সঞ্জীবচন্দ্রের কলমে পালামৌ শহরের গল্প

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ভ্রমণ কাহিনী পালামৌ। লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রজ। এই রচনায় ফুটে উঠেছে সরকারি এক কর্মকর্তার চাকরিসূত্রে ভারতের একটি পরগনায় ভ্রমণের গল্প, সেই এলাকার মাটির গল্প, সেই এলাকার আদিবাসীদের গল্প।

পত্রিকায় পড়ে লেখকের ধারণা হয়েছিল পালামৌ যেমন তেমন শহর না হয়ে পারেই না। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে বহাল হয়ে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রম কাটলো রাঁচি থেকে পালকি বাহকদের দেখানো প্রথম পালামৌ দর্শনে। শুধুই জঙ্গল আর জঙ্গল। পালামৌ পৌঁছে আরেকবার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। গহীন সেই অরণ্য মোটেও জনবিরল নয়। সেখানে ‘কোল’ নামে পরিচিত বন্য, খাটো ও কৃষ্ণাভ মানুষগুলো কালো পাথুরে পটভূমিতে আপন খেয়ালে উন্মেলিত। প্রকৃতির এই সান্নিধ্যেই তার কলমের আঁচড়ে রচিত হয় একটি মূল্যবান উক্তি- “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”।

পালামৌ
ছবি: লেখক

কৌতূহলী, উদ্যমী ও পরিশ্রমী কোল জাতির সংসারে নারীরাই প্রধান। তারাই সংসারের চালিকা শক্তি। সেখানে পুরুষরা ঘর সামলায়, বাচ্চাদের দেখাশুনা করে, সুযোগ পেলেই আলসেমি করে। ফলস্বরূপ পুরুষরা সময়ের আগেই বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে পড়ে আর নারীরা হয়ে থাকে যৌবনের প্রতিমূর্তি। সেখানে মাদলের বাদ্যে যুবতীর দেহে কোলাহল পড়ে, তাদের গানের ‘ধুয়া’ পাহাড়ের গায়ে গিয়ে লাগে।

সেই জঙ্গলেও চোখে চোখে কথা হয়, হৃদয় হরণ হয়, ভালোবাসা পরিণতি পায়। প্রণয়ের সেই খেলা গড়ায় দুই পরিবারের মধ্যেকার মারামারি, কাটাকাটি কিংবা গালাগালিতে। মিছামিছি সেই কোন্দলের সমাপ্তি হয় বিশাল ভোজ সভায়। এই বিয়ে উপলক্ষ্যেই কারো কারো কপালে জোটে কর্জ নামক এক বিশাল বোঝা। ভয়াবহ সেই পরিণাম লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণতার সাথে।

প্র.না.ব. ছদ্মনামের আড়ালে পালামৌ লেখার শুরুতেই সঞ্জিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটা বিষয় খোলাসা করে নেন, পালামৌ এর স্মৃতিকথা অন্যদের বিশেষ করে যুবকদের ভালো লাগবে তার নিশ্চয়তা নেই। এ শুধুই বিনম্র ভদ্রতা মাত্র। তার লেখা কোনো সময়ে বা বয়সে বাঁধা নেই। সাধু ভাষায় লেখা এবং ভাষার কাঠিন্য এখনকার সাহিত্যের সাথে দাঁত কষাকষি করলেও একবার এর রস পেতেই আমি আবেগে তাড়িত তার লেখার প্রেমে। এর বেশি বলার প্রয়োজন নেই।

সঞ্জিবচন্দ্রের সমালোচনা তাই সাঝে না, অন্তত আমার সাঝে না। তবে স্বয়ং কবিগুরু যা বলার বলে দিয়েছেন অনেক আগেই, “তিনি যতটা কাজে দেখাইয়াছেন তাঁহার সাধ্য তদপেক্ষা অধিক ছিল …সঞ্জীবের প্রতিভা ধনী, কিন্তু গৃহিণী নহে।”

তারপরেও নিজে পাগলামি করেই ফেলি একটু আধটু। পাঠক হিসেবে আমি তাকে দেখেছি এক মুগ্ধ দর্শকের বেশে, যিনি প্রকৃতির রূপে মোহিত, হতবাক ও উদ্বেলিত। পাহাড়ের প্রেমে তিনি একা পড়েননি, তার পশ্চাতে তার অনুগামী অজস্র। স্বল্প পরিসরে একটি জাতির সংস্কৃতি, উৎসব, সামাজিকতা, জীবনধারা ফুটিয়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। এই মুন্সিয়ানা সঞ্জীবচন্দ্রকেই মানায়।

সেই জাতির আনন্দ-সুখ যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সাথে, একই পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তাদের দুঃখ ভরা জীবনের অব্যক্ত কথা মালা সাজিয়ে। সেই মানুষগুলোর জীবনে এখনো যে আদিম সুর সুরলিত হয়, সেই সুরে পাঠক হিসেবে আমি বুঁদ হয়ে থাকি। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ থেকে শুধুমাত্র এই গোষ্ঠির পরিচয় পাওয়াই একটি উত্তম প্রাপ্তি। বাকি সব তো আছেই।

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; Image: Public Domain/Wikimedia Commons

“বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”- এর মাধ্যমে লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন? প্রকৃতিতে সবারই একটা নির্দিষ্ট স্থান আছে, যার ভিন্ন রূপ প্রকৃতি মেনে নেয় না। সবার জন্যই একটা নির্দিষ্ট পরিবেশ আছে, সেই পরিবেশের বাইরে সে বেমানান। ঠিক তেমনি এই জগতের সবার জন্যই কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। কেউ যখন তার গণ্ডি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে তার প্রভাব সবখানেই দেখা যায়।

প্রত্যেকেরই উচিত নিজ অবস্থান থেকে নিজ দায়িত্বে সচেতন হওয়া এবং প্রকৃতির ভারসাম্যকে সমুন্নত রাখা। প্রকৃতির মাঝে গিয়ে প্রকৃতির সাথে মিশে লেখকের যে জ্ঞান হয়েছে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে। প্রভাবিত করেছেন বহু পাঠককে।

বলিষ্ঠ লেখনীর অধিকারী এই লেখক আপোষ করেননি কখনো। ব্রিটিশ রাজের সেবা করলেও অন্যান্য সাহেব-কর্মচারীদের সাথে বনিবনা ঠিক হয়নি কখনো সঞ্জিবচন্দ্রের। এটা তার কর্মজীবনের দিকে চোখ বোলালেই বোঝা যায়। তার লেখায় সেটার প্রতিফলন করতেও কুন্ঠাবোধ করেননি কখনো। পালামৌ ভ্রমণ কাহিনীতেও তার ছোঁয়া পাওয়া যায়। বিশেষত বইয়ের শেষ বাক্যে– “আমাদের দেশি মদ একবার বিলাতে পাঠাইতে পারিলে জন্ম সার্থক হয়, অনেক অন্তরজ্বালা নিবারণ হয়।”

বইয়ের নাম: পালামৌ || ধরন: ভ্রমণ কাহিনী

প্রকাশক: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র || অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি 

প্রথম প্রকাশ: বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ (১২৮৭-১২৮৯ বঙ্গাব্দ)

পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশ: ১৩৫১ বঙ্গাব্দ/১৯৪৪ ইং (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ)

This Bangla article is a review of Palamou by Sanjib Chandra Chattopadhyay

Featured Image: Author

RB-SM

Related Articles

Exit mobile version