ঐতিহাসিক উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যের বিশেষ নন্দিত এক জঁনরা। লেভ তলস্তয়, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ কিংবা বাংলার শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়সহ সাহিত্যের দিকপালেরা সমকালীনতাকে অতিক্রম করে,সেই সমকালীনতার যে ভিত— সেই পুরাণ, সেই ইতিহাসকে অবলম্বন করে রচনা করে গেছেন কালজয়ী ঐতিহাসিক উপন্যাস। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে বোধ যা বলে, তা হলো ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা সমকালীন উপন্যাসের চেয়ে একটু দুষ্করই বটে। কেননা ঐতিহাসিক উপন্যাসের ঔপন্যাসিক চোখের সামনে দেখতে পাওয়া সমকালীন বাস্তবতায় নয়, তাঁবু গেড়ে থাকেন মহাকালের ফেলে আসা দিনগুলোর কোনো এক পর্বের কানাগলিতে।
তার বিশেষ কর্তব্য হয়ে পড়ে বাস্তবকে অতীতে পরিণত করে বিস্মৃত অতীতের সংবেদনশীল দর্শক হয়ে ওঠা, সুদূর অতীতের বিশেষ যুগের নর-নারী, তাদের বিপুল সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের বেগ, দৃশ্য ও ঘটনাকে সাহিত্যরসে জীবন্ত করে তোলা। আর তার বিষয় যখন হয় মিথোলজি বা পৌরাণিক ঘটনা, লেখকের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে কোনোরূপ বিকৃতি বা অতিরঞ্জন ছাড়াই সর্বজনবিদিত-সর্বজনসম্মানিত ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে ছাপার হরফে তুলে আনা, পাছে তা সৃষ্টি করে অসন্তোষ!
‘রাধেয়’ তেমনি একটি ইতিহাস বা পুরাণ-আশ্রিত উপন্যাস। রাধেয় ফিকশনাইজড্ হিস্টোরি নয়, বরং হিস্টোরিক্যাল ফিকশন। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বর, ২০১৯-এ। বইটির প্রধান উপজীব্য ইতিহাসের বৃহৎ এবং চারটি জাত মহাকাব্যগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধতর গ্রন্থ মহাভারতের বীর চরিত্র মহাবীর কর্ণের জীবনগাঁথা। সাহিত্যের ব্যাকরণিক ভাষায় বললে, ‘রাধেয়’ হলো মহাভারতের ‘ডিকনস্ট্রাকশন’।
‘যা নেই ভারতে, তা নেই মহাভারতে—’ বৃহৎ কলেবরের এই ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, দার্শনিক গ্রন্থ মহাভারতের ব্যাপক বিস্তৃতি, অগুনতি চরিত্রের সমাবেশে কর্ণকে বিস্মৃত হতে না দিয়ে বিশেষ অভিধায় তার জীবনকে তুলে আনা হয়েছে এ বইয়ে। খল কৌরবদের সঙ্গী কর্ণের যে আত্মকথা, যে আত্মপরিচয় স্বয়ং ইতিহাস শুনতে চায়নি, সেই আখ্যানই এ বইয়ের বিষয়বস্তু।
“এ রজনী ফুরাবে এখনই। আঁধার মিলিয়ে যাবে অতি শীঘ্র। মিলায় না কেবল অন্তরের দ্বন্দ্ব। নির্বাপিত সেজ, স্কন্ধাবারের মশাল… প্রভাত সমাগত, সৈন্যদল সজ্জিত। তবু সৈনাপত্যের দায় স্কন্ধে তুলে সমর-শঙ্খ বাজানোর পূর্বে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, রাধেয় নই,আমি কৌন্তেয়।”
উপন্যাসের শুরুতে আত্মবিলাপরত অবস্থায়, কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের ষোড়শ দিবসের প্রাক্কালে পাঠক এভাবেই আবিষ্কার করেন আর্যাবর্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর রাধেয় তথা কর্ণকে। কুরু-পাণ্ডবের রক্তক্ষয়ী ধর্মযুদ্ধে কর্ণ দুরাচারী-কপট-অধার্মিক কৌরবপক্ষের সেনাপতি। অন্যদিকে তার বিপরীতে ধর্মাশ্রয়ী পাণ্ডবেরা— সর্বাগ্রে স্বয়ং ধর্মপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ চালিত রথে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন । একে একে অতিক্রান্ত হয়েছে ষোলোটি দিন— প্রাণ গেছে কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করা মহামহিম ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, শল্যসহ উভয়পক্ষের বহু রথী-মহারথীর। কৌরবপ্রধান দুর্যোধন শেষ আস্থা রেখেছেন তারই করুণায় সাধারণ সূতপুত্র থেকে ‘অঙ্গরাজ’ মর্যাদা পাওয়া বীর কর্ণের ওপর।
যুদ্ধের ষোড়শ দিবসের প্রাক্কালে, নিয়তির নির্মম খেলায় যুদ্ধোন্মত্ত সহোদর ভাইদের সাথে সম্মুখসমরে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বে, বিনিদ্র রাত যাপন করা কর্ণের মানসপটে ভেসে উঠেছে তার জীবন, তার আত্মজিজ্ঞাসা, তার পরিচয়, তার দ্বিধা, বঞ্চনা-অবহেলার বিরুদ্ধে তার প্রাণান্ত সংগ্রাম,জীবনপথে চলার বাঁকে বাঁকে অবলোকন করা ধর্ম-অধর্মের দ্বন্দ্ব, লোভ-মোহ-স্বার্থচিন্তারূপী অশুভের সাথে সত্য-ন্যায় ও কল্যাণরূপী শুভের সংঘাত। সে কথাই তিনি এ উপন্যাসে কখনো ক্লেশ, কখনো বিস্ময়ে, আবার কখনোবা সখেদে ব্যক্ত করে চলেছেন কয়েক সহস্রবর্ষ পরে— একালের পাঠকের উদ্দেশে।
‘রাধেয়’ আদ্যন্ত এক বঞ্চিত, উপহেলিত মানবের উপাখ্যান। মাতা কুন্তীর কুমারী অবস্থায় সূর্যদেবের ঔরসে জন্ম হয় কর্ণের। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দেবপুত্র কর্ণ হন মাতৃ-পরিত্যক্ত,তার আশ্রয় জোটে নিম্নবর্গীয় সারথি পরিবারে—পিতা অধিরথ আর মাতা রাধা’র আলয়ে। এভাবেই কৌন্তেয় হন রাধেয়। বয়োপ্রাপ্তির সাথে সাথে ক্ষত্রিয়ভাব প্রকট হয় তার মধ্যে, ঝোঁক পড়ে অস্ত্রচালনা আর ধনুর্বিদ্যায়। কিন্তু তিনি যে নিম্নবর্গীয় সূতঘরের সন্তান। কূলগৌরবে গৌরবান্বিত সমাজপতিদের বেঁধে দেওয়া নিয়মে আটকে পড়েন কর্ণ। সকলের কাছে তিনি প্রত্যাখ্যাত হন তার জাতি-পরিচয়ে, পান হতাদর-উপহাস, সখেদে এই নির্মম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কর্ণ বলে ওঠেন,
“…..জন্মই হবে সম্মানের পরিমাপক-সংসারে। এখানে সামর্থ্যের মূল্য নেই— কেবল মিথ্যা অহংকার আর স্তোক বচনের আড়ালে চাপা সব.. ।”
সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের এ হীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন সমাজবিপ্লবের কথা,
“আমি সূত কিংবা সূতপুত্র, কিংবা আমি যে-ই হই না কেন, জন্ম আমার দৈবের অধীন, কিন্তু কর্ম আমার পৌরুষের”।
স্বীয় চেষ্টা, নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ে সেই সুতপূত্র কর্ণই হন ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী। নিয়তির অমোঘ বিধানেই হস্তিনাপুরে তার আকস্মিক আগমন ঘটে, আর তিনি যুক্ত হয়ে যান হস্তিনাপুরের রাজপরিবারের সাথে, তাদের সাথে সম্পৃক্ত হয়েই পা বাড়ান রোমাঞ্চকর অজানা ভবিষ্যতের পথে।
নবীন লেখক মাহমুদুর রহমান সর্বপ্রথম ধন্যবাদ পাবেন মহাভারতের মতো এক বৃহদারণ্যের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা কর্ণকে পাঠকের চশমা-আঁটা চোখের সামনে তুলে আনার দুঃসাহস দেখানোর জন্যে। মহাভারত অবলম্বনে রচিত উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে কেবলমাত্র দু’টি— হরিশংকর জলদাসের ‘একলব্য’ আর অধুনা সংযোজিত মাহমুদুর রহমানের ‘রাধেয়’। বোঝাই যাচ্ছে, পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত সাহিত্যের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
এ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তড়িৎ প্রকৌশলের ছাত্র নবীন মাহমুদুর রহমান একশো পনেরো পৃষ্ঠায় দুই মলাটের মধ্যে মহাভারতের সকল ঘটনা, চরিত্র অবিকৃত রেখে রচনা করেছেন এ উপন্যাস। উপক্রমণিকায় লেখক বলছেন,
“বেশ কিছু চরিত্র আছে যাদের খল বলতে গিয়েও বলা যায় না, আবার বরণও করা যায় না নায়কের আসনে— তেমনই এক চরিত্র কর্ণ।”
নিয়তি, ধর্ম, সময় আর ইতিহাসের যাত্রাপথে সেই কর্ণের কাছেই পৌঁছতে চেষ্টা করেছেন লেখক, এবং বোধ করি তিনি লেটার মার্কস পেয়েই উত্তীর্ণ হয়েছেন এ পরীক্ষায়। কর্ণ চরিত্রটিকে এখানে রূপায়িত করা হয়েছে অসাধারণ কুশলতার সাথে। তার জীবনের খণ্ড খণ্ড সফলতা-ব্যর্থতা, ঘাত-প্রতিঘাত, জীবনের কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথে হোঁচট খাওয়ার পরেও সততা, কর্মনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতায় অবিচল থেকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংকল্পে এগিয়ে চলার গল্প হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। সর্বত্র উপেক্ষিত, বঞ্চিত,অবহেলিত কর্ণ যেন কোনো উর্ধ্বলোকাচারী মহাব্রতী জীবনবিচ্ছিন্ন চরিত্র নয়, বরং সে প্রচণ্ড মানবীয়— আমাদেরই আপনার।
কর্ণকে যখন মাতা ভাসিয়ে দেন নিয়তির জলে,পাঠকমনে জাগে উৎকণ্ঠা; বীরদর্পে কর্ণ যখন অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শন করেও প্রত্যাখাত হয় কুলপণ্ডিতদের কাছে, কিংবা স্বয়ম্বরা দ্রৌপদী যখন তাকে অপমানে করে সূতপুত্র বলে, তখন পাঠক হৃদয়ের গভীরে অনুভব করবেন কর্ণের জন্যে সুকোমল সমবেদনা। আবার অধিকারের বঞ্চনায় সংক্ষুদ্ধ কর্ণ যখন তার প্রাপ্য সম্মান আর মর্যাদা পেয়ে পাশে দাঁড়ান কৌরবদের, নিঃসংকোচে গ্রহণ করেন মিত্রতার প্রস্তাব— পাঠকের মনে হবে, না, এ তো দোষের কিছু নয়!
কেবল কর্ণই নয়,অপরাপর চরিত্রগুলোর চিত্রায়ণও হৃদয়গ্রাহী এবং চিত্তাকর্ষক। মহাভারতের উপাখ্যানগুলো এমনিতেই যথেষ্ট রোমাঞ্চকর, আর মাহমুদুর রহমান যেন তার সজীব-নবীন হাতে একে উন্নীত করেছেন আরেক ধাপ। লেখক আমাদের নিয়ে গেছেন কর্ণের কষ্টের খুব কাছে। আবার কর্ণের জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবেই এ উপন্যাসে সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সেসময়ের রাষ্ট্রনীতি, সমাজব্যবস্থা, কূটনীতি, রাজনীতি, অস্ত্রকৌশল ইত্যাকার বিষয়াবলি এবং সেগুলোও এসেছে সাবলীল ভাষায়। বিষয়-বস্তুর সময়-জ্ঞান ও ভাবগাম্ভীর্যের দিকে লেখক নজর দিয়েছেন দারুণভাবে। ক্ষেত্রবিশেষে উপযুক্ত পাদটীকাসহ সচরাচর অপ্রচলিত তৎসম শব্দের ব্যবহার পৌরাণিক কাহিনীর গাম্ভীর্য আর কয়েক সহস্র বৎসর পূর্বের অনুভূতিও দেবে পাঠককে।
সবশেষে বলা যায়, মহাভারতকে আশ্রয় করে কর্ণকে নিয়ে রচিত ‘রাধেয়’ নিছক ফিকশন নয়। মহাভারতে যে মানুষটি নানা সময়ে নিয়তি, পিতা-মাতা, রাজবংশ কর্তৃক চালিত- স্বগত সংলাপে রাধেয়’ খুঁজেছে তার জীবনের অর্থ। সমাজ, রাজ্য আর নিয়তির সঙ্গে তার যে দ্বন্দ্ব,তা ছাপিয়ে আপন কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়ে লড়াই করে যাওয়া জীবনসংগ্রামীর গল্প বলার চেষ্টা ‘রাধেয়’।
এরূপ সংগ্রামী থাকেন প্রতি কালেই, প্রতি যুগেই— যারা শেষ রজনী অবধি লড়ে যখন নিজের স্বপ্নের জন্য, মর্যাদা লাভের জন্য। বাস্তবতার কষাঘাতে কেউ পরাজয় বরণ করেন, কেউ হন জয়ী। কর্ণ জয়ী হয়েছিলেন কি না, তা নির্ণয় দুঃসাধ্য, তবে জয়ী হয়েছিল তার সংগ্রাম, যে সংগ্রামে জীবিতাবস্থায় আপন পরিচয় লোকসমক্ষে প্রকাশে অক্ষম মানুষটি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অবিচল থেকেছেন নিজের কর্তব্যে। চিন্তাশীল পাঠক যখন আত্মানুসন্ধানে নিমজ্জিত হয়ে কর্ণের সাথে আপনার জীবনযুদ্ধের সাযুজ্যে চমকিত হবেন, কর্ণের জীবন থেকে বীররস সঞ্চয় করে প্রাণিত হবেন শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে, আপন সংগ্রামের জন্য—আপন অধিকারের জন্য, তখনি বোধকরি নবীন মাহমুদুর রহমানের ‘রাধেয়’ পাবে সার্থকতা।