ছোটবেলা থেকেই হাজারো প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেতো। রাতের ঘুম হারাম করে দিতো। আমি মাত্র ৯ম শ্রেণিতে উঠলাম। ভালো ছাত্র হিসেবে বিজ্ঞান বিভাগ নেওয়ার প্রচলন আমার সময়ও বলবত ছিল। বিজ্ঞান পড়াটা একপ্রকার অহংকার বা লোক দেখানো ছিল আমার কাছে। কারণ অল্প জ্ঞান ভয়াবহ। মাস ছয়েক পর স্কুলে একজন শিক্ষক আসলেন। নাম নুরুল আবরার। গণিতের শিক্ষক। আমাদের ফিজিক্সও পড়াতেন। তিনিই বিজ্ঞানের আসল মজাটা উপভোগ করতে শিখিয়েছেন। তিনিই প্রশ্ন করা ও তার উত্তর খুঁজে বের করার উপায় বলেছেন। জীবনে প্রথম কেউ মজা করে পড়তে শিখিয়েছেন। তাই তাকে গুরু মেনে বিজ্ঞানের পথে যাত্রা শুরু করে দিলাম। স্যারের বাসায় অনেক বই ছিল। প্রায় সময় তার বাসায় গিয়ে বই নিয়ে আসতাম। এর মধ্যে প্রথম বই ছিল, ‘আইন্সটাইন’ সম্পাদনা করেছেন তপন চক্রবর্তী ও শাহাজাহান তপন।
তখন তাদের চিনতে পারলাম না। তাদেই বই পড়ে যে হাজার হাজার মানুষ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে, আর মাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞান বইয়েও যে তাদের অবদান আছে তা আমি বছর দু-এক পরে জানলাম। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক শাহজাহান তপনের অনেক বই আছে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। বাংলা ভাষায় পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে অনেক কিছু করেছেন তিনি। তিনি সাথে রানা চৌধুরী এবং আজিজ হাসান মিলে লিখেছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের দুটি খণ্ড, যা লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাজীবনে পড়েছে। একজন সাচ্চা পদার্থবিজ্ঞান সেবক বলা যায় উনাকে। অন্যদিকে তপন চক্রবর্তীও পদার্থবিজ্ঞান সহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় অনেক অবদান রেখেছেন। অনেক বইও লিখেছেন। তারা দুজনের মিলিত প্রয়াস আইন্সটাইনের এই জীবনী বইটা পদার্থবিজ্ঞানের আরো এক সংযোজন।
তবে বলে রাখা ভালো পুরো বইটি এই দুজনের লেখা নয়। বরং আইনস্টাইন এবং তার কাজকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লেখকের ভালো ভালো লেখার এক সংকলন। সংকলনের সম্পাদনা করেছেন এই দুজন। পাশাপাশি তাদের লেখা তো আছেই।
এ বই নিয়ে আমার মতামত বা আভিজ্ঞতা বলা, আর আইন্সটাইনকে নিয়ে আমার মনের অভ্যন্তরের ভালোবাসা প্রকাশ করা একই। যেই ব্যক্তিত্বটিকে আমি খুব এডমায়ার করি, ভালোবাসি তাকে নিয়ে লিখে শেষ করতে পারবো না। বইটিতে আইন্সটাইনের জীবনী, তার সাথে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা, তার চিন্তা, আর আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যা পড়ে খুব সহজেই একজন তার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়বে।
আমার মতে বিশ্বে সবচেয়ে মেধাবী মস্তিষ্ক (চিন্তার দিক দিয়ে) এই আইন্সটাইনের। আমার মতো আরো অনেক ভক্ত তার আছে। তার জীবনটা অনেক মজাদার আর এডভেঞ্চারাস। হাজারো প্রতিকূলতার মাঝেও, তার চিন্তাগুলো পুরো বিশ্বকে এনে দিয়েছে নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ। আমাদের চারপাশে হাজারো সুযোগ, নিরাপত্তা আর সোর্স থাকা সত্ত্বেও আমাদের চিন্তাধারা আইন্সটাইনের আশেপাশেও যায় না। তিনি ১৯ শতকে যা চিন্তা করেছেন বা আবিষ্কার করেছেন, তা আরো হাজার বছরেও কারো পক্ষে করে দেখানো সম্ভব হবে না। তার সুন্দর চিন্তাগুলোর মধ্যে ছিল সময়, আলো, আপেক্ষিকতা, ব্ল্যাক হোল, স্পেস-টাইম, গ্রেভিটেশনাল ওয়েভ ইত্যাদি।
আমার মাঝে মাঝে অনেক আশ্চর্য লাগে, প্রায় ১০০ বছর আগে একজন মানুষ যে চিন্তাগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, তা আজ আমরা সরাসরি ডিটেক্ট করতে পারছি। তার সাধারন কিছু চিন্তার ফলাফল অনেক অনেক বড় । এই যে সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৫ সালে পৃথিবী আলোড়ন ফেলা মহাকর্ষ তরঙ্গ তথা গ্রেভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেক্ট করা হয়েছে এটি মূলত আইনস্টাইনেরই ভবিষ্যদ্বাণী। শত বছর আগেই তিনি এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তার জেনারেল রিলেটিভিটির এক্সপ্লেনেশনে।
কিছু দিন আগে (১০ এপ্রিল, ২০১৯) প্রথম ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা হয়েছে। এটির ব্যাপারেও আইনস্টাইন বলে গিয়েছিলেন। আইন্সটাইনের শত বছর আগের কথাগুলো মিলে যায় সেই ছবির সাথে। ৫৫ মিলিয়ন আলোক বর্ষ দুরের একটা অব্জেক্ট ঠিক সেই রকম আচরণ দেখাচ্ছে, যেই রকম আইন্সটাইন বলেছিলেন।
আমি তার জীবনী নিয়ে আলোচনা করা এ বইটি থেকে প্রথম পড়েছিলাম। এর পর আমার এতোই এডিকশন জন্ম নেয় যে, আমি আইন্সটাইনকে নিয়ে যত মুভি, টিভি সিরিজ করা হয়েছে, সবকটি দেখেছি। এ যেন এক মোহের মতো। এখন আমি যেন এমন এক মোহে আছি।
বইয়ের নাম: আইনস্টাইন || লেখক/সম্পাদক: শাহজাহান তপন ও তপন চক্রবর্তী
প্রকাশক: স্টুডেন্ট ওয়েজ || অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি