ছাড়াই হচ্ছে এসব।’

এই সংলাপটির মাধ্যমে বা পুরো দৃশ্যটির মাধ্যমে এটাই প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে যে, আরবদের মধ্যে বিচারব্যবস্থার বালাই নেই বা তারা বর্বর ও অসভ্য। এখানে এত বছর ধরে চলে আসা আরবদের যে ‘কোড অভ অনার’, তা পশ্চিমাদের কাছে বর্বর ঠেকেছে, কারণ তাদের মতে নিজেদের আইন ও বিচার ব্যবস্থাই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ।

Theatrical release poster by Howard Terpning

এই ঘটনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আমরা লরেন্সকে দেখি। আরবদের দুপক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে লরেন্স সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। এই দৃশ্যটি দর্শকের মনে এই বার্তাই দেয় যে, আরবরা স্থূলবুদ্ধি ও হিংসুটে। তাদের নিজেদের সমস্যা সমাধানের মুরোদ নেই। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি পরিষ্কার উদাহরণ এই দৃশ্যটি।

একই দৃশ্যে আরবদের পোষাক কালো ও লরেন্সের পোষাক সাদা রেখে লরেন্সকে বেশি প্রাধান্যবিস্তারকারী চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার কালো ও অন্ধকারের মিশেলে আরবদের ‘বিপজ্জনক’ করে তুলে ধরা হয়েছে।

আরবরা লরেন্সের নেতৃত্বে তুর্কি ট্রেইনের ওপর আক্রমণ করে এবং জয়লাভ করে। দৃশ্যটিতে লরেন্সকে আমরা দেখি বিধ্বস্ত ট্রেনের ছাদের ওপর দাঁড়াতে। হাই-অ্যাঙ্গেল-শট ব্যবহার করে এই দৃশ্যে লরেন্সকে আবারও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়। সাদা জোব্বা পরিহিত লরেন্সের ওপর মরুসূর্যের আলো – দৃশ্যটি অবশ্যই তৃপ্তিদায়ক।

এসময় দেখা যায়, নিচ থেকে একজন আহত তুর্কি সৈন্য লরেন্সকে কাঁপা কাঁপা হাতে মাউজার সি৯৬ পিস্তল দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করছে। তুর্কি সৈন্যটিকে লো-অ্যাঙ্গেল-শটে দেখিয়ে তার গুরুত্ব লরেন্সের ঠিক বিপরীত দৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়। এসময় তুর্কি তরুণ গুলি চালালেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লরেন্সের বাহুর চামড়া ভেদ করে চলে যায়।

এরপর আমরা দেখি লরেন্স ঘুরে সেই পতনোন্মুখ সৈনিকের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার সৈনিকটি আরও কিছু গুলি চালায়, কিন্তু লরেন্সের তাতে ভ্রুক্ষেপও হয় না। গুলিগুলো লরেন্সের চারপাশ দিয়ে চলে যায় আর লরেন্স স্রেফ ওই সৈনিকটির দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

এই দৃশ্যে আমরা লরেন্সকে দেখি ওই তুর্কি সৈনিকের আক্রমণকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিতে, ভয় না পেতে। পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা এভাবেই নেটিভ (স্থানীয়)-দের তাচ্ছিল্য করেছে আজীবন। লরেন্সের এই বীরত্ব পশ্চিমাদের মহিমান্বিত রূপের বহিঃপ্রকাশ!

১৯১৬-১৯১৮ সালের আরব বিদ্রোহ; Image Source: Library of Congress

এর পরের দৃশ্যে আরেকজন আরব এসে সেই তুর্কি সৈনিকটিকে তরবারি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। যেহেতু আরবরা তখনো তরবারি দিয়ে লড়াই করতো, সেহেতু তরবারি দিয়ে পরাস্ত শত্রুকে হত্যা করা তাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

কিন্তু এই দৃশ্যটি দেখে সেখানে উপস্থিত মার্কিন সাংবাদিককে বলতে শোনা যায়, ‘আমি এর আগে কখনো তরবারির ঘায়ে কোনো মরা মানুষ দেখিনি।’ এই সংলাপটির দ্বারা আরবদেরকে নৃশংস, তাদের যুদ্ধরীতিকে সেকেলে হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

ইতিহাসভিত্তিক সিনেমা হওয়া সত্ত্বেও অন্যসব মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফিকশনধর্মী সিনেমা থেকে কোনো অংশে কম অরিয়েন্টালিস্ট নয় লরেন্স অভ অ্যারাবিয়া। তারপরও পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ বা নব্য-প্রাচ্যবাদীদের দৃষ্টিকোণে এটি একটি নিখুঁত ক্লাসিক। সেজন্যই সিনেমাটা অস্কার জিতেছে, রজার এবার্টের মতো বিখ্যাত সিনেমা-সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে।

আরবদেশকে একটি রহস্যময়, বিপদসংকুল, অভিশপ্ত দুনিয়া হিসেবে তুলে ধরার চিরায়ত এই পশ্চিমা প্রয়াস থেকে বের হতে না পেরে লরেন্স অভ অ্যারাবিয়া শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে লরেন্স অভ ‘ডুমড’ অ্যারাবিয়া-তে। 

লরেন্স অভ অ্যারাবিয়া

পরিচালক: ডেভিড লিন

প্রযোজক: স্যাম স্পিজেল

উৎস: সেভেন পিলার্স অভ উইজডম বাই টি. ই. লরেন্স

মুক্তি: ১০ ডিসেম্বর, ১৯৬২

দেশ: যুক্তরাজ্য

ভাষা: ইংরেজি

‘উইথ লরেন্স ইন অ্যারাবিয়া’ নামের বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে- 

https://cutt.ly/ZfjXdZw

This Bangla language article is an analysis of the presence of orientalist elements in the film Lawrence of Arabia. Necessary references are hyperlinked.

Featured Image: Columbia Pictures Corporation

Related Articles

Exit mobile version