পৃথিবীতে জন্মানোর পর আস্তে আস্তে যখন একটি শিশু বড় হয়ে উঠতে থাকে, তখন তাকে খুব স্বাভাবিকভবেই বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা হয়তো বেশ রসালো, আবার কোনোটা একটু তিক্ত। অনেক সাফল্যগাঁথার পাশাপাশি থাকে মর্মান্তিক বেদনা। ধীরে ধীরে শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যায়। তবে পেছনে পড়ে থাকে কিছু স্মৃতি। সেসব স্মৃতির কোনো অংশ মনে পড়লে যেমন মনের অজান্তেই আমরা হেসে উঠি, ঠিক তেমনি করেই কোনো কোনো স্মৃতির রোমন্থন করে শিউরে উঠি।
মানুষের ছোটবেলার স্মৃতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে থাকে বেড়ে ওঠার সময়কার বন্ধুরা, খেলার সাথীরা। ক্লাসের ফাঁকে ছোট ছোট খুনসুটি, টিফিনের সময় বন্ধুর খাবার নিয়ে লুকোচুরি, ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলার মাঠের দুরন্তপনা কোনো কিছুই বাদ যায় না স্মৃতির পাতা থেকে। দুরন্ত ডানপিটে বন্ধুদের দাপুটে স্বভাবের ভিড়ে শান্তশিষ্ট ঘরকুনো বন্ধুদের কথাও হারায় না স্মৃতির হার্ডড্রাইভ থেকে। তবে বন্ধুরা যে যেমনই হোক না কেন, সে বন্ধুত্ব ছিল নিষ্পাপ ও জলের মতোই স্বচ্ছ। এই বিভক্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্ত বাঁধন ছিল এই বন্ধুত্ব। আর এমনই একঝাঁক বন্ধুত্বের গল্পে ভরপুর, দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ একটি স্মৃতির নাম ‘দীপু নাম্বার টু’।
নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়া প্রায় প্রতিটি শিশুর জীবনের একটা সময় পর্যন্ত তার সবচেয়ে প্রিয় চলচ্চিত্রের স্থানটি দখল করে রাখে ‘দীপু নাম্বার টু’। ছোটবেলায় এই চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে কতবার যে দীপুর সাথে রাঙ্গামাটিতে ঘুরে আসা হয়েছে তার যেমন কোনো হিসেব নেই, ঠিক তেমনি দীপুর মতো রোমাঞ্চকর এবং দুঃসাহসিক অভিযানে দীপুর স্থলে নিজেকে কল্পনা করা দর্শকের সংখ্যাও নেহায়েৎ কম নয়। এমনকি এখনো অনেক তরুণ-তরুণীর মনের কোনো এক কোণে জমে থাকা এক চিলতে আবেগের নাম ‘দীপু নাম্বার টু’।
হবেই বা না কেন? কারণ এটি শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয়। এর মধ্য দিয়েই বিরচিত হয় ছোটবেলার স্কুলের স্মৃতি, বন্ধুদের সাথে ছোট ছোট যুদ্ধের পরিস্থিতি, দল বেঁধে খেলার আনন্দ, অজেয়কে জয় করার অদম্য অভিলাষের চিত্র, মা-বাবার ভালবাসাকে একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রসহ আরো অনেক কিছু। সব কিছুর মিশেলে আমাদের অন্তরের মণিকোঠায় জায়গা করে নেয়া একটি নাম ‘দীপু নাম্বার টু’।
‘দীপু নাম্বার টু’ চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে ছিল অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া দীপু নামের বেশ গম্ভীর একটি ছেলে। ক্লাসে আরেকটি দীপু থাকায় তার নামের পেছনে ‘টু’ লাগিয়ে তাদের পৃথক করা হয়। যাতে করে একজন অঙ্কে ভুল করলে অন্যজন মার না খায়। এদিকে একই ক্লাসে পড়া বয়সে বড় এক বখাটে ছেলে তারিককে ক্লাসের সবাই ভয় পায়। অন্য সবার মতো দীপুর ওপরও দাপট দেখাতে চাইল তারিক। তবে দীপু ক্লাসের অন্য সবার মতো ছিল না। তাই সে তারিকের সাথে টেক্কা দিয়ে চলতে লাগলো। বিনিময়ে মার খেয়ে তক্তাও হতে হলো দীপুকে।
তবে সে-ও কি কম যায়? দীপু চুপিচাপি অপেক্ষা করতে লাগলো তারিককে তক্তা বানানোর জন্য। কিন্তু এখানে এসে গল্পের মোড় বদলে যায় এবং বোধহয় গল্পের সবচেয়ে সুন্দর বাঁক এটিই! এই মোড়ে এসেই গল্পটি হয়ে যায় দীপু ও তারেকের বন্ধুত্বের। ঘটনাক্রমে একদিন তারিক ও দীপু জীবনবাজি রেখে অন্য এক বন্ধুকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে। তক্তার বদলে তারিক হয়ে যায় সবচাইতে প্রিয় বন্ধু!
সময় এগিয়ে যাবার সাথে সাথে বন্ধুত্বও বাড়তে থাকে। এক সময় দীপু জানতে পারে যে, তাদের দুজনের পারিবারিক জীবনেই কিছু অজানা গল্প আছে যা অন্য কারো সাথে কখনো ভাগ করে নেয়া হয়নি। দু’জন জানতে পারে দু’জনের নির্মম বাস্তবতা। দুঃখগুলো যেন বন্ধনটাকে আরো শক্ত ভিত দিয়ে দিল। তারা বুঝতে পারলো কিছু জনিস চাইলেও এড়ানো সম্ভব নয়। আর এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই তারা পথ চলতে থাকে।
অভিযান ভাল লাগে তারিকের, যখন-তখন খুঁজে বেড়ায় পুরনো নিদর্শন, অনেকটা প্রত্নতাত্ত্বিকের মতোই! সে দীপুকে একটি কালাচিতা উপহার দেয়। গল্পের নাটকীয়তা বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে এক দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে উদ্ধার হয় সে কালাচিতা রহস্য এবং জীবনবাজি রেখে দীপু ও তার বন্ধুরা দেশ প্রেম ও বন্ধুত্বের টানে পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে প্রাচীন সংস্কৃতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে আসে বছর। প্রতিবারের মতো এবারো দীপুকে তার বাবার সাথে অন্য কোথাও চলে যেতে হয়। এর মধ্য দিয়েই বন্ধুত্ব, ত্যাগ, রোমাঞ্চকর অনুভূতি এবং ভালবাসার নিদর্শন প্রদর্শন করে সিনেমাটি সমাপ্ত হয়।
সিনেমাটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অর্থাৎ দীপু চরিত্রে অভিনয় করেন অরুণ সাহা। চরিত্রের সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নেয়া তখনকার এ ক্ষুদে অভিনয় শিল্পী শুধুমাত্র সে সময়ের দর্শকদেরই মন্ত্রমুগ্ধ করেনি। এখনও যারা সিনেমাটি দেখে, তারাও অরুণ সাহার প্রশংসা না করে পারে না। দীপুর বন্ধু তারিকের চরিত্রে অভিনয় করেন আরেক শিশুশিল্পী শুভাশীষ। গল্পের প্রতিটি মুহূর্তে নিজ দক্ষতায় যেন পরিপূর্ণ বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন শুভাশীষ। তাই তিনিও যথাযথ প্রশংসার দাবীদার। এছাড়া শিক্ষক আবুল খায়ের, দীপুর বাবা বুলবুল আহমেদ, দীপুর মা ববিতা ও দীপুর বন্ধুদের অভিনয়ও ছিল অতুলনীয়। এদের সকলের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলই এই ‘দীপু নাম্বার টু’ যা আজো বহু দর্শকের স্মৃতির পাতায় ভাস্বর হয়ে আছে, থাকবে।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক ও শিশু সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দীপু নাম্বার টু’ পরিচালনা করেছেন দেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। চলচ্চিত্রে কোনো গান না থাকলেও রয়েছে আবহসংগীত এবং এর পরিচালনা করেছেন সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা।
‘দীপু নাম্বার টু’ বইটির কভার জ্যাকেটে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “আমি যখন পদার্থ বিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি. করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি, তখন সেখানে আমি একেবারেই একা, বাংলায় কথা বলার একজন মানুষও নেই। পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপ, সিয়াটলের মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ, গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি, কনকনে শীত সব মিলিয়ে খুব মন খারাপ করা নিঃসঙ্গ একটা পরিবেশ। একাকীত্ব দূর করার জন্যে আমি তখন কল্পনায় একটা কিশোর তৈরি করে নিয়েছিলাম। তার নাম দিয়েছিলাম দীপু। যখন মন খারাপ হতো সেই কিশোরটি তখন আমাকে সঙ্গ দিতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃষ্টিভেজা ক্যাম্পাসের পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই কাল্পনিক চরিত্রকে তা আপনজনদের প্রায় সত্যিকার মানুষদের মতো দেখতে পেতাম। এক সময় সেই কিশোর আর তার প্রিয় মানুষদের সুখ-দুঃখ আর অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীটা লিখতে বসেছি, গভীর ভালোবাসা নিয়ে লিখে শেষ করেছি। লেখা শেষ হলে নাম দিয়েছি দীপু নাম্বার টু!”
দীপু নাম্বার টু মুক্তির পর সিনেমাটি ৩টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এর মধ্যে শিশুশিল্পী অরুণ সাহা শ্রেষ্ঠ শিশু অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও মুক্তি পাওয়ার পর সমাজের সর্বস্তরের জনগণের মধ্যেই সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কেমন আছেন সেই ছোট বেলার দীপু ও তারিক?
ছোটবেলার সেই জগৎ পেরিয়ে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে দীপু ও তারিক। তবে মিডিয়া পাড়ার এই জগতটাকে দু’জনের কেউই ভুলে যাননি। ২০১৫ সালে শরাফ আহম্মেদ জীবনের পরিচালনায় অকাপিয়া মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে কাজ করেন অরুণ সাহা। এর আগে ১৯৯৯ সালে সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে এসএসসি ও নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। পরে ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ব্যাচেলর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে এইচএলএস এশিয়া লিমিটেড (HLS Asia Ltd.) এবং ওয়েদারফোর্ড (Weatherford) নামে দুটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে “ওয়্যারলাইন লগিং ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার” পদে কর্মরত ছিলেন বাল্যকালের এই অভিনেতা।
এদিকে তারিক তথা শুভাশীষের ইচ্ছা ছিল ক্যামেরার পেছনে কাজ করার। তাই দীপু নাম্বার টু’তে কাজ করার পর ক্যামেরার সামনে আর আসা হয়নি তার। এমনিতে পড়াশুনার কাজে বেশ ব্যস্ত থাকতে হলেও বর্তমানে ক্যামেরার পেছনে বেশ সক্রিয় তিনি। এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৫০টি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন। এছাড়া ‘যে শহর চোরাবালি’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিও নির্মাণ করেছেন এই ক্যামেরার কারিগর। সামনে দিনগুলোতে আরও ভাল কিছু উপহার দেবার প্রত্যয় নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন শুভাশীষ।
সময় খুব দ্রুত চলে যায়। বাস্তবতার নির্মমতায় হারিয়ে যায় ছোটবেলার সেই কোমল মনগুলো, ক্রমেই জটিল হয়ে উঠি আমরা। তবে থেকে যায় কিছু স্মৃতি। যার মধ্যে থেকে আমরা খুঁজে নিই কিছু সুখ। আজকাল বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে খুঁজে নিই ছোটবেলার বন্ধুদের! পৃথিবীর সবকিছু হয়ত ভুলে যাওয়া চলে তাদের কখনো ভোলা চলে না, চাইলেও ভোলা যায় না। আর এসব বন্ধুদের এক টুকরো স্মৃতি, স্যারের বেতের বাড়ি, ক্লাসের শেষে হুটহাট মারামারি, মা-বাবার আদর, বহু চেনা-অচেনা বন্ধন, দুঃসাহসিক অভিযানসহ এ রকম আরও অনেক শব্দকে-অনুভূতিকে যদি এক কথায় প্রকাশ করতে বলা হয় তাহলে সম্ভবত সবচেয়ে উপযুক্ত হবে ‘দীপু নাম্বার টু’।