জীবনে কত ইচ্ছাই তো হয় আমাদের। সব ইচ্ছাই কি পূরণ হয়? নিজের ইচ্ছাপূরণের পাশাপাশি প্রিয়জনের ইচ্ছাপূরণেও আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাই। হঠাৎ যদি আমরা কেউ জানতে পারি প্রিয় মানুষটির আর বেশিদিন আয়ু নেই। এক মরণব্যধি বাসা বেধেছে তার শরীরে, আর বড়জোর তিন মাস সময় পাবেন এই পৃথিবীতে, কী করবেন তখন? প্রিয়জনের ইচ্ছাপূরণ করবার চেষ্টা করবেন এই অল্প সময়ের ভেতরেই, নাকি প্রিয়জনকে তার ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই চলে যেতে দেবেন না ফেরার দেশে?
এ এক জটিল পরিস্থিতি। হয়তো সবার জীবনে আসবেও না এই পরিস্থিতি। কেউ কেউ বলে বসবেন, এসব গল্প-সিনেমাতেই হয়। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেই পড়তে হয়েছিল ইভান লেভারসিজের পরিবারকে। ইভান লড়াই করছিলো ব্রেন ক্যান্সারের সাথে। এই অল্প বয়সে ক্যান্সারের জটিল চিকিৎসা আর নিতে পারছিলো না এই শিশু। তাই খুব ইচ্ছা ছিল ইভানের সামনের ডিসেম্বরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে বড়দিন উদযাপন করবে সে। কিন্তু ডাক্তার বলে দিয়েছেন, ততদিন সময় নেই ইভানের হাতে। সামনের ২৫ ডিসেম্বর আসবার আগেই হয়তো সে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। তবে কি ইভানের বড়দিন উদযাপন সম্ভব হবে না?
সেবার ইভানের মা ও তার পরিবারের চেষ্টায় ইভান পেরেছিল বড়দিন উদযাপন করতে। ৭ বছর বয়সী ইভানের জন্য পুরো একটি শহর ২২ অক্টোবর, ২০১৫ তারিখে অগ্রিম বড়দিন উদযাপন করেছিল। ইভানের পরিবার ও শহরের সবার সহযোগিতায় বড়দিনের আগেই সবাই ইভানকে উপহার দিতে পেরেছিল আরেক নকল বড়দিন। ইভান প্রাণখুলে আনন্দ করেছিল সেই নকল বড়দিনে। এমনকি, ব্যবস্থা করা হয়েছিলো ডিসেম্বরের মতো বরফ ও স্লেজগাড়ির। সেই নকল বড়দিন উদযাপন করে ইভান প্রকৃত বড়দিনের মাত্র ১৯ দিন আগে, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৫-তে পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে।
কানাডার ইভান লেভারসিজের সেই বাস্তব ঘটনাই যেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় ‘উমা’র মাধ্যমে কলকাতার দর্শকদের সামনে তুলে ধরলেন। মৃত্যুশয্যায় এক প্রাণবন্ত ছোট্ট মেয়ে উমা (সারা সেনগুপ্ত)। জীবনের অন্তিম সময়ে সে লড়ে যাচ্ছে তার ইচ্ছাপূরণের আশায়। বাবার (যীশু সেনগুপ্ত) কর্মসূত্রে উমা তার বাবার সাথেই থাকছে সুইজারল্যান্ডে। উমার কাছে কলকাতার দুর্গা পূজাটা ছিল একটি দীর্ঘায়ু স্বপ্ন। কলকাতার পূজোর গল্প শুনে সে মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকে, একবার পূজোয় কলকাতা ছুটে আসবে! উমার বাবা যখন তার মেয়ের এই অবস্থায় লুকিয়ে চোখের জল ফেলেন, এমনই এক দিনে উমা তার বাবাকে জানায়, তার এবার দূর্গা পূজা দেখতে ইচ্ছে করছে।
তখন এপ্রিল মাস! শিশুমন বুঝতে পারেনি, নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবারই দূর্গা পূজা হয়, আর সেটা শরৎকালে। এপ্রিল মাসে গ্রীষ্মের মাঝে দূর্গা পূজা কেউ হয়তো কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু পরের দূর্গা পূজা দেখে যাওয়ার মতো সময় নেই উমার। মৃত্যু তাকে ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে। ইভানের মতোই উমার বাবা এগিয়ে আসেন মেয়ের ইচ্ছাপূরণ করতে। অজানা শঙ্কা ও ভয় নিয়ে অনেকটা সাহস করেই কলকাতা শহরে এপ্রিল মাসে দূর্গা পূজার আয়োজন করতে উমার বাবা উমাকে নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত কি এই অসাধ্য সাধন হয়? শরৎকালের সেই দূর্গা পূজা কি তবে গ্রীষ্মকালের প্যাচপ্যাচে গরমে দেখে যেতে পারে উমা? সিনেমার উমা কি বাস্তবের ইভানের মতো মৃত্যুর পূর্বে তার ইচ্ছাপূরণ করে যেতে পারে? পুরো সিনেমায় এই উত্তরই দিয়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের এই ছবিতে অভিনয় করেন যীশু সেনগুপ্ত, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রুদ্রলীন ঘোষসহ আরও অনেকে। সৃজিতের এই ছবির মাধ্যমেই বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটেছে অভিনেতা যীশু সেনগুপ্তের মেয়ে সারা সেনগুপ্তের। গল্পের মূল চরিত্রে উমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যীশুর মেয়ে সারা। তাই ছবির বাবা-মেয়ের গল্প যেন বাস্তবকেও ছাপিয়ে গেছে। যীশু সেনগুপ্তের অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলবার কিছু নেই। কিন্তু নিজের মেয়ের সাথে এই ছবিতে অভিনয়ে নিজের দক্ষতার সর্বোচ্চ প্রমাণ দিয়েছেন।
যীশুকন্যা সারার কথাও আলাদা করে বলবার নয়। বাস্তবের সারা ছবির উমা হয়ে দর্শককে কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে। এককথায় দর্শকের মন ছুঁয়ে গিয়েছে। অঞ্জন দত্ত থেকে বাবুল সুপ্রিয়, রুদ্রনীল, অনির্বাণ ভট্টাচার্য প্রত্যেকে এই ছবিতে অসামান্য অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে অভিনয়ের দিক থেকে যীশু সেনগুপ্ত, অঞ্জন দত্তের কাঁধেই ছবির গুরুদায়িত্ব ছিল ৷ ছবিটি খুব বেশি আবেগনির্ভর ছিল বলেই হয়তো ‘উমা’তে অভিনয় না করেও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, নুসরৎ, মিমির উপস্থিতি দেখা যায় ছবির শেষাংশে একটি বিশেষ দৃশ্যে। ‘উমা’ যেন বুঝিয়ে দিল পুরো টলিউড ইন্ডাস্ট্রি একটি পরিবারের মতো।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি হিসেবে এর প্রতি দর্শকদের অনেক বেশি আশা ছিল। সৃজিত মুখোপাধ্যায় দর্শকদের সেই আশা পূরণ করতে পেরেছেন কি না, ছবি সফল হয়েছে কি না এই প্রশ্নের উত্তর এত সহজে দেয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় বিষয়, এই ছবি দর্শকের মন ছুঁয়ে গেছে। বাঙালির আবেগকে বেশ ভালোভাবেই স্পর্শ করে গেছে উমা। অনেক দর্শককে কাঁদিয়েছেও। মৃত্যুপথযাত্রী একটি শিশুর ইচ্ছাপূরণে কীভাবে অচেনা মানুষগুলো এগিয়ে আসতে পারে সেটা খুব ভালোভাবেই দেখিয়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
কলকাতা শহর কি আবেগ হারিয়েছে? কিছু দৃশ্যে এমন প্রশ্নও তোলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। আবার পরের মুহূর্তে তার উত্তরও দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে এই ছবি এক বাবা ও মেয়ের ইচ্ছে পূরণের গল্প। কিন্তু গল্প যত এগোয়, বাবা ও মেয়ে থেকে বেরিয়ে যেন উমা গল্প বলে সর্বসাধারণেই। গল্প বলে শহুরে মানুষের, গল্প বলে যান্ত্রিক কলকাতা শহরের আবেগের। বাবা-মেয়ের ইচ্ছাপূরণের পাশাপাশি দর্শক এক নির্মম পৃথিবীর গল্প দেখেন, যেখানে এক ভেঙে যাওয়া পরিবারের গল্প আছে, যেখানে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি আছে, যেখানে পার্থিব মোহ আছে, আছে কট্টরপন্থী অনেক চরিত্র, কিন্তু দিনশেষে এক মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের ইচ্ছাপূরণ সব কীভাবে যেন বদলে যায়!
উমা মুক্তির প্রথম থেকেই বেশ সাড়া ফেলে দেয় সিনেমাপাড়ায়। হলগুলোতে দর্শকের উপচে পড়া ভিড় সামাল দিতে হয় হল কর্তৃপক্ষকে। দর্শকের এত ভিড় ছাপিয়ে ফুটে উঠে এক করুণ দৃশ্য। ভিড়ের মধ্যে কোনো বাবা তখনো শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন তার মেয়ের হাত। কারো চোখ তখনও ছলছল করছে। কেউ মেয়েকে কোলে করে চোখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছেন হল থেকে! বাবা আর মেয়ের সম্পর্ক কতটা আপন ও কতটা গভীর তা-ই যেন দর্শকরা আরেকটিবার দেখার সুযোগ পায়।
সিনেমাটোগ্রাফি থেকে সংলাপ, অভিনয় সবই বেশ অসাধারণ ছিল। ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন অনুপম রায়। তার সুরে গানগুলো ছবিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে সকলের মন ছুঁয়ে যায় ‘হারিয়ে যাওয়ার গান’। তার পরিচালনায় ‘আলস্য’, ‘জাগো উমা’ গান দুটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ছবিতে এছাড়াও কিছু চমক রয়েছে, যা মন কাড়বে দর্শকদের। কলকাতার পূজোর আমেজ পুরোপুরি তুলে ধরেছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। সর্বোপরি, বেশ বুদ্ধিমত্তার সাথে ও আবেগ দিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেছেন পরিচালক।
যে ইভান লেভারসিজের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়েই সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘উমা’, সেই ইভানকেও তাই ছবির সাথে তুলে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক। ‘উমা’ মুক্তির পর থেকেই কানাডা থেকে ইভানের মাকে কলকাতায় নিয়ে এসে সৃজিত মুখোপাধ্যায় উপস্থিত হতে থাকেন বিভিন্ন হলে। ইভানের মা নিকোল হয়তো কলকাতায় বসে ‘উমা’র মধ্যে খুঁজে পেতে চান তার ছেলে ইভানকে। ইভান আর কোনোদিন ফিরবে না, কিন্তু ইভান এ পৃথিবীতে যে দৃষ্টান্ত রেখে গেল, সেই ভাবনাই হয়তো নিকোলের মন খারাপ করে দিয়েছে। আর তাই ‘উমা’র এক বিশেষ স্ক্রিনিংয়ে ছবির শেষে কেঁদে লুটিয়ে পড়েছিলেন মা নিকোল। সারাকে (উমা) জড়িয়ে ধরে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন আদরের ইভানকে। নিকোল হয়তো এখন প্রতিটি দিন নতুন আশা এবং অনুপ্রেরণায় বাঁচেন।
বাস্তবের ইভান এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও এই সিনেমায় শেষপর্যন্ত উমার কী হলো তা পরিচালক আমাদের দেখাননি। তাই আমরা জানতেও পারি না। তবুও প্রাণপণে চাই উমারা ফিরে আসুক বারবার। উমারা বেঁচে থাকুক। মৃত্যু আর মেনে নিতে পারি না। নিজে ব্লাড ক্যান্সারের সাথে লড়াই করতে গিয়ে চোখের সামনে হারিয়েছি অনেক সহযোদ্ধাকে। কতজনকে দেখেছি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যেত, সেই স্বপ্নগুলো আর কখনো পূরণ হয়নি। ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে যাওয়া এই মানুষগুলোর স্বপ্ন পূরণ হোক। কানাডার সেই ছোট্ট শহর সেন্ট জর্জের নিকোলের মতো অনুপ্রেরণায় বাঁচুক হিমাদ্রির মতো অসংখ্য বাবা-মায়েরা।
ফিচার ইমেজঃ এই সময়