আপনি কি বিশ্বাস করবেন সেটা তো আর আমি নির্ধারণ করে দিতে পারব না! আপনি আপনার কাজ করুন, আর আমাকে আমার কাজ করতে দিন।”
উপরোক্ত উক্তিতে ফুটে ওঠে বুলিটের অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্টে বিশ্বাস আর স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি, যা ছিল পুরো সিনেমায় তার চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
কীভাবে একটা সিনেমা অলটাইম ক্লাসিকের খেতাব লাভ করে? প্রথমত, একে হতে হবে আইকনিক। থাকতে হবে নতুনত্ব, এবং এমন কিছু করতে হবে যা পূর্বে কোনো চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। পাশাপাশি তারা যে নতুন কিছু করল, সেটাকে পরিণত হতে হবে ইন্ডাস্ট্রির মানদণ্ডে। ১৯৬৮ সালের ১৭ অক্টোবর মুক্তিপ্রাপ্ত বুলিটে এসব গুণের সবগুলোর উপস্থিতি ছিল, পাশাপাশি এটি আরো নানা দিক উন্মোচিত করে দেয় দর্শকদের সামনে। পিটার ইয়েটসের পরিচালনায় এই মুভিতে দেখা গেছে সিনেমা ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা এবং জনপ্রিয়তম কার চেইসের দৃশ্য। সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী তারকা অভিনয় করেছেন তার ক্যারিয়ার ডিফাইনিং ক্যারেক্টারে। গল্পের প্রেক্ষাপট স্যান ফ্রান্সিসকো শহর চিত্রিত হয়েছে তার সকল জৌলুশ আর কদর্যতা সহকারে। ছিল লালো শিফ্রিনের জ্যাজ অনুপ্রাণিত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, যে স্কোর এ ধরনের সিনেমার কমন ফিচারে পরিণত হয়।
১১৩ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখেছেন অ্যালান ট্রাস্টম্যান এবং হ্যারি ক্লেইনার। তারা এক্ষেত্রে ব্লুপ্রিন্ট হিসেবে ব্যবহার করেছেন রবার্ট এল ফিশ রচিত মিউট উইটনেস উপন্যাসকে। তাই মুভির প্লট, থিম এবং চরিত্র সকল কিছুই ছিল শক্তিশালী এবং সংসক্ত। স্যান ফ্রান্সিসকো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লেফটেন্যান্ট ফ্র্যাঙ্ক বুলিটের (স্টিভ ম্যাককুইন) উপর দায়িত্ব পড়ে একজন সাক্ষীকে দেখে রাখার। সেই প্রত্যক্ষদর্শী আদালতে দেশের অর্গানাইজড ক্রাইম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। দায়িত্ব পালনকালে নিজের সঙ্গীদেরকে পাহারায় রেখে সে যখন বিশ্রাম নিতে বাসায় যায়, তখনই ঐ সাক্ষীর ওপর হামলা হয়। হামলাকারীরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে কৃতকার্যও হয়। এখন বুলিটকে চালতে হবে এমন এক চাল যাতে হামলার মাস্টারমাইন্ড আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে। তার সন্দেহ- এই কাজ করেছে রাজনীতিবিদ ওয়াল্টার চালমার্স (রবার্ট ভন)। এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করে বান্ধবী ক্যাথি (জ্যাকুলিন বিসেট), ট্যাক্সি ড্রাইভার ওয়েইসবার্গ (রবার্ট ডুভাল), তার পার্টনার ডেলগেটি (ডন গর্ডন), এবং পুলিশ ক্যাপ্টেন বেনেট (সায়মন ওকল্যান্ড)।
বুলিট নিয়ে কথা বলতে গেলে সেই বিখ্যাত কার চেইস সিকোয়েন্স আর স্টিভ ম্যাককুইনের স্ক্রিন পার্সোনার কথা বার বার আসবে। প্রথমে কার চেইসের সিকোয়েন্স নিয়েই কথা বলা যাক। মূল কালপ্রিটকে ধরার জন্য বুলিটের যে প্ল্যান, তা একসময় তাকে অবতীর্ণ করে একটি কার চেইস সিকোয়েন্সে। সিকোয়েন্সটির প্রাবল্য তৎকালে যতটা ছিল, বর্তমানেও তার আবেদন ঠিক ততটাই, একটুও কমেনি। পয়েন্ট অব ভিউ শটে আমরা বুলিটের মাসট্যাং আর তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের গাড়ির ভেতরের অবস্থা দেখতে পাই। আর গাড়ির বাইরে থেকে দেখানো দৃশ্যাবলীতে অবলোকন করি ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ের মতো কীভাবে গাড়িগুলো হঠাৎ করে বাঁক নেয় রাস্তার মোড়ে। আবার সোজা হয়, একবার উঠে চলে ঢাল বেয়ে, আবার ঢাল বেয়ে নীচে নেমে যায় রোলারকোস্টার রাইডের মতো। স্টিভ ম্যাককুইনকে দেখা যায় দাঁতে দাঁত পিষে গাড়ির গিয়ার বদলাতে আর সজোরে ক্লাচ চেপে ধরতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের বদলে এখানে শোনা গেছে অটো ইঞ্জিনের তর্জন-গর্জন আর ঘর্ষণে ক্ষয় হতে থাকা টায়ারের আর্তনাদ। হাইপার অ্যাকটিভ ভিজ্যুয়ালের সাথে মিশে যা দর্শককে নিজের সিটের প্রান্তে টান টান হয়ে বসতে বাধ্য করেছে।
স্টিভ ম্যাককুইনের ডাক নাম দ্য কিং অব কুল। নিজের স্বল্প দৈর্ঘ্যের ক্যারিয়ারে তিনি পর্দার কুল অ্যাকশন হিরোর স্ট্যান্ডার্ড স্থাপন করে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন আর ওয়ার জনরার বাইরে যেসকল অ্যাকশননির্ভর ফিল্ম নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর নায়কদের কেমন হওয়া উচিত; তা তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন বলা চলে। অভিনয়শৈলীর দিক থেকেও যে পিছিয়ে ছিলেন এমনটা বলা যাবে না। পর্দায় সমসাময়িক জন ওয়েইনের চেয়ে বেশি ভঙ্গুরতা এবং ক্লিন্ট ইস্টউডের চেয়ে বেশি অ্যাথলেটিসিজম দেখানোতে পারঙ্গম ছিলেন তিনি। বুলিটের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল তার নাম। প্রযোজনার পাশাপাশি পরিচালক হিসেবে পিটার ইয়েটসকেও নির্বাচন করেন তিনি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর সিস্টেমে অবিশ্বাসী, কম কথা বলা বুলিট চরিত্রটি স্টিভ ম্যাককুইনের জন্য আদর্শ। জনগণ, উপরমহল বা তার সহকর্মীরা তার ব্যাপারে কী বলে তাতে তার কিছু যায়-আসে না। সে যেভাবেই হোক পালন করবে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব। প্রয়োজনবোধে কৌশলের আশ্রয় নিতে বা রক্তারক্তিতেও পিছু হটবে না। আর পারফম্যান্সের দিক থেকেও তিনি দেখিয়েছেন নৈপুণ্য। সিরিয়াস, সনির্বন্ধ অভিব্যক্তির পাশাপাশি নিজের স্টার পাওয়ারের অনবদ্য চিত্রায়ণ দেখিয়েছেন পর্দায়।
পুলিশের ইউনিফর্মের বদলে রোল নেক সোয়েটার, স্পোর্টস জ্যাকেটে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, যা আরো ত্বরান্বিত হয়েছে সাথে থাকা মাসট্যাং গাড়ির বদৌলতে। বুলিটে অভিনয়ের মাধ্যমেই কাল্ট ফলোয়িং অর্জন করেন স্টিভ। কার রেসিংয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লেগে গেছে চমৎকারভাবে। আর নিজের অধিকাংশ স্টান্ট নিজেই করাটা তার প্রতি ভক্তদের ভক্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সময়ের সাথে যাতে কখনো ভাটা পড়েনি। এ কারণেই এখনও তাকে পুরুষত্বের প্রতীক বলে বিবেচনা করা হয়। মৃত্যুর দুই দশক বাদেও তার স্থান হয় সবচেয়ে সেরা অ্যাকশন হিরোদের তালিকায়। সমালোচকেরা প্রায়শই তার সমালোচনা করে বলেন, তিনি পর্দায় নিজের ক্যারেক্টারই প্লে করতেন। তবে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্টের মতে, ম্যাককুইন, বোগার্ট, ওয়েইন বা নিউম্যানের মতো তারকারা কেবল অভিনেতা নন, তাদেরকে দেখা যেতে পারে প্রেজেন্স বা সত্ত্বারুপে। তারা মিথ বা পুরাণের মতো, যা আমাদের মানসপটে সৃষ্টি হয়েছে তাদের মুভি দেখতে দেখতে। তাই তারা যখন ঐ ভাবমূর্তির বাইরে যেতে চান, তখন আমাদের কাছে সেটা মেকি মনে হয়।
বুলিট পরিচালক পিটার ইয়েটসের দ্বিতীয় এবং আমেরিকায় প্রথম চলচ্চিত্র। এর আগে তিনি রবারি (১৯৬৭) নামে যে সিনেমা বানিয়েছিলেন, তাতেও ছিল একটি চেইস সিকোয়েন্স। তবে এখানকার চেইস সিকোয়েন্স আর ম্যাককুইনের কুলনেস নিয়ে এত বেশি আলাপ হয় যে, তাতে ইয়েটসসহ অন্যদের কৃতিত্ব ঢাকা পড়ে যায়। এ কথা সত্যি যে তিনি স্টিভের পার্সোনাকে বুঝেছিলেন এবং সেটিকে সিনেমার সফলতার ফর্মুলা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে ইংলিশম্যান ইয়েটস আমেরিকায় এসে স্যান ফ্রান্সিসকো শহরকে দেখেছেন নতুন আলোকে, যা ফুটে উঠেছে পর্দায় শহরের দৃশ্যায়নে। এখানে তিনি যেভাবে শহরটির পঙ্কিলতাকে অনমনীয়ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তাতে গল্পে স্যান ফ্রান্সিসকোকেই একটি স্বতন্ত্র চরিত্র বলে মনে হয়েছে। যা ইতোপূর্বে খুব একটা পরিলক্ষিত হয়নি। বুলিটের আগে অ্যাকশন জনরার সিনেমাগুলোর শ্যুটিং হতো বানানো সেটে। কিন্তু এখানে শ্যুটিং হলো বাস্তবিক লোকেশনে। আর কম ওজনের অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরার বদৌলতে হ্যান্ডহেল্ড শট নেওয়া সম্ভব হলো, ফলে দৃশ্যধারণের ক্ষেত্রেও মিলল নতুনত্বের দেখা। এগুলো পরবর্তীকালে এ ধারার সিনেমার শ্যুটিংয়ের মানদণ্ডে পরিণত হয়। অ্যাকশন জনরার সিনেমায় সমাজের ভাবনাকেও বাদ দেননি পরিচালক। এস্টাবলিশমেন্টের ব্যাপারে মূল চরিত্রের যে মনোভাব, তা ছিল জনগণের মনোভাবের প্রতিফলন। কেননা, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকেই মানুষের মনে কর্তৃপক্ষের প্রতি ক্রমে ঘৃণা জন্মাচ্ছিল। যা সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এবং পরবর্তীকালে ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডালের ফলে আরো বেগবান হয়। এডিটিংয়ে নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়ে সে বছর অস্কার বগলদাবা করেন ফ্র্যাঙ্ক পি. কেলার।
বুলিট স্থান করে নিয়েছে সবচেয়ে সেরা অ্যাকশন সিনেমাসমূহের কাতারে, যা পারেনি ঐ দশকের অন্যান্য সিনেমা। কার চেইসের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলেও এটির ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে সব ডিপার্টমেন্টেই ছিল পরিপূর্ণতা এবং নতুনত্বের ছোঁয়া। এটি প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালের সিনেমাসমূহ এবং পরিচালকদের। যা কালক্রমে দ্বার খুলে দিয়েছে হ্যারি ক্যালাহান, পপাই ডয়েল, জন ম্যাকলেইন থেকে শুরু করে টম ক্রুজ অভিনীত অসংখ্য চরিত্রের জন্য। তাই পাঠক সময় করে দেখে নিতে পারেন অ্যাকজন জনরার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাটি।