দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত পরিচালক কিম কি দুক, কোরিয়ান ভাষায় বললে যার নাম হয় দুক কি কিম- তার এক বিখ্যাত নির্মাণ ‘স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার এবং স্প্রিং’। ২০০৩-এ নির্মাণের পর এত বছর পেরুলেও যে সিনেমার আবেদন কমেনি এতটুকুও।
নির্মাণ নিয়ে কথা বলার আগে কিম কি দুকের নিজের লেখা গল্পের দিকে যাই। নামের মতোই পাঁচটি অংশে বিভক্ত মুভিটি। একটি পাহাড়বেষ্টিত লেকের মাঝখানে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রার্থনাঘর এবং সেটিকে ঘিরে গল্পের এক অংশ থেকে অন্য অংশের প্রবাহ দেখা যায়। স্প্রিং অংশে এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর অপত্য স্নেহ এবং সংস্কার মেনে চলতে ও শিখতে দেখা যায় এক শিশুকে। ওই শিশু যে শয়নকক্ষে ঘুমায় তা কেবল একটি দরজা দিয়ে তৈরি। এই দরজাটি পায়ের কাছে। অন্য সবদিক খোলা। কোনো দেয়াল নেই। কিন্তু প্রতিবারেই যাওয়া-আসার সময় তারা দরজা খুলেই যাতায়াত করে। পরিচালক মুভির দ্বিতীয় দৃশ্যেই দর্শককে একটি চিন্তার খোরাক তৈরি করে দেন এভাবে দরজা ব্যবহারের দৃশ্য দেখিয়ে। মনে হয়েছে, ঐতিহ্য মেনে চলা বা সংস্কারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রাখার প্রয়োজনীয়তার দীক্ষা নিতে আসা ওই শিশু যেন বুঝতে পারে, তারই তাগিদে এমনটা। শুরুতে অপত্য স্নেহের মাঝে রাখা সেই ভিক্ষুকেই দেখা যায় আবার মাছ, ব্যাঙ আর সাপের সাথে পাথর বেঁধে রাখার অপরাধে শিশুটিকে শাস্তি দিতে। একটা সময়ে গিয়ে সেই ছোট্ট শিশুর অনুতাপবোধ দিয়ে শেষ হয় স্প্রিং পর্ব।
সামারের দৃশ্যের প্রথম আগমনে এক সদ্য যুবক বয়সে পদার্পণ করা ছেলেকে নৌকা চালাতে দেখেই মুভির নামের সাথে গল্পের সংযোগ পাওয়া যায়। ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের পরিবর্তনও যেন একসূত্রে গাঁথা। আসলে যেন সময়ই বয়ে যায় প্রতিটি ঋতুচক্রে। সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে আত্মার পরিশুদ্ধি নিতে আসে এক যুবতী। শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায় দীক্ষাগ্রহণরত যুবকের সাথে। একসময় সেটা ধরা পড়ে যায় ভিক্ষুর কাছে। তিনি ওই যুবতীকে বিদায় করেন সেখান থেকে। আর যুবতীকে পেতে ধর্মীয় দীক্ষা ফেলে চলে যায় ওই যুবকও। সময়ের বহমান ধারায় কোনো এক ‘ফল’ তথা শরতে সেই যুবক ফেরতও আসে। একটি খুনের ঘটনা ঘটে। চারপাশে ফুলের সুশোভিত মঞ্জরির ভীড়ে এসে সেই যুবক আবারো গায়ে জড়ায় ভিক্ষুর পোশাক। কাহিনীর পরের অংশে আসে প্রায়শ্চিত্ত, পুলিশ আর আত্মাহুতির ঘটনা। গল্পটা শেষ হয়ে যেতে পারতো এখানেই। কিন্তু নৌকার বৈঠার আঘাতে লেকের পানির তরঙ্গের মতো ধীরস্থির আর শান্তভাবে এই গল্প আরও কিছুদূর আগায়।
সাদামাটাভাবে দেখতে গেলে খুব বেশি আকর্ষণীয় কোনো গল্প নয়। অন্তত মিনিটে মিনিটে আগ্রহ তৈরির জোরাজুরি পুরো গল্পের কোথাওই ছিল না। কিম কি দুকের কোনো চলচ্চিত্রই আসলে বেশি সংলাপ নির্ভর নয়। তিনি নিসর্গের ভেতরে গল্প বলতেন। সেই গল্প বলাটা এত বেশি শক্তিশালী হতো যে, দর্শক বাধ্য হতো নিজে নিজেই গল্পের সমীকরণগুলো মেলাতে। এই মুভিতেও সব মিলিয়ে ১০০টির বেশি সংলাপ নেই। বরঞ্চ আছে এক মেলোডিয়াস সুর। আছে কেবল ক্যামেরার কারসাজি আর লাইটের মেলবন্ধনে মোমেন্ট তৈরি। সেই মোমেন্টগুলো নিজে নিজেই যেন বলে চলেছিল কত কথা!
স্প্রিংয়ের অংশে পিঠে পাথর বাঁধা অবস্থায় শিশুটি যখন কষ্ট পাচ্ছিলো, তখনো সে ভেঙে পড়েনি। ব্রত বলেই…
নৌকা চালিয়ে পাহাড়ে উঠে সবার আগে মাছটিকে খুঁজে বের করে সে। মারা যাওয়ায় তাকে সমাহিতও করে। আড়াল থেকে তার ধর্মগুরু সেসব দেখছেন চোয়াল শক্ত করে। এমন স্পর্শকাতর মোমেন্টে কোনো সংলাপ নেই। সাধারণ প্রতিটি অভিব্যক্তি। কিন্তু দর্শক ডুবে যাবে তাতেই। সাপকে মৃত অবস্থায় দেখে শেষমেশ যখন ডুকরে কেঁদে উঠলো সে, তখনো কোনো সংলাপ নেই। হাহাকার জড়ানো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নেই। কেবল কান্নার শব্দের সাথে দূরে কোথাও ঝিঁঝির শব্দ।
সামারে যখন ওই যুবতী চলে যাচ্ছিলো সেই মুহুর্তে, বা সেই যে ধর্মগুরুকে ফেলে যুবকের অভিমান নিয়ে চলে যাওয়া- তাতেও কোনো ট্র্যাজিক টিউন নেই। নেই কোনো ফিরিয়ে আনার কাকুতিময় সংলাপ। কেবল ভিক্ষুর ঘুম থেকে জেগে উঠে চোখ মেলে তাকানো যেন বলে দিচ্ছিলো, সে ফিরবেই। তার সে বিশ্বাস কত বেশি পাকাপোক্ত ছিল সেটা শরতে তার শিষ্যের জন্য পুরনো কাপড় সেলাই করে রাখার দৃশ্যেই বোঝা যায়। কিম কি দুক তো জানতেন, মুচকি হাসির কত-শত নিগুঢ় অর্থ হয়। ‘উইন্টার’ তথা বসন্তে কিম কি দুক নিজেই স্ক্রিনে উপস্থিত হন পরিণত যুবক হিসেবে। তার যখন কঠোর সাধনা শুরু হয়, তখনকার বডি ল্যাংগুয়েজ দর্শককে ঘোরে ফেলে দেবে। তপস্যার সময়ে পিছনে বরফ বেয়ে ঝর্ণার কলতান শোনা যাচ্ছিলো; অথচ সাধনা অবিরত চলছে। কোথাও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। গায়ে পাথর বেঁধে পাহাড় বেয়ে তিনি যখন উঠছিলেন, কোনো উহ! আহ! শব্দটিও নেই। কেবল ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি গান। ব্যাস!
ওপাড়ে নৌকা রেখে যাওয়া সত্ত্বেও এপাড় থেকে বেশ কয়েকবার বৃদ্ধ ভিক্ষুকে ওপাড়ে যেতে দেখা গেছে, যেখানে নৌকা কেবল একটিই। ব্যাপারটায় কিছুটা খুঁতখুঁতানি থাকবে দর্শকের। কেননা, শুরুতে মুভির কোথাওই কোনো অশরীরী বা দৈব কিছুর চিহ্ন নেই। আবার কয়েকটা ঋতুর শুরুর দৃশ্যে লেকের দরজা খুলে দেওয়াটাও কিছুটা খাপছাড়া। ফল-এর শেষেই দুক তার গল্পে এক অলৌকিক নিদর্শন নিয়ে আসেন। যে শক্তিবলে নৌকা ভিক্ষুর কাছে চলে যেতো বা দরজা বন্ধ হতো। বাস্তবতা হলো, এই দরজা খোলা ব্যতীত মুভির গল্পটাও আসলে ঠিকঠাক হতো না।
ফ্রেমিংয়ে কোথাও সামান্য ত্রুটিও নেই। লেকের স্রোতে ঘরের অবস্থান ঘুরে যাওয়ার দৃশ্যটা বেশ নজরকাড়া। বরাবরের মতোই অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখানোর সময়ে দুক কোনো ভায়োলেন্সের সাহায্য নেন নি। পুরোটাই ছিল দূর থেকে শট। উপর থেকে নেওয়া শটগুলোর সাথে লেকের দৃশ্য, পানির কলতান, ওয়াইড শট, ছোট্ট শিশুটি আর সে শিশুটি যুবক হওয়ার পর পাহাড়ের বুদ্ধের মূর্তির পাশে একইভাবে দাঁড়ানো- সবকিছুই নিজের মতো করে গল্প বলে চলেছে। ঝিঁঝি পোকার শব্দেও যে কত জমা কথা মিশে থাকে, পাহাড়ও যে ডাক দিতে পারে, ঝর্ণার কল্লোলও যে মায়াডোরে বাঁধতে পারে- তার চাক্ষুষ প্রমাণ ‘স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার এন্ড স্প্রিং’ মুভি। ফল-এ হলুদ আর লাল ফুলগুলোকে এত আবেদনময়ী লাগছিলো যেন তারা নিজেরাই এই গল্পের মুখ্য চরিত্র। পুরনো পাতা ঝরে নতুন ফুলের মৌসুম কোথাও একটা যেন বৃদ্ধ ভিক্ষুর আরো বুড়িয়ে যাওয়ার সময়ে শিষ্যের ব্রতী হতে ফিরে আসার মতোই।
সিনেমা তো বহু হয়। ভালো সিনেমা, কালজয়ী সিনেমা নেহাৎ কম নয়। সেসবের চেয়েও ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই মায়াবী মুভি আলাদা হয়ে উঠেছে কোথাও। কিন্তু কোথায়? পুরোটাই সার্বজনীনতায়। কিম কি দুকের কোনো মুভিই কেবল নিজ দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য ছিল না। প্রতিটি মুভিই সার্বজনীন। প্রত্যেক দর্শকই নিজের সংযোগটা তার মুভিতে আবিষ্কার করেন। কিম কি দুক দর্শকের সাথে একটা খেলায় মেতে উঠতেন প্রতিবার। তিনি কোনো উপসংহারের ইঙ্গিত না দিয়ে দর্শকের সামনে হাজির করতেন নীরবতার সব গল্প। দর্শক সেখানে ডুব দিয়ে তার সারমর্ম মিলাতে মিলাতে শেষ হয়ে যেত ডিউরেশন।
ও ইয়ং সু, কিম কি দুক, কিম ইয়ং মিন, কিম জং হ-দের অভিনয়ে ১০৩ মিনিটের এই মুভির প্রতিটি দৃশ্যই, প্রতিটি ঋতুই একেকটি মেটাফোর; পরির্তনের কবিতা। কিম কি দুককে সেলুলয়েডের কবি যদি বলা হয়ে থাকে, তাহলে ‘স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার এন্ড স্প্রিং’ তার সার্থক উপাখ্যান।