ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’

বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সিনেমা দর্শকদের পরিচয় ঘটে ১৯০০ সালের দিকে। নির্বাক যুগে ঢাকায় শুধুমাত্র চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য তৈরি করা হয় ‘পিকচার হাউস’। আরমেনিয়ান স্ট্রিটে অবস্থিত অধুনালুপ্ত ‘শাবিস্তান’ই হচ্ছে সেই সময়ের ‘পিকচার হাউস’। এই প্রেক্ষাগৃহটির যাত্রা শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কোনো এক সময় থেকে। বিশেষ এক পদ্ধতি তথা হ্যারিকেন লণ্ঠনের সাহায্যে তখন এই প্রেক্ষাগৃহে মাঝেমধ্যে চলচ্চিত্র দেখানো হতো।

ঐতিহাসিকদের মতে, উক্ত ‘শাবিস্তান’ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন প্রেক্ষাগৃহ। এই প্রেক্ষাগৃহে পরবর্তীতে সবাক যুগে অশোক কুমার দেবিকা রানী অভিনীত ‘অচ্ছুৎকন্যা’ দেখানো হয়েছিল। সিনেমা প্যালেস, লায়ন, মুকুল প্রভৃতি প্রেক্ষাগৃহগুলোও মোটামুটি ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে গড়ে ওঠে। ‘লায়ন’ সিনেমা হলে প্রথম মুক্তি পেয়েছিল উপমহাদেশের সবাক চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’। উক্ত চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন মাস্টার ভিটল ও জবাইদা। কিন্তু এসব চলচ্চিত্রের কোনোটিই ঢাকায় নির্মিত ছিল না।

‘দ্য লাস্ট কিস’ বা ‘শেষ চুম্বন’ চলচ্চিত্রের পোস্টার; Image Source: themoviedb.org

অতঃপর, মুকুল সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচ্চিত্র ’শেষ চুম্বন’ বা ‘দ্য লাস্ট কিস’। ১৯৩১ সালের শেষার্ধে বর্তমান আজাদ সিনেমা হলে বা তৎকালীন মুকুল সিনামা হলে এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল। এছাড়াও এই সিনেমা হলেই ঢাকার প্রথম পূর্ণাঙ্গ সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে।

মুকুল সিনেমা হলের মালিক ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার মুড়াপাড়া এলাকার জমিদার মুকুল ব্যানার্জী। ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা পিকচার্স প্যালেস’ এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এই কোম্পানীর অধীনে ভিক্টোরিয়া পার্কের উত্তর কোর্ট হাউজ এলাকায় ১৯২৮-২৯ সালের দিকে স্থাপিত হয় ‘এম্পায়ার থিয়েটার’, যা পরে ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তরিত হয়।

ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন নবাব পরিবারের কিছু সংস্কৃতিমনা তরুণ। এ তরুণরাই বিশের দশকের শেষদিকে ঢাকায় গড়ে তোলে ‘ঢাকা ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন। তাদের হাত ধরেই নির্মিত হয় ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’। এর আগে অবশ্য পরীক্ষামূলকভাবে ‘সুকুমার’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। সুকুমার নির্মিত হয়েছিল ১৯২৭-২৮ সালের দিকে। মজার বিষয় হচ্ছে, উক্ত চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা উভয়েই ছিলেন পুরুষ। এটি কোনো প্রেক্ষাগৃহে বা প্রকাশ্যে কোথাও প্রদর্শিত হয়নি। শুধুমাত্র ঘরোয়াভাবে এটি দেখানো হয়েছিল।

‘দ্য লাস্ট কিস’ সিনেমার নায়ক খাজা আজমল; Image Source: themoviedb.org

সুকুমার চলচ্চিত্রের উদ্যোক্তারাই ১৯২৯ সালে এগিয়ে আসেন পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণে। এর পরিচালকের দায়িত্ব নেন অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। তিনি ছিলেন জগন্নাথ কলেজের শরীরচর্চা প্রশিক্ষক, তবে অভিনয়মোদী, নাট্য পরিচালক। প্রথমে ছবির নায়ক হিসেবে নির্ধারিত হন খাজা নাসরুল্লাহ। কিন্তু অভিনয় শুরু হওয়ার আগেই তিনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ। সম্ভবত সামাজিক নেতিবাচক প্রভাবের কারণেই তিনি এই সিদ্ধান্ত বদল করেছিলেন। এমতাবস্থায় কাজী জালালকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিছুদিন শুটিং করার পরে কাজী জালালও নায়কের চরিত্রে আর অভিনয় করতে চাইলেন না। অবশেষে খাজা আজমল এই চলচ্চিত্রের নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক ছিলেন খাজা আজাদ। তিনি পরে কলকাতা চলে গেলে এর দায়িত্ব নেন খাজা আজমল নিজেই।

ছবির নায়িকা ছিলেন লোলিটা। মহিলা চরিত্রে যারা অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন চারুবালা, দেববালা ও হরিমতি। তাদের আনা হয়েছিল ঢাকার পতিতালয় বা বাঈজী পাড়া থেকে। অক্টোবর ১৯২৯ সালে চিত্রগ্রহণ শুরু হয়। ঢাকার দিলকুশা, মতিঝিল, শাহবাগ আর নীলক্ষেতে চলে চলচ্চিত্রের শ্যুটিং। অভিনয়ের সুবিধার্থে আজিমপুরে নবাবদের বাগানে একটি অস্থায়ী স্টুডিও স্থাপন করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রটির টেকনিক্যাল প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় কলকাতায়। সম্পাদনা করেন অজয় গুপ্ত ও খাজা আজমল। চলচ্চিত্রটির ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু সাবটাইটেলও করা হয়। ছবিটি ছিল ১২ রিলের আর খরচ হয়েছিল প্রায় ১৫ হাজার টাকা।

‘দ্য লাস্ট কিস’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল তৎকালীন মুকুল সিনেমা হলে, যা এখন আজাদ সিনেমা হল নামে পরিচিত; Image Source: protidinersangbad.com

‘দ্য লাস্ট কিস’ ছবির কাহিনী

প্রিন্ট হারিয়ে যাওয়ার কারণে ও তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণের অভাবে ছবিটির কাহিনী উদ্ধার করাও দুষ্কর হয়ে পরে। তবে অনুপম হায়াৎ এই কাহিনী সংগ্রহের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এজন্য তিনি ছবিটির সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে পুরোনো ঢাকায় চলচ্চিত্র  গ্রন্থে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। সেসব সাক্ষাৎকার থেকে ‘দ্য লাস্ট কিস’ এর কাহিনী ও আনুষঙ্গিক বিষয়ের একটি ধারণা পাওয়া যায়। নিচে অনুপম হায়াৎ এর নেয়া সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।

ছবির সহকারী চিত্রগ্রাহক ও অভিনেতা খাজা মোহাম্মদ জহিরের বর্ণনা অনুসারে,

এক রাতে নায়ক আচমল তাঁর স্ত্রী লোলিটাকে নিয়ে যাত্রা দেখতে যাওয়ার পথে জমিদার খাজা নসরুল্লাহর বাহিনী দ্বারা অপহৃত হন। পরে বহু খোঁজাখুঁজির পর নায়িকা লোলিটাকে জমিদার নসরুল্লাহর ঘরে পাওয়া যায়। সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। ঘটনার অনিবার্য পরিণতিতে নায়ক-নায়িকা মারা যায়। ছবির আরেকটি দৃশ্যে খাঁজা মোহাম্মদ আদেল ও তাঁর স্ত্রী চারুবালার শিশুপুত্র খাজা..খাজা মোহাম্মদ শাহেদকে ডাকাতরূপী শৈলেন রায় (টোনাবাবু) চুরি করে নিয়ে যায়। খাজা আজমলের পরনে ছিল পাঞ্জাবী আর ধুতি। লোলিটার পরনে ছিল শাড়ি, আঁচলে চাবির গোছা।

ছবিটির প্রত্যক্ষ দর্শক ও তৎকালীন হকি ক্রীড়াবিদ খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ রেজাার অভিমত,

এই ছবিতে বেশ্যা বাইজীদের নিয়ে ধনীদের মধ্যে যে সংঘর্ষ দেখানো হয়েছে ওই সময়ে তা ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। এ ছবির কাহিনী ছিল এক বাস্তব ঘটনারই রূপায়ন।

ছবিটির অভিনেতা খাজা মোহাম্মদ আকমলের পুত্র খাজা মোহাম্মদ আহসান বলেন,

এই ছবির কাহিনী ও স্থিরচিত্র নিয়ে ওই সময় একটি সুদৃশ্য বুকলেট প্রকাশ করা হয়েছিল। বোম্বে থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ঢাকার এই প্রথম ছবি নির্মাণকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। এই ছবিতে আমার আব্বা ডাকাতের চরিত্রে অভিনয় করেন আর সৈয়দ সাহেব আলম অভিনয় করেন দারোগা চরিত্রে। ওই ছবির একটি দৃশ্যে নায়ক খাজা আজমল নায়িকা লোলিটার শাড়ি ধরে টেনে ইজি চেয়ারে নিজের কোলে বসিয়েছিলেন।

ছবিটির অন্যতম অভিনেতা ও শিশুশিল্পী খাজা শাহেদের বর্ণনা বেশ পরিপূর্ণ। যদিও তখন তার বয়স মাত্র ৩ বছর ছিল। তিনি বলেন,

মাত্র তিন বছর বয়সের সময়ে আমি ওই ছবিতে অভিনয় করি। কাহিনীর পুরোটা মনে না থাকলেও মনে আছে যে, ছবিটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছিল দুই পরিবারের সংঘাতকে ঘিরে। একপক্ষে ছিলেন খাজা আদেল, তাঁর স্ত্রী চারুবালা এবং শিশুপুত্র খামি। অপরপক্ষে ছিলেন খাজা আজমল, তার স্ত্রী ও ছোট্ট মেয়ে টুনটুন। দুই পরিবারের শিশুদের মধ্যে স্বাভাবিক নির্মল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু নানা ঘটনার আবর্তে দুই পরিবারের মধ্যে আসে বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ মুহুর্তে দুই শিশু পরস্পর পরস্পরকে চুম্বন করে। ছবিটির নাম তাই রাখা হয় ‘শেষ চুম্বন’ বা ‘দ্য লাস্ট কিসস’। এই ছবিতে খাজা আকমল, টোনাবাবু, খাজা নাসরুল্লাহ ছিলেন মন্দ চরিত্রে। টোনবাবু যখন আমাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, বাস্তবে তখন এত ভয় পেয়েছিলাম যে কেঁদে ফেলছিলাম। এ ছবিতে আমার পিতা সেজেছিলেন খাজা মোহাম্মদ আদেল, পরে তিনি বাস্তবে আমার শ্বশুর হন। ছবিতে সাহেব আলম ঘোড়ায় চড়েছিলেন হ্যাট মাথায় দিয়ে। এ ছবির প্রিমিয়ার শো হয়েছিল মুকুল হলে। উদ্বোধন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রামেশ চন্দ্র মজুমদার। তিনি বেবী টুনটুন ও আমাকে সোনার মেডেল উপহার দিয়েছিলেন ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য।

ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সংশ্লিষ্টদের নাম

চলচ্চিত্রটির প্রযোজনায় ছিল ঢাকার নবাব পরিবারের তরুণদের প্রতিষ্ঠিত সেই ‘ঢাকা ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি’। পরিচালক ছিলেন অম্বুজ গুপ্ত। চিত্রগ্রহণ করেন খাজা আজাদ। উর্দু সাবটাইটেল নির্মাণ করেন ডক্টর আন্দালিব সাদানী। অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ডাকাত চরিত্রে শৈলেন বাবু (টোনবাবু), নায়ক চরিত্রে খাজা আজমল, নায়িকা চরিত্রে লোলিটা, পার্শ্ব নায়ক চরিত্রে খাজা নসরুল্লাহ, জমিদার চরিত্রে খাজা আদেল, পার্শ্ব ডাকাত চরিত্রে খাজা জহির, পুলিশ চরিত্রে সৈয়দ সাহেব আলম, খাজা আদিলের স্ত্রী চরিত্রে চারুবালা, শিশু চরিত্রে খাজা শিহেদ ও বেবী টুনটুন।

এছাড়াও অন্যান্য পার্শ্ব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন দেববালা, হরিমতি, ধীরেন মজুমদার, বেনু বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরেন ঘোষ প্রমুখ।

‘দ্য লাস্ট কিস’ চলচ্চিত্রের অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের একাংশ; Image Source: nawabbari.com

ছবির নায়িকাদের আনতে হয়েছিল পতিতালয় থেকে

ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’-এর নায়িকাদের আনতে হয়েছিল পতিতালয় থেকে। সিনেমাটির প্রধান নায়িকা ছিল লোলিটা। ডাক নাম বুড়ি। বাদামতলীর পতিতালয় থেকে তাকে অভিনয়ের জন্য আনা হয়েছিল। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তখন তিনি নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রে তার আসল নাম বদল করে রাখা হয় লোলিটা। ছবির কাজ শেষ হলে তিনি আবার তার পুরনো পেশা পতিতাবৃত্তিতে ফিরে যান। ‘দ্য লাস্ট কিস’ ছাড়া তিনি পরে আর কোনো ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পাননি। এজন্যই হয়ত অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে অনুপম হায়াৎ বলেছেন,

‘দ্য লাস্ট কিস’ ছবির নায়িকা লোলিটার জীবনবৃত্তান্ত বিশেষ কিছু জানা যায়নি। যদ্দুর জানা যায়, লোলিটার আসল নাম বুড়ি। ছবির প্রয়োজনে তখন কোনো ভদ্রঘরের মেয়েদের পাওয়া যেত না বলে বাদামতলীর পতিতালয় থেকে তাকে রূপালি জগতে আনা হয় এবং নাম দেয়া হয় লোলিটা। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। ছবির কাজ শেষ হওয়ার পর লোলিটা আবার পূর্ব পেশায় ফিরে যান। ঢাকার প্রথম ছবির নায়িকা এমনিভাবে হারিয়ে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে।

‘দ্য লাস্ট কিস’-এর নায়িকা এবং অন্যান্য অভিনেত্রীদের বাছাই করা হয়েছিল মূলত নাচ-গানের আসর থেকে। নাচ-গানের পাশাপাশি তাদের প্রধান পেশা ছিল পতিতাবৃত্তি। সে সময়ে ছবিতে কোনো পুরুষেরই চলচ্চিত্রে অভিনয় করার ব্যাপারটা ছিল রীতিমত গর্হিত কাজ। আর মেয়েদের অভিনয় করার কথাতো পুরোপুরি অকল্পনীয় ছিল। ফলে অভিনয় করার জন্য কোনো নারীকে রাজি করানো যায়নি। বাধ্য হয়ে পতিতালয় থেকে এসব অভিনেত্রীদের সংগ্রহ করতে হয়েছিল।

ছবির সহ-নায়িকা চারুবালা রায়কে আনা হয়েছিল কুমারটুলী পতিতালয় থেকে। আরেক পার্শ্ব নায়িকা দেববালাকে আনা হয়েছিল জিন্দাবাহার লেন পতিতালয় থেকে। নায়িকা লোলিটার মতো এরাও হারিয়ে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেই।

ছবির আরেক অভিনেত্রী হরিমতি ছিলেন ঢাকার নামকরা বাঈজী। সিনেমাটি ছাড়াও তিনি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কয়েকটি গান রেকর্ডে গেয়ে বাজার মাত করে ফেলেছিলেন। ‘দ্য লাস্ট কিস’-এ তিনি মেয়েদের নৃত্যদৃশ্যের সাথে গান গেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার জন্মস্থান কলকাতায় ফিরে যান।

‘দ্য লাস্ট কিস’ চলচ্চিত্রের শুভমুক্তি

১৯৩১ সালের শেষ দিকে ‘মুকুল’ সিনামা হলে শুভমুক্তি হয়েছিল ঢাকার প্রথম এই চলচ্চিত্রটির। ছবির উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রামেশ চন্দ্র মজুমদার। ঢাকায় টানা প্রায় ১ মাস সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রথম ঢাকায় নির্মিত চলচ্চিত্র হওয়ায় দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ছিনেমাটি। এরপর ‘শেষ চুম্বন’-কে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়।

যেভাবে হারিয়ে গেল ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র

আফসোসের বিষয় হচ্ছে, এখন আর এই চলচ্চিত্রটির কোনো প্রিন্টের খোঁজ পাওয়া যায় না। ঢাকায় প্রদর্শন শেষে অধিকতর প্রচারের আশায় চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কলকাতায়। সেখানকার আরোর ফিল্ম কোম্পানি চলচ্চিত্রটি অত্যন্ত কম দামে কিনে রেখেছিল, কিন্তু এই ঐতিহাসিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ তারা করেনি। এ বিষয়ে অনুপম হায়াৎ তার পুরোনো ঢাকায় চলচ্চিত্র গ্রন্থে লিখেছেন,

১২ রিলের এ নির্বাক ছবিটি তৈরি করতে প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। ১৯৩১ সালের শেষার্ধে ছবিটি ঢাকার তৎকালীন মুকুল হলে (বর্তমান আজাদ) মুক্তি দেয়া হয়। ছবিটির অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে এক মাসব্যাপী প্রদর্শনী চলে। উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রামেশচন্দ্র মজুমদার। তিনি ছবির দুই শিশুশিল্পী শাহেদ ও টুনটুনকে মেডেল দিয়েছিলেন। ছবির একটি মাত্র প্রিন্ট করা হয়েছিল। এ প্রিন্টটি বৃহত্তর পরিবেশনের জন্য আহসান মঞ্জিলের সৈয়দ সাহেব আলম কোলকাতার অরোর ফিল্ম কোম্পানির কাছে নিয়ে যান। সেখানে প্রিন্টটি অরোর ফিল্ম কোম্পানীর লোকেরা সুকৌশলে মাত্র এক হাজার ঢাকায় কিনে নেয়। এরপর থেকে প্রিন্টটির আর কোনো খোঁজ নেই।

ফিচার ইমেজ: themoviedb.org

তথ্যসূত্র:

১। অনুপম হায়াৎ, পুরোনো ঢাকায় চলচ্চিত্র, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ২০০৯

২। সম্পা. এমদাদুল হক চৌধুরি, কিংবদন্তি বর্তমান ঢাকার অতীত, নিউক্লিয়াস পাবলিকেশন, প্রথম প্রকাশ ২০০৮

Related Articles

Exit mobile version