২০০৩ সালে মুন্নাভাই এম.বি.বি.এস যখন মুক্তি পেতে যাচ্ছে, সিনেমাটি নিয়ে তখন দর্শকদের তেমন কিছু প্রত্যাশা ছিলো না। ট্রেইলার আর প্রোমোতে দেখা গেল, সঞ্জয় দত্ত তার চিরচেনা শহুরে মাস্তান রূপে অভিনয় করছেন, আর হাস্যকর সব কাণ্ডকারখানা করে বেড়াচ্ছেন। সবাই ভেবেছিল হয়তো আরো একটি গৎবাঁধা অ্যাকশন-কমেডি ঘরানার সিনেমা আসতে যাচ্ছে।
ভুল ভাঙলো থিয়েটারে গিয়ে। দর্শক থেকে সমালোচক সবাইকে অভিভূত করে দিল ‘মুন্না ভাই এম.বি.বি.এস’। রাজকীয় সাফল্যের সাথে পরিচালক রাজকুমার হিরানী নাম লেখালেন বলিউডের বড় পর্দায়। এই সাফল্যের জন্য হিরানীকে বলিউডের কমার্শিয়াল সিনেমার ‘কমন রেসিপি’ অনুসরণ করতে হয়নি। গতানুগতিক ধারার প্রেম কাহিনী, ধুন্ধুমার অ্যাকশন কিংবা অশালীন কমেডি ছাড়াই মুন্নাভাই ব্লকবাস্টার হিট হয়। দর্শকদের পাশাপাশি সমালোচকদেরও অকুন্ঠ প্রশংসা কুড়িয়ে নেয় সিনেমাটি।
গতানুগতিক মেডিকেল সিস্টেমের ধারাকে ব্যঙ্গ করে তৈরি করা সিনেমাটি দর্শকদের ভাবনার খোরাক যোগায়। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে নতুন চোখে দেখতে শেখায়। সব শ্রেণীর মানুষকে শ্রদ্ধা করতে, ভালোবাসতে শেখায়। আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অনেক ক্ষেত্রে আরোগ্যের জন্য ভালোবাসার চেয়ে বড় ঔষধ আর হয় না। তাই বলে এটি কেবল উপদেশবাণী বিলানো ক্লান্তিকর কোনো সিনেমা না। বিনোদনেরও কোনো খামতি ছিলো না এতে।
বিভিন্ন আবেগপ্রবণ দৃশ্য আমাদের চোখে যেমন পানি এনে দিয়েছে, তেমনি আবার সার্কিট আর মুন্নাভাইয়ের কাণ্ডকারখানায় হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া ছাড়াও উপায় ছিলো না। আর এখানেই রাজকুমার হিরানীর মুন্সিয়ানা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি জানেন একটি সিনেমায় কতটুকু হাস্যরস, কতটুকু সামাজিক ভাবনা মেশাতে হয়। তিনি এ দু’য়ের নিখুঁত ভারসাম্যটি খুঁজে পেয়েছেন। যা করতে গিয়ে অধিকাংশ পরিচালকই হিমশিম খান।
সেই ২০০৩ সাল থেকে শুরু করে গত চৌদ্দ বছরে রাজু হিরানী সিনেমা বানিয়েছেন মাত্র চারটি। ‘মুন্না ভাই এম.বি.বি.এস’ (২০০৩), ‘লাগে রাহো মুন্নাভাই’ (২০০৬), ‘থ্রি ইডিয়টস’ (২০০৯) এবং পিকে (২০১৪)। মাত্র এ চারটি সিনেমার মাধ্যমেই তিনি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে, বর্তমানে বলিউডের সেরা পরিচালক হিসেবে তাকে এক বাক্যে মেনে নেয় সবাই। তিনি বলিউডের হাতেগোনা অল্প কয়েকজন পরিচালকের একজন, যারা গতানুগতিক ধারা ভাঙতে জানেন।
রাজু হিরানী অবশ্য শুধু পরিচালকই নন। তিনি বলিউডে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এডিটর হিসেবে, তার সিনেমাগুলোর এডিটিং তিনি নিজেই করেন। সহলেখক অভিজাত জোশির সাথে তার সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেন নিজেই। তাই তার চিন্তাধারা, বিশ্বাস ও জীবনবোধের গভীর ছাপ রয়ে যায় তার সিনেমাগুলোতে। তার সিনেমার কিছু উল্লেখযোগ্য দিক নিয়েই আলোচনা করা হবে আজকের লেখাটিতে।
প্রধান চরিত্রের ব্যতিক্রম দৃষ্টিভঙ্গী
রাজু হিরানীর সব নায়কের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, তারা বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা করেন। গৎবাঁধা সিস্টেমের অনুসরণ না করে, তারা এ সিস্টেমকে ভাঙতে শেখান। যেমন- থ্রি ইডিয়টস সিনেমায় পড়াশোনার প্রতি র্যাঞ্চোর দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের সমাজের আর দশজনের থেকে আলাদা। আমরা যেখানে তোতাপাখির মতো মুখস্থ করে সার্টিফিকেট অর্জনের পেছনে ছুটছি, সেখানে র্যাঞ্চো আমাদের বলেন, “বেটা, কামিয়াব নেহি কাবিল বানো”।
একইভাবে মুন্না ভাই, পিকে তাদের ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে পর্দায় হাজির হয়েছেন এবং একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেম বিদ্যমান সিস্টেমকে। রাজু হিরানীর নির্মাণ কুশলতায় এসকল চরিত্রের চিন্তাধারা দর্শকের মাঝেও সঞ্চারিত হয় এবং আমাদের উদ্বুদ্ধ করে নিত্যদিনের নেয়া সিদ্ধান্তগুলোকে আরো একবার মূল্যায়ন করে দেখতে।
তার সিনেমাগুলোতে গভীর সামাজিক ভাবনা নিহিত থাকে
‘লাগে রাহো মুন্না ভাই’ সিনেমায় হিরানী বেশ সাহসী একটি উদ্যোগ নেন। এ সিনেমার মাধ্যমে তিনি বর্তমান সময়ের তরুণদের কাছে মহাত্মা গান্ধীকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেন, উদ্বুদ্ধ করেন প্রাত্যহিক জীবনে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণ করতে। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশংকা ছিলো। এখনকার শক্তি প্রদর্শনে উন্মুখ তরুণ-যুবকদের কাছে গান্ধীর অহিংসার পথ আকর্ষণীয় মনে হওয়ার কথা ছিলো না।
কিন্তু এখানেও আবার স্মরণ করতে হয় রাজু হিরানীর নির্মাণ কুশলতার কথা। তিনি অসাধারণভাবে গান্ধীর আদর্শকে পথ প্রদর্শক হিসেবে তুলে ধরেছেন, যে জোরপূর্বক নয় বরং বন্ধুর মতো হাতে ধরে সঠিক পথের দিকে নিয়ে যায়। একইভাবে পিকে সিনেমার সেই ‘রং নাম্বার’ এর ধারণাটাও আমাদের মধ্যে ভাবনার জন্ম দেয়। ধর্মের নাম ভাঙিয়ে খাওয়া এক শ্রেণীর লোকদের বিরুদ্ধে সজাগ করে তোলে।
তবুও উপদেশবাণী নয়, বিনোদনই মুখ্য
যত গভীর ভাবনাই নিহিত থাকুক, সিনেমার অন্যতম লক্ষ্য কিন্তু দর্শককে নিখাদ বিনোদন দেওয়াটাও। একজন দর্শক যদি স্রেফ উপভোগ করার জন্যই হিরানীর সিনেমা দেখে, নিশ্চিতভাবে বলা যায় সে বিন্দুমাত্র হতাশ হবে না। হিরানী নিজেও বলেন, তিনি কোনো সামাজিক বার্তা দিতে নয়, বরং দর্শককে বিনোদন দিতেই সিনেমা তৈরি করেন তিনি।
মৌলিক গল্পের জন্য তারা নিজেদের সমাজের দিকে ফিরে তাকান। এবং কোনো একটি ইস্যু নিয়ে তাদের গল্প এগিয়ে নেন। আমরা যেটিকে ‘মেসেজ’ বলে মনে করছি, তা মূলত ঐ বিষয়ে রাজু হিরানীর নিজের বিশ্বাস ও চিন্তাধারার প্রতিফলন। আর এটিই বিনোদনের পাশাপাশি আমাদের মনে ভাবনার খোরাক যোগায়। সমাজের যে বিষয়গুলোকে আমরা সবসময় চোখ বুজে অনুসরণ করে যাচ্ছি, সেগুলোকে প্রশ্ন করতে সেখায়। এটিই তার সিনেমাকে করে তুলেছে অনন্য।
রাজকুমার হিরানীর নির্মাণ কুশলতা ও ‘এল.সি.ডি’ ফর্মুলা
রাজু হিরানীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো সকল শ্রেণীর, সকল বয়সের দর্শকদের কাছে তার সিনেমার আবেদন সমান। এর কারণ তার সিনেমার নির্মল হাস্যরস, মনকে দ্রবীভূত করা আবেগী দৃশ্যগুলো ও নাটকীয়ভাবে উপস্থাপিত তার সামাজিক ভাবনা। আর এ আবেদন ধরে রাখার জন্য তিনি একটি ফর্মূলা ব্যবহার করেন, যাকে তিনি বলেন ‘LCD’ ফর্মুলা। অর্থাৎ স্ক্রিপ্ট লেখার সময় তারা ভাবেন যে, এর প্রত্যেকটি দৃশ্যে হয় Laughter বা Cry বা Drama থাকতে হবে। এই তিনটের কোনোটিই যদি না থাকে, তবে সে দৃশ্যটি সিনেমা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
আসলে বিষয়টা যতটা সহজ মনে হচ্ছে প্রয়োগ করা ততটা সহজ নয়। আর লেখার চেয়ে সিনেমায় দৃশ্যায়ন করা তো হাজার গুণ কঠিন কাজ। রাজকুমার হিরানী তার সিনেমায় কীভাবে এই নাটকীয়তা তৈরি করেন তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। থ্রি ইডিয়টস সিনেমার কথা তো আমাদের সবারই মনে আছে। এর একদম প্রথম দৃশ্যে ফারহানের একটি বিমানকে জরুরি অবতরণ করানোর ঘটনাও ভোলার মতো নয়।
সেই দৃশ্যটি সিনেমার গল্পে লেখা ছিলো স্রেফ এক লাইনে। চতুর বাড়িতে থাকা ফারহানকে ফোন দেবে, এরপর ফারহান রাজুকে ফোন দিয়ে বলবে সেই কলেজের পানির ট্যাঙ্কের কাছে যেতে। কারণ র্যাঞ্চোর দেখা পাওয়া গেছে। এখন এ দৃশ্যটিকে নাটকীয় করে তুলতে হবে এবং দেখাতে হবে যে র্যাঞ্চো আসলে তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন। তো সিনেমায় আমরা কী দেখলাম?
একটি বিমান টেক-অফ করছে। এ সময় ফারহানের একটি ফোন কল আসে। অপর পাশের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না। ফোনে কথা বলে ফারহানকে চিন্তিত দেখাতে শুরু করে। (দর্শক মনে কৌতূহল জন্ম নিচ্ছে, কী বলা হয়েছে সেই ফোন-কলে?)। এরপরই হঠাৎ দেখা যায় ফারহান হার্ট অ্যাটাক করছেন (তবে কি কোনো দুঃসংবাদ ছিল?)। এরপর মেডিকেল ইমার্জেন্সির কারণে বিমানটি জরুরি ভিত্তিতে অবতরণ করে।
এসময়ই দেখা যায়, ফারহান আসলে বোকা বানিয়েছে ওদের। তার কিছুই হয়নি, বিমান নামানোর জন্য তার এই নাটক ছিল। (কী এমন কারণ যার জন্য তাকে বিমান নামিয়ে ফেলতে হলো) এরপর দৌড়ে গিয়ে সে ট্যাক্সিতে উঠে রাজুকে ফোন দেয় এবং বলে র্যাঞ্চো আসছে (দর্শকমনে এ পর্যায়ে এসে র্যাঞ্চোর গুরুত্ব হঠাৎ করে আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। কৌতূহল চরমে, কে এই র্যাঞ্চো, যার জন্য ফারহান একটা বিমানকে নামিয়ে ফেললো?)। দৃশ্যের উদ্দেশ্যও সফল। তবে অনেক নাটকীয়ভাবে এবং উপভোগ্য পদ্ধতিতে।
এভাবেই ছোট ছোট নাটকীয়তা, হাসি-কান্নার মাধ্যমে রাজু হিরানী তার দর্শকদের সিনেমায় বেঁধে রাখেন। আগামী বছর রাজকুমার হিরানী আসছেন তার পঞ্চম সিনেমা নিয়ে। তার বন্ধু ও অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের রোমাঞ্চকর জীবনকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই তৈরি হবে সিনেমাটি। অভিনয় করছেন তারকা অভিনেতা রণবীর কাপুর।
তবে লেখক ও পরিচালকের নাম যখন রাজকুমার হিরানী, তখন দর্শকের প্রত্যাশার পারদ থাকবে উঁচুতেই। আমরা আরো একটি অসাধারণ সিনেমা দেখার প্রত্যাশায় প্রহর গুনতে থাকবো এবং আশা করবো, রাজু হিরানী এভাবেই আমাদের মুগ্ধ করে যাবেন সবসময়, নতুন চোখে দেখতে শেখাবেন আমাদের চারপাশকে।