নকটার্নাল অ্যানিমেলস: প্রতিশোধের এক রূপক গল্প

মাঝে মাঝে খুব বেশি মনোযোগ দিয়ে কোনো উপন্যাস পড়ার সময় এমন হয় যেন আমরা সেই উপন্যাসের জগতে নিজের অজান্তেই বিচরণ করতে শুরু করি। মনে হতে থাকে, এর মধ্যে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো যেন আমাদের চারপাশেই ঘটছে। কেউ কেউ আবার উপন্যাসের সাথে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার খুঁজে পান অদ্ভুত যোগসূত্র; ঠিক যেন আমাদের জীবনেরই এক প্রতীকী রূপচিত্র।

সিনেমাটির পোস্টার; Image Sourc: Nerdophiles

১৯৯৩ সালে অস্টিন রাইটের লেখা ‘টনি অ্যান্ড সুজান’ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এবং নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার টম ফোর্ড কর্তৃক পরিচালিত ‘নকটার্নাল অ্যানিম্যালস’ চলচ্চিত্রে ঘটেছে প্রায় এমনই একটি ব্যাপার।

নিও-নোয়ার সাইকোলজিকাল থ্রিলার ঘরানার এই চলচ্চিত্রটি এগিয়ে যায় ত্রিমাত্রিক ধারায়। ছবির প্রধান চরিত্র সুজান মরো, তারই বর্তমান স্বামী হাটন মরো একজন নামীদামি ব্যবসায়ী। সুজান নিজেও এক নামকরা আর্ট গ্যালারির মালিক। তার প্রাক্তন স্বামী এডওয়ার্ড শেফিল্ড একজন ঔপন্যাসিক। নিরাপদ এবং সুখী জীবনযাপনের জন্য সুজান এডওয়ার্ডকে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করে তার বর্তমান ধনকুবের স্বামীকে।

এডওয়ার্ডের পাঠানো বইয়ের পান্ডুলিপি হাতে সুজান © Focus Features

হঠাৎ করে প্রায় বিশ বছর পর এডওয়ার্ড তার নতুন লেখা, একটি অপ্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস সুজানের কাছে পাঠায়, নাম ‘নকটার্নাল অ্যানিম্যালস’। উপন্যাসের শিরোনাম দেখেই সুজানের অতীতের কথা মনে পড়ে যায়; সে রাতে ঘুমাতো না বলে এডওয়ার্ড তাকে নকটার্নাল অ্যানিম্যাল বলে ডাকতো। আগ্রহী সুজান সেদিন রাতেই উপন্যাসটি পড়তে শুরু করে। উপন্যাসের পটভূমি টম হ্যাস্টিং নামের এক ব্যক্তি আর তার সুন্দরী স্ত্রী এবং কিশোরী মেয়েকে ঘিরে। স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে এক রাতে পশ্চিম টেক্সাসের হাইওয়ে ধরে ভ্রমণে বের হয় টম। পথে রে মার্কাস নামের এক দুর্বৃত্ত এবং তার দলবলের কবলে পড়ে তারা।

উপন্যাসের মূল চরিত্র টম এবং তার পরিবার © Focus Features

দুর্বৃত্তরা টমেরই গাড়ি ছিনতাই করে এবং সেই গাড়িতে করেই তার স্ত্রী এবং কন্যাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সারারাত হেঁটে পরদিন সকালে টম পুলিশের শরণাপন্ন হলে শুরু হয় তার স্ত্রী আর কন্যাকে খোঁজার অভিযান। এভাবেই এগিয়ে যায় ছবি এবং উপন্যাসের কাহিনী।

উপন্যাসে ঘটে যাওয়া আরও কিছু ঘটনার সাথে তার নিজের জীবনের কিছু ঘটনার অদ্ভুত মিল খুঁজে পায় সুজান। সেই ঘটনাগুলো তার মনে বারবার ভেসে উঠতে থাকে।

সুজান এবং তার প্রাক্তন স্বামী এডওয়ার্ড © Focus Features

ছবিটি দেখা শেষ হওয়ার পর আপনার মনে প্রশ্ন জেগে উঠবে, এতদিন পরই কেন এডওয়ার্ড সুজানকে তার লেখা উপন্যাস পাঠাবে এবং তাদের জীবনে কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যে বইয়ের কাহিনী সুজানের অতীতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? একটু খেয়াল করলেই ছবি শেষে প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি নিজে নিজেই পেয়ে যাবেন।

কিভাবে আমরা কাছের মানুষকে হতাশায় ফেলে কষ্ট দেই এবং নিজ স্বার্থে তাদেরকে দূরে ঠেলে দেই, এরই বাস্তব প্রতিরূপ যেন মূর্তিমান হয়ে উঠেছে সেলুলয়েডে। আবার রাতের অন্ধকারে বারবার সেসব ঘটনাপ্রবাহই আমাদেরকে কীভাবে আত্মদহনে দগ্ধ করে, সিনেমাটি এসবেরই এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি।

সুজান চরিত্রে অ্যামি অ্যাডামস © Focus Features

বিশ্বাসঘাতকতা, স্বার্থপরতা এবং অনুশোচনার টানাপোড়েন নিয়ে রচিত এই অদ্ভুত গল্পটির চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক টম ফোর্ড নিজে। সিনেমাটোগ্রাফার সেমাস ম্যাকগার্ভি তার কাজ সম্পন্ন করেছেন অদ্ভুত সুন্দরভাবে। ছবির পরিচালনা, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং সিনেমাটোগ্রাফি ছিল অসাধারণ। তবে ছবির রূপান্তর চিত্রগুলো মাঝে মধ্যে বেমানান মনে হতে পারে। এই ব্যাপারটি বাদ দিলে ছবিটি যথেষ্ট বিনোদনের খোরাক জোগাবে।

ছবি দেখার সময় মনে হবে ছবি পরিচালনার আগে পরিচালক সম্ভবত বসে বসে হিচকক-কোয়েন ব্রাদার্সের ছবি কিংবা ডেভিড লিঞ্চের মুলহল্যান্ড ড্রাইভ গোগ্রাসে গিলেছেন। আর তাই ছবির মধ্যে কোয়েন ব্রাদার্সদের নিও-ওয়েস্টার্ন থিম এবং হিচককের ছবিগুলোর মতো ডার্ক টোন বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

২০১৬ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন বেশ কিছু পরিচিত মুখ। সুজান মরো চরিত্রে ছিলেন অ্যামি অ্যাডামস, টমি হ্যাস্টিংস এবং এডওয়ার্ড শেফিল্ডের চরিত্রে ছিলেন জ্যাক ইয়েলেনহাল আর রে মার্কাস চরিত্রে ছিলেন ‘কিকঅ্যাস’খ্যাত অ্যারন টেইলর-জনসন। এছাড়াও ছবিতে অভিনয় করেছেন মাইকেল শ্যানন, লরা লিনি, আরমি হ্যামার, আয়লা ফিশার, মাইকেল শিন, এন্ড্রিয়া রাইজবরো এবং এলি ব্যম্বার প্রমুখ।

সিনেমার কাস্টদের নিয়ে পোস্টার; Image Source: pgtipsonfilms

তাদের অভিনয় নিয়ে নতুন করে তেমন কিছু আসলে বলার নেই। অ্যামি, ইয়েলেনহাল, শ্যানন এরা প্রত্যেকেই জাত অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাদের মধ্যে সবসময় তাদের সেরা অভিনয় উপহার দেয়ার প্রচেষ্টা থাকে। এই ছবির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। প্রত্যেকে নিজ নিজ চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন। টমি এবং এডওয়ার্ড এই দুই চরিত্রেই ইয়েলেনহাল অসাধারণ অভিনয় করেছেন। পার্শ্ব চরিত্রে চমকপ্রদ অভিনয়ের মাধ্যমে অ্যারন টেইলর-জনসন গোল্ডেন গ্লোব জিতেছেন এবং  মাইকেল শ্যানন পেয়েছেন সেরা সহকারী অভিনেতার অস্কার নমিনেশন।

ট্রিভিয়া

সিনেমায় জ্যাক ইয়েলেনহালের বিপরীতে তার স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করা দুই অভিনেত্রীই তার থেকে বয়সে বড়। (জ্যাকের বয়স ৩৬, অ্যামি অ্যাডামস ৪২, আয়লা ফিশার ৪১)

এই দুই অভিনেত্রী নিয়ে আরেকটি মজার তথ্য হলো, এদের দুজনেরই চেহারার গড়ন প্রায়ই একই রকম। বাস্তব জীবনে প্রায়ই অনেকে তাদের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেন। তাই তাদের দুজনেরই জ্যাক ইয়েলেনহালের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করার ব্যাপারটা সিনেমায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।

অ্যারন টেইলর-জনসনের গোল্ডেন গ্লোব জেতা চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল হোয়াকিন ফিনিক্সের।

Featured Image © Focus Features

Related Articles

Exit mobile version