মানবদেহ যেন গোলকধাঁধার চেয়ে কম কিছু নয়। বিজ্ঞানের ক্রমাগত উৎকর্ষ সাধনের পরেও চিকিৎসকদের প্রতিনিয়তই অদ্ভুত সব সমস্যা ও সমাধানের মুখোমুখি হতে হয়। একেকটি রোগ কিংবা একেকজন রোগীর থাকে নিজস্ব কিছু গল্প, যা যথেষ্ট চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর। চিকিৎসাবিজ্ঞান তাই অনেকাংশেই চিকিৎসক কিংবা গবেষকদের এই অদ্ভুত গোলকধাঁধায় প্রতিনিয়ত নাজেহাল হওয়ার গল্প। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অদ্ভুত কিছু রোগ, কয়েকজন মহান ব্যক্তিত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার- মোটাদাগে এই তিন ভাগে সাজানো হয়েছে ‘কাদামাটির গোলকধাঁধায়’ বইটি।
বইটির প্রথম পর্বে অদ্ভুত কিছু রোগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান- তিন সম্প্রদায়ের কাছেই জেরুজালেম এক পরম পবিত্র স্থান। কিন্তু এ ‘স্থানের’ সাথে জড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক রোগের নাম- জেরুজালেম সিন্ড্রোম। জেরুজালেম ভ্রমণ করা কিছু ব্যক্তির অদ্ভুত ভ্রম তাদেরকে তাদের কল্পরাজ্যে বড় মাপের এক ধর্মীয় গুরু বানিয়ে দেয়! অত্যধিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় বার বার গোসল করতে থাকে রোগী, রীতিমতো ধর্মপ্রচার করাও শুরু করে দেয়। অদ্ভুত এই মানসিক রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালের ব্যবস্থাও করা হয়েছে সেখানে।
তেমনই আরেক অদ্ভুত রোগ কনজেনিটাল অ্যানালজেসিয়া। জন্মগতভাবেই ব্যথা অনুভব করার সামর্থ্য থাকে না এ রোগে। ফলে কতক্ষণ হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হবে কিংবা কত জোরে কোনো খাবারে কামড় দিতে হবে এসব বুঝতে পারে না শিশুরা। ফলাফল দাঁড়ায়- হাঁটুতে ক্ষত কিংবা দাঁত পড়ে যাওয়া। অদ্ভুত এসব রোগের বর্ণনায় পাঠককে চিকিৎসাবিজ্ঞানের দুর্বোধ্য সব বাক্যবাণ থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে চেয়েছেন লেখক। ফলে চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থী থেকে অনুসন্ধানী পাঠক- সকলের জন্য সহজেই বোধগম্য হবে বিষয়গুলো।
পানিতে অ্যালার্জি হওয়া কিংবা দেহে হুট করে লাল-নীল সব তন্তুর বাসা বাধার অদ্ভুত রোগগুলো অবাক করবে পাঠককে। কুরু নামের অদ্ভুত এক রোগের কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসবে নরমাংস ভক্ষণের ইতিহাস! ঔষধ ছাড়াও প্লাসিবো ইফেক্টের মাধ্যমে রোগী সুস্থ হওয়ার কয়েকটি ঘটনারও সাক্ষী হবেন পাঠক। বইটির বিষয়বস্তু বোঝানোর সুবিধার্থে প্রত্যেক পর্বেই যুক্ত করা হয়েছে বেশ কিছু চিত্র। তবে কিছু জায়গায় সাদা-কালো অস্পষ্ট কয়েকটি চিত্র চোখের ক্লান্তিকেই শুধু বাড়িয়ে দেয়!
বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের প্রতীক বলে বিবেচিত হয় অসক্লেপিয়াসের দণ্ড। এর সাথে জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক ঘটনা। সাপে পেঁচানো দণ্ডের পেছনের গল্প যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। বইটির দ্বিতীয় পর্বে পুরাণের এ ঘটনার পাশাপাশি চিকিৎসায় ইসলামি সভ্যতার অবদান সম্পর্কেও খুব সংক্ষিপ্ত একটা আলোচনা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে টাইফয়েড মেরির গল্প, যে রাঁধুনি তার জীবদ্দশায় শত শত লোকের কাছে টাইফয়েডের জীবাণু ছড়িয়ে গেছেন। অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হয়ে আসা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথাও উঠে এসেছে এ পর্বে। শেষ বয়সে নিউটনের পাগলামির হাজারও কারণের মাঝে উঠে এসেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি প্রামাণিক কারণও। পুরো বইয়ে হাতে গোনা কয়েকটি বানান ভুল পেলেও এ পর্বে ‘মহামারি’ শব্দটির ভুল বানান চোখে লেগেছে বার বার।
শেষ পর্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের বর্ণনা এসেছে। ম্যালেরিয়ার ঔষধ কুইনিন কিংবা একসময় সর্বরোগের মহৌষধ হিসেবে ব্যবহৃত অ্যাসপিরিন আবিষ্কারের গল্প যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। ইতিহাস আশ্রিত আলোচনার সাথে লেখকের দারুণ বর্ণনা মুগ্ধ করবে পাঠককে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আশীর্বাদ ইনসুলিনের আবিষ্কার কাহিনীও উঠে এসেছে এখানে। একদম শেষ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে ওরস্যালাইন সম্পর্কে, যে উদ্ভাবনের সাথে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের নামও জড়িয়ে আছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের দারুণ এসব আবিষ্কারের সহজ-সরল বর্ণনা একদিকে সাধারণ পাঠকদের যেমন চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে কৌতূহলী করে তুলবে, তেমনি চিকিৎসা পেশা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দারুণ প্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করবে। বইটির লেখক মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ পেশায় একজন চিকিৎসক। অনুবাদ ও মৌলিক মিলিয়ে তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ইতোমধ্যে সেঞ্চুরি অতিক্রম করেছে। ‘কাদামাটির গোলকধাঁধায়’ বইটির বেশ কিছু অদ্ভুত রোগের গল্প পূর্বেও রোর বাংলায় ফিচার হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত বই পরিচিতি
বই: কাদামাটির গোলকধাঁধায়
লেখক: ডা. মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ
প্রকাশনী: অন্যধারা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১২৮
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা
প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০২৩