জুল ভার্ন, যার নামের সাথেই মিশে আছে চমকপ্রদ সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের ব্যাখ্যা আর টান টান উত্তেজনায় ভরা কোনো অভিযানের গল্প। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়তে যারা ভালবাসেন তাদের কাছে জুলভার্ন বেশ পরিচিত একটি নাম। “টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আণ্ডার দ্য সী”, “অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ” ,“জার্নি টু দ্য সেন্টার অব আর্থ”, “মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড” এগুলো তাঁর লেখা জনপ্রিয় বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
উইকিপিডিয়ার হিসেবে সর্বাধিক অনূদিত হওয়া বইয়ের লেখকদের মধ্যে জুল ভার্নের অবস্থান দ্বিতীয়। এতটা জনপ্রিয় কোনো লেখকের লেখা উপন্যাস কেন প্রকাশ হয়নি এতগুলো বছর? এই ইতিহাসও কোনো গল্প থেকে কম নয়।
সাল ১৮৬৩, সবে ভার্নের লেখা প্রথম উপন্যাস “বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ” (ফাইভ উইক্স ইন এ বেলুন) বাজারে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, তখনই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর পরবর্তী উপন্যাস লেখার কাজে। নিজের সময় থেকে প্রায় একশ বছর পর, প্রিয় শহর প্যারিস দেখতে কেমন হবে? কেমনই বা হবে তখনকার মানুষের আচার-আচরণ? এই বিষয়ে নতুন উপন্যাস লেখার মনস্থ করেন তিনি। ১৯৬০ সালের কাল্পনিক প্যারিসের উপর তাই জুল ভার্ন লিখে ফেললেন তাঁর উপন্যাস ‘Paris au XXe siècle’ (প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি)।
জুল ভার্নের সময়ে বই ছাপা হবে কি না তা অনেকটাই নির্ভর করত বইয়ের প্রকাশকদের ইচ্ছার উপর। সেই সময়ের অন্যতম বিখ্যাত প্রকাশক ছিলেন প্যিয়ের-জুল হেটজেল নামের একজন ব্যক্তি। ভার্নের প্রথম বই থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বহু জনপ্রিয় বই তিনিই প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি “ফাইভ উইক্স ইন এ বেলুন” এর প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি যখন বহু প্রকাশকের কাছ থেকে ছাপার অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিল, এই হেটজেলই জুল ভার্নকে পরামর্শ দিয়েছিলেন লেখাটি নতুন করে সম্পাদন করার জন্য। আর নতুন করে সম্পাদিত সেই লেখা ছাপানোর দায়িত্বও নেন তিনিই। জুল ভার্নের সফল লেখক হয়ে ওঠার পেছনে যাদের অবদান অনেক তাদের মাঝে হেটজেল অবশ্যই থাকবেন। সেজন্যই লেখা বিষয়ে হেটজেলের দেয়া নির্দেশকে গুরু-মন্ত্র হিসেবে নিতেন ভার্ন। আর সেই গুরুর নির্দেশেই শেষ পর্যন্ত “প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি” অপ্রকাশিত থেকে যায় ।
“প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি” লেখা শেষে পাণ্ডুলিপি বরাবরের মতো হেটজেলের কাছেই জমা দেন ভার্ন। প্রকাশক ভদ্রলোক পাণ্ডুলিপি পড়ে জুলভার্নের কাছে বিষদ এক চিঠি লেখেন। সেখানে নতুন এই লেখা বিষয়ে বেশ কিছু সমস্যার তুলে ধরেন। কিছুটা তিরস্কারের সুরে কঠোরভাবেই তিনি জানান যে, ভার্নের কাছ থেকে তিনি মহাকাব্যিক কিছু আশা না করলেও এর থেকে ভালো লেখা আশা করেন। তিনি আরও লেখেন, তাঁর (জুল ভার্নের) মতো একজন উঠতি জনপ্রিয় লেখকের এ ধরনের অবাস্তব ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখা মোটেই উচিত নয়। নিজের অভিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, শুধু অবাস্তবই নয়, কাহিনীটি তাঁর কাছে নিষ্প্রভ আর নির্জীবও মনে হয়েছে।
আগের লেখার মতো সম্পাদনা করে লিখবার পরিবর্তে হেটজেল পরামর্শ দেন, জুলভার্ন যেন এই লেখা আরও বিশ বছর পরে ছাপানোর চেষ্টা করেন। হেটজেলের এই পরামর্শে জুল ভার্ন কতটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন সে বিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও, তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন এই উপন্যাস প্রকাশের কোনো উদ্যোগ আর নেননি। বাতিল লেখার স্তূপে এই উপন্যাস ফেলে রেখে নতুন লেখায় মনোযোগ দেন জুলভার্ন। পরের বছরই বাজারে আসে তাঁর আরেক জনপ্রিয় উপন্যাস “জার্নি ট্যু দ্য সেন্টার অফ আর্থ”। ১৯০৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পরও বেশ কিছু অপ্রকাশিত লেখা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন জুল ভার্নের ছেলে মিশেল ভার্ন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনিও এই লেখা ছাপানো থেকে বিরতই থাকেন। সময়ের সাথে সবার স্মৃতির অতলে হারিয়ে যার “প্যারিস ইন টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি”।
এরপর বহু বছর পার হয়ে যায়। পরবর্তীতে ঘটনার শুরু ১৯৮৯ সালে। জুলভার্নের চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরাধিকারী জিন জুল ভার্নের হাতে আসে ধুলো জমা তালাবন্ধ ব্রোঞ্জের একটি বাক্স। সেই বাক্স বংশ পরম্পরায় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে চলে এলেও কেউ সেটা খোলার চেষ্টা করেনি। পুরনো মরচে পড়া এই বাক্সে মূল্যবান কিছু থাকার সম্ভাবনা নেই বলেই ধরে নিয়েছিল সবাই। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই জিনের বাক্সটার প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল। ছোট্ট জিন মনে মনে ভাবতো- সেই বাক্সে ভরা আছে তাঁর প্রপিতামহ জুল ভার্নের সংগ্রহ করা অমূল্য সব অলংকার আর দুষ্প্রাপ্য জিনিষ।
বয়স বাড়ার সাথে অমূল্য অলংকারের কল্পনা মুছে গেলেও বাক্সের বিষয়ে আগ্রহ থেকেই যায় জিন জুল ভার্নের। তাই বাক্সটি নিজের হাতে আসার পর আর অপেক্ষা করেন করেননি তিনি। তালা খোলার লোক ডেকে ব্রোঞ্জের সেই “রহস্যময় বাক্স” খুলে ফেলেন তিনি। বাক্সে যদিও কোনো মূল্যবান পাথর বা অলংকার সত্যিই ছিল না, কিন্তু গুপ্তধন ঠিকই পেয়ে যান তিনি। বাক্সের ভেতর পাওয়া যায় জুল ভার্নের লেখা কিছু অসম্পূর্ণ নাটকের অংশ, রাশিয়ান ভাষায় লেখা কিছু কাগজ আর বহু বছরের ধুলোয় মলিন “প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি” এর মূল পাণ্ডুলিপি!
এভাবেই লেখা শেষ হবার ১২৬ বছর পর উদ্ধার হয় জুল ভার্নের হারিয়ে যাওয়া উপন্যাস। বই আকারে পাঠকের হাতে আসতে সময় লেগে যায় আরও ৫ বছর। যে ভবিষ্যৎ সময় নিয়ে জুল ভার্ন এই উপন্যাস লিখেছিলেন অর্থাৎ ১৯৬০ সাল, সে সময় পার হবারও ৩৪ বছর পর ১৯৯৪ সালে অবশেষে প্রথমবারের মতো ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত হয় “প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি”। প্রথম ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ইংরেজিতে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয় লেখাটি।
জুল ভার্নের এই উপন্যাসের মূল চরিত্র মিশেল ডুফ্রেনয় নামের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। তার চোখে ষাটের দশকের প্যারিস নগরীর চিত্র আর তার জীবনে ঘটতে থাকা নানা ঘটনার মধ্য দিয়েই গল্প এগোতে থাকে। প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরিতে রাস্তায় ভিড় করে চলতে থাকা আধুনিক সব গাড়ির কথা লেখা আছে, যেগুলো গ্যাস ইঞ্জিনের সাহায্যে চলে। ভার্ন এই গাড়িগুলোকে “গ্যাস ক্যাব” নামে এ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। কাল্পনিক সেই প্যারিসে গাড়ি চলাচলের রাস্তার উপর দিয়ে কিংবা মাটির নিচের সুড়ঙ্গ পথে চলা রেলগাড়ির কথা লিখেছেন তিনি, সেগুলো চৌম্বক আর বায়ু শক্তির মাধ্যমে চলে। আকাশচুম্বী সব ভবন আর সেই ভবনের উপর তলায় ওঠার ব্যবস্থা হিসেবে এলিভেটরের কথা বলা আছে এই কাহিনীতে। প্যারিসের বুকে গড়ে ওঠা বিলাসবহুল জমকালো সব হোটেল আর নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্য একই ছাদের নিচে খুঁজে পাওয়ার মতো সুবিশাল দোকানের বিবরণও পাওয়া যায় সেখানে।
আলো ঝলমলে শহরের বাইরের রূপের সাথে ভেতরের অন্ধকারের আভাসও দিয়েছেন জুল ভার্ন। প্যারিসকে এ কাহিনীতে দেখানো হয়েছে অত্যাধুনিক কিন্তু আবেগহীন শহর হিসেবে। সেখানের শিল্প-সাহিত্যের মূল্য নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। যেখানে শিক্ষিত হয় সবাই কিন্তু বই পড়তে আগ্রহ নেই কারোই। ল্যাটিন আর গ্রিকের মত প্রাচীন ভাষা আর শেখানো হয় না সেই আধুনিক প্যারিসে। গল্পের নায়ক মিশেল ডুফ্রেনয় ইতিহাস আর সাহিত্যে ভীষণ আগ্রহী, পরিশ্রমী এক লেখক। কিন্তু যন্ত্র আর অর্থের ক্ষমতায় বন্দি নগরীতে প্রতিভাবান তরুণ লেখকের জীবন হয় আতঙ্কের আর বিষণ্ণতায় ভরা।
গল্পের পরতে পরতে জীবন যুদ্ধে ধুঁকতে থাকা মিশেলের আবিষ্কার করা চরম বাস্তবতা, প্রিয় মানুষ হারাবার বেদনা আর পরাজিত মানুষের হাহাকার দিয়ে শেষ হয় এই উপন্যাস। অনেকে এমনও মনে করে থাকে যে, জুল ভার্ন তাঁর প্রিয় লেখক অ্যাডগার অ্যালান পো এর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই উপন্যাস লিখেছিলেন। কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া এক পরাজিত মানুষের করুণ পরিণতির গল্পই বলে প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি।
১৯৯৪ সালে ফ্রান্সে বইটি প্রকাশের আগে বেশ জোরেশোরেই প্রচারণা চালানো হয়, যার ফলে বইটির বিক্রিও হয় বেশ ভালো রকমের। ফ্রান্স এবং ফ্রান্সের বাইরে জুল ভার্নের এই ‘হারানো লেখা’কে সাদরে গ্রহণ করে নেয়া হয়। তারপরও কিছু সমালোচকের কাছে ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হয়। লেখাটি আসলেই জুল ভার্নের না তাঁর ছেলে মিশেল জুল ভার্নের লেখা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন কয়েকজন। জুল ভার্নের লেখা বিষয়ে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ দল ‘প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’র পাণ্ডুলিপির লেখার সাথে জুল ভার্নের হাতের লেখা মিলিয়ে দেখেন। পাণ্ডুলিপি লেখার কাগজ আর লেখার কালিও খতিয়ে দেখে তবেই বিশেষজ্ঞ দল নিশ্চিত করেন যে, এই উপন্যাস জুল ভার্নেরই লেখা। এছাড়াও প্যিয়্যারো গন্ডোলো ডেলা র্যিলভা নামের একজন সংগ্রাহকের কাছে প্রকাশক হেটজেলের লেখা আসল প্রত্যাখ্যান পত্রটিও রয়েছে, যেখানে এই উপন্যাসের অস্তিত্ব এবং না ছাপানোর কারণ দুটোই স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে।
‘প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি” জুলভার্নের একমাত্র লেখা নয় যা তাঁর মৃত্যুর প্রায় শত বছর পরে ছাপানো হয়েছে। ইতিহাস ঘেঁটে প্রকাশক প্যিয়ের জুল হেটজেলের বাতিল করা আরও একটি লেখার বিষয় জানা যায়, যা ছিল মূলত ভার্নের ভ্রমণ ডায়েরি। পুরোপুরি লেখক হয়ে ওঠার আগেকার সে লেখার নাম ‘ব্যাক ওয়ার্ডস টু ব্রিটেন’, যা পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়।