জনরা ভিত্তিক ফিল্মমেকিংকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রচুর সাহসের প্রয়োজন। আর সেটা যদি কোনো নবাগত পরিচালক করেন, তাহলে তাকে আলাদা করে বাহবা দিতেই হয়৷ পরিচালক অতনু মুখার্জির ২০১৭ সালের সিনেমা ‘রুখ’ থ্রিলার জনরার বিদ্যমান নিয়ম-নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে, সাথে সাথে এটি দর্শকদের অনুভূতিশক্তিকেও প্রশ্ন করে। ফলে এটিকে কোন ধারার সিনেমার ব্র্যাকেটে রাখবো আমরা, সেটি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ি।
শুরুতে এটিকে আর দশটি ‘হুডানিট’ সিনেমার মতোই মনে হয়, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমরা বুঝতে পারি, এই সিনেমা এখানকার চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক দিকেও সমভাবে গুরুত্বারোপ করে। তারা বাইরের সমস্যাগুলোর সাথে যেমন সংগ্রাম করছে, তেমনি মানসিক দ্বন্দ্বের সাথেও লড়ে চলেছে। কেবল থ্রিলার জনরার কথা যদি বিবেচনা করেন, তাহলে ‘রুখ’কে হিন্দি সিনেমার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সিনেমার মর্যাদা দিতে হবে। বেশিরভাগ থ্রিলারে যেমন দেখা যায়, সেরকম দ্রুতলয়ের দেখা এখানে পাবেন না। আবার এটির গল্প বলার ধরণ শম্বুকগতিরও নয়। পরিচালক এখানে গল্প বলেছেন সহজ, স্বাভাবিকভাবে; থ্রিলারের সাথে সুচারুভাবে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন ‘কামিং-অভ-এইজ’ ধারার উপকরণের।
সিনেমার প্লটে একটি মৃত্যু ঘটে, এটিকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয়, পুলিশও তদন্ত করতে শুরু করে। সন্দেহভাজনদের দেখাও মেলে, তবে এই সন্দেহভাজনদেরকে আমরা পুলিশের দৃষ্টিতে দেখি না। বরং তাদেরকে আমরা দেখি, মৃত ব্যক্তির একমাত্র সন্তানের চোখে। এই সন্তানের নাম ধ্রুব (আদর্শ গৌরব) আর পিতার নাম দিবাকর (মনোজ বাজপায়ী)। দিবাকর একটি চামড়ার কারখানা চালাতেন, যিনি সম্প্রতি একটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনাটিকে সাজানো বলে মনে হয় ধ্রুবের।
কর্তৃপক্ষ তো তাদের তদন্ত চালাচ্ছেই, ধ্রুব সিদ্ধান্ত নেয়, সে নিজেও ব্যক্তিগতভাবে বাবার শেষ দিনগুলোর ব্যাপারে অনুসন্ধান করবে। পিতার মৃত্যুর ধাক্কা তো তার মানসপটে লেগেছেই, এখন এই ব্যাপারে খোঁজ-খবর করতে গেলে কতটা মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়; তার অনবদ্য উপস্থাপন দেখা গেছে সিনেমায়। এ যেন একই নরকের ভেতর দিয়ে আরেকবার যেতে চাওয়ার অভিপ্রায়। অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা হয়তো শেষে বদলে দেবে তার পুরো জীবনটাকেই৷
পিতার অন্তিম দিনগুলো নিয়ে ধ্রুবের যে অনুসন্ধান, তা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অতনু যেন অনুপ্রাণিত হয়েছেন কিংবদন্তিতুল্য জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার ১৯৫০ সালের ক্লাসিক ‘রশোমন’ থেকে। রশোমনের মতো একই ধরনের প্লট ডিভাইস দেখা গেছে ‘রুখ’-এ; যেখানে ধ্রুব তার পিতার ব্যাপারে মা, বাবার বন্ধু, ফ্যাক্টরির কর্মচারীসহ নানাজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জানতে পারে। গল্পের এগিয়ে যাওয়ায় এসব দৃষ্টিভঙ্গি ও বয়ানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ফলে, পরিচালক কর্তৃক গৃহীত এই পদ্ধতিকে অপব্যবহৃত বা মনভোলানো চটকদারিত্ব বলে মনে হয় না। আর গল্পের শেষে ধ্রুবের সাথেই আমরা সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল, তা জানতে পারি৷
এবার আসা যাক সিনেমাটির কামিং-অভ-এইজ থিমের দিকে। ধ্রুব এখনো একজন কিশোর। পিতার সাথে তার বেশ দূরত্ব ছিল৷ তিন বছর আগে ঘটা একটা ঘটনার কারণে বলতে গেলে তাকে ঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে৷ ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বোর্ডিং স্কুলে। বাবার মৃত্যুর পর সে মায়ের সাথে এসে উঠেছে নানার বাসায়। বাবার শেষদিকের আচরণ কেমন ছিল, কীভাবেই বা তিনি মারা গেলেন, এখন তাদের পরিবার চলবে কীভাবে, এসব ব্যাপারে তার প্রশ্নের শেষ নেই। কিন্তু ছোট বলে কেউই তাকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিচ্ছে না, বলছে না সবকিছু খোলাসা করে৷
তার পিতার জীবনে কিছু গোপনীয় ব্যাপার ছিল, যেগুলো হয়তো তার ব্যাপারে ধ্রুবের পুরো দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দেবে। তবে সেও আর বড় বড় চোখের সেই ছোট বাচ্চাটি নেই যে, কেউ কিছু বললে সবকিছু নির্দ্বিধায় মেনে নেবে। সে জানে, সবকিছুই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। বাবার বাসা থেকে নিয়ে আসা ছোটবেলার জিনিসপত্রের বাক্স খুলতে সে সাহস পায় না। কারণ তার ভয়, এসব বাক্স খোলার সাথে সাথে বাবার সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতি প্যান্ডোরার বাক্স খোলার মতোই এসে তাকে গ্রাস করবে।
ধ্রুবের মা (স্মিতা তাম্বে) স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে অনেককিছুই জানেন, তবে তিনি সেসব নিজের ছেলেকে বলতে পারেন না৷ তিনি মনে করেন, ধ্রুব সত্য জানতে পারলে নিজেকে সামলাতে পারবে না, বাবার টানাপোড়েনের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে না। যদিও নির্দয় শহরের রুক্ষ পরিবেশে ইতোমধ্যেই ধ্রুব তার বয়সের তুলনায় পরিপক্ব হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার মা সেটা দেখতে পান না।
অনুজ্জ্বল আলো জ্বলা শহুরে ঘরবাড়ি, একাকী রাস্তা, নির্মীয়মান অট্টালিকা আর জনশূন্য বেলাভূমি; পূজা গুপ্তের অসাধারণ সিনেম্যাটোগ্রাফি দর্শকমনে এনে দেবে অতল অবসাদ। একজন মানুষ মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়, কিন্তু মেগা সিটিতে এটা তো নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। সবাই নিজেদের জীবনের পথে এগিয়ে যায়, পেছনে রেখে যায় একজন কিশোরকে; যে জানতে পারে না, বাবার আসলে কী হয়েছিল।
ধ্রুবের অনুসন্ধান প্রকৃতপক্ষে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনর্নির্মাণ। তার মাথায় আগে জেঁকে বসা খুনের চিন্তাই বিশ্বাসে রূপ নেয়। আর এই চিন্তাকে বিশ্বাসে রূপদানের মতো পর্যাপ্ত উপকরণেরও দেখা মেলে৷ তার সাথে নানা চরিত্রের কথোপকথন আমাদেরকেও সিনেমার প্লটে টেনে নিয়ে যায়। আমরাও দিবাকর কি খুন হয়েছে, নাকি হয়নি- এই দু’টি তত্ত্ব বিষয়ক যুক্তি দাঁড় করাই। কিন্তু সত্যের উদঘাটন এসব তত্ত্বকে গুঁড়িয়ে দিয়ে আমাদের অনুভূতিকে করে দেয় ভোঁতা৷ ভাষণ বালার লেখা প্রাঞ্জল সংলাপ অতনুর গল্প বলার ধরনকে করেছে মোহনীয়। এরকম বিষাদময় একটি গল্পেও হাস্যরসের সঞ্চার করেছেন তিনি সুনিপুণ দক্ষতায়।
পরিচালক রুখের গল্পকে সাজিয়েছেন অনেকটা বইয়ের মতো করে। এক চরিত্র আমাদেরকে একটি যাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সহযাত্রী হিসেবে এখানকার অচেনা চরিত্ররাও আছে। আমরা জানি, সবার জীবনেই কিছু না কিছু গোপনীয় ব্যাপার আছে, যা আমরা কাউকে জানতে দিতে চাই না। একইভাবে, আমরা এটাও জানি; মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে, যেটা সে বিশ্বাস করতে চায়। এই বিশ্বাস, তত্ত্ব আর দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই এগিয়ে গিয়েছে সিনেমার প্লট। অমিত ত্রিবেদীর সঙ্গীতায়োজন এবং সিদ্ধান্ত মাগোর গানের কথা ছন্দময়, যা সিনেমার থিমের সাথে মিশে গেছে পুরোপুরি এবং গল্পকে করেছে আরো প্রগাঢ়।
ধ্রুব চরিত্রে আদর্শ গৌরব নিজের অভিনয় দক্ষতার ঝলক দেখিয়েছেন৷ সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে বয়সের তুলনায় পরিপক্ব হয়ে যাওয়া কিশোরের চরিত্র রূপায়নের ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা আর বিস্তৃতির অপূর্ব নিদর্শন দেখা গেছে তার অভিনয়ে। সবসময় গোলযোগ সৃষ্টি করা কিশোর হিসেবে পিতার সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন৷ দুর্বলতা সত্ত্বেও লড়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে তার অভিব্যক্তিতে। গল্পের মতোই জ্বলজ্বল করেছে তার চরিত্র। তাকে এর আগে ‘মাই নেইম ইজ খান’ (২০১০), ‘মম’ (২০১৭) সিনেমায় দেখা গেছে। আর বর্তমানে তো নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমের মুভি, সিরিজে অভিনয় করে পাদপ্রদীপের আলোতে উদ্ভাসিত হচ্ছেন।
মনোজ বাজপায়ীর কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। স্বল্প সময় পর্দায় থেকেই ব্যবসায়ী দিবাকর চরিত্রের সবগুলো দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি৷ নিজের চরিত্রের গভীরে গিয়ে গল্পের মনমরা ভাবকে ভালোমতো ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন পরিচালককে। অপরাধবোধে ক্লিষ্ট মা, স্ত্রী চরিত্রে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন স্মিতা তাম্বে। পাশাপাশি দিবাকরের বন্ধুর চরিত্রে কুমুদ মিশ্রর অভিনয়ের কথাও আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য।
রুখের নিজস্ব ন্যারেটিভ টেকনিক আছে। এটিকে যদি কেবল ‘আর্টহাউজ’ লেবেল দেওয়া হয়, তাহলে পরিচালকের মেধার প্রতি অবিচার হয়ে যাবে। এটি একটি দুর্লভ, পরিপক্ক থ্রিলার; যেটির দর্শককে নিবিষ্ট করে রাখার সকল সক্ষমতা আছে। উপযুক্ত শব্দের অভাবে একে হয়তো আমরা ‘ভিন্ন ধরনের ফিল্ম’ বলতে পারি। তাই এই অপেক্ষাকৃত আন্ডাররেটেড সিনেমাটি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না, সিনেমা শেষেও এটির রেশ আপনার সাথে থেকে যাবে বহুক্ষণ।