সিনেমা যতটা বিনোদনের খোরাক, ঠিক ততটাই চলমান বিশ্বের, সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন। সিনেমার ইতিহাস ধরে পেছনে যেতে থাকলে এই সত্য খুবই পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায়। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় ফিল্মমেকিংয়ের ধরন, উপাদান, ও বিষয়বস্তু। ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদের করাল থাবার শিকার চলমান বিশ্বের প্রতিফলনও স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে আজকের টিভি, সিনেমায়। বর্তমানের বিনোদন মাধ্যম জুড়ে রয়েছে পুঁজিবাদের জোরালো সমালোচনা। ২০২০ সালের অস্কারে বং জুন হো পরিচালিত শক্তিশালী পুঁজিবাদবিরোধী সিনেমা ‘Parasite’ এর বেস্ট পিকচার ক্যাটাগরিতে জয় হাল আমলের এই প্রচলনের সবচেয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বুটস রাইলির ‘Sorry to Bother You’, রায়ান জনসনের ‘Knives Out’ এর মতো মুভিগুলো একই ধারার অংশ। সিনেমার পাশাপাশি টিভিও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে এই নতুন ধারায়। মহা প্রতিপত্তির অধিকারী আমেরিকান এক নিউজ কর্পোরেশনের মালিকের পরিবার নিয়ে এইচবিও-র স্যাটায়ার সিরিজ ‘Succession’ বিপুল সাড়া ফেলেছে দর্শকদের মাঝে। দক্ষিণ কোরিয়ার ‘Squid Game’, এইচবিও-র ‘The White Lotus’ কঠোর পুঁজিবাদবিরোধী থিমের কারণে হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী সেনসেশন। ২০২২ সালে সিনেমা ও টিভিতে এই নতুন ওয়েভ অবিশ্বাস্য গতি লাভ করে। গত বছরে দুর্দান্ত সাড়া জাগানো ৩টি মুভি ও ১টি টিভি সিরিজের মূল বিষয়বস্তু ছিল সমাজের বিত্তবান ১ শতাংশের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা। সেই চারটি বিনোদনমূলক প্রজেক্ট নিয়েই এই লেখা।
১) Triangle of Sadness
২০২২ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভালের সর্বোচ্চ সম্মান Palme d’Or জয়ী রুবেন অসল্যান্ডের ‘Triangle of Sadness’ প্রকৃতরূপেই অনন্য এক সিনেমা। মুভিটি শুরু হয় এক সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার কাপল কার্ল ও ইয়াইয়াকে দিয়ে। আরও কতিপয় ধনকুবের ব্যক্তির সাথে কার্ল আর ইয়াইয়া এক বিলাসবহুল ক্রুজ শিপে যাত্রা শুরু করে। জাহাজে দেখা যায় বেশ বিত্তবান এই লোকদের উদ্ভট সব কীর্তিকলাপ।
সুইডিশ লেখক-পরিচালক রুবেন অসল্যান্ড লেখনীর অসাধারণ কারিশমা দেখিয়েছেন এই সোশ্যাল স্যাটায়ারে। কমেডিকে স্মরণীয় করতে যেরকম প্রাণবন্ত, মজাদার আর সচল হতে হয়, তা পুরোপুরিই রয়েছে এই মুভিতে। মুভির থার্ড অ্যাক্টে দর্শকদের সাথে পরিচয় করানো হয় ডলি ডে লিওন অভিনীত জাহাজের কর্মচারী এবিগেইলের সাথে। শেষাংশে এবিগেইলের মধ্য দিয়ে সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রির কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘটা অমানবিক, অশোভন আচরণের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে।
একজন অবহেলিত শ্রমিকের আকস্মিক ক্ষমতা লাভের পরিস্থিতি দিয়ে তৈরি হয়েছে চমৎকার এক স্যাটায়ার। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় আলোতে নিয়ে আসলেও মুভিটি একবারও নিজের কমেডিক সত্তা হারায়নি। ভরপুর বিনোদনের মাধ্যমেই এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে মানবিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আসছে অস্কারে ‘বেস্ট পিকচার’, ‘বেস্ট ডিরেক্টর’, ও ‘বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে’ ক্যাটাগরিগুলোতে তিনটি মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছে সুইডিশ সিনেমাটি।
২) Glass Onion: A Knives Out Mystery
২০১৯-এর তুমুল সাড়া জাগানো মার্ডার মিস্ট্রি ‘Knives Out’ এর দ্বিতীয় কিস্তি ‘Glass Onion’ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেল গত ডিসেম্বরে। রায়ান জনসন দর্শকদের উপহার দিলেন ড্যানিয়েল ক্রেইগ অভিনীত ডিটেকটিভ বেনোয়াহ ব্লাংকের পরবর্তী রহস্য।
গ্লাস অনিয়নের জন্য জনসন নতুন রহস্যের সাথে সাজিয়েছেন নতুন লোকেশন, নতুন কাস্ট। নাইভস আউটের ফ্যামিলি ড্রামার বদলে এবার তিনি নজর দিয়েছেন এক বিত্তশালী বন্ধুদলের উপর। এডওয়ার্ড নর্টন অভিনীত ধনী উদ্যোক্তা মাইলস ব্রন পাঁচ বন্ধুকে তার প্রাইভেট আইল্যান্ডে অবকাশ যাপনের নিমন্ত্রণ জানায়। ঘটনাক্রমে বেনোয়াহ ব্লাংকও নিমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হয় এই আইল্যান্ডে। এরপরই শুরু হয়ে রায়ান জনসনের ট্রেডমার্ক কমেডি-মিস্ট্রি-ক্রাইমের জম্পেশ খেলা!
রহস্যের মোড়ক খুলতে খুলতে মুভির গল্পও অবাক করা কিছু বাঁক নিতে থাকে। ধনদৌলতের লোভে মানুষ কীভাবে পয়সাওয়ালা, ক্ষমতাবান ব্যক্তির গায়ে প্যারাসাইটের মতো লেগে থাকে তার উপর অতি সূক্ষ্ম এবং সত্য কিছু মন্তব্য রয়েছে এই মুভিতে। সমাজের বিত্তবান শ্রেণীর কতিপয় আর্কেটাইপ নিয়েও মজা নিয়েছেন জনসন, খুবই চতুরতার সাথে। তবে গ্লাস অনিয়নের মূল ভাষ্য পাওয়া যায় পুঁজিবাদী লোভের সাথে মনুষ্যত্বের পতনের অনিবার্য সংযোগে। মুভির ২ ঘন্টা ২০ মিনিটের রানটাইমে ক্রমাগত হাস্যরসের মধ্য দিয়েই রায়ান জনসন আবশ্যক ও সময়োপযোগী এই থিম ধরে রেখেছেন।
৩) The White Lotus
মুভির পর এবার মোড় ঘুরে টিভির জগতে ঘুরে আসি মাইক হোয়াইটের ডার্ক কমেডি ‘The White Lotus’ দিয়ে। মুভিতে রায়ান জনসনের মতো টিভিতে পুঁজিবাদ-বিরোধী কমেন্টারির রাজা মাইক হোয়াইট। একদল ধনী ব্যক্তির ফাইভ স্টার হোটেল দ্য হোয়াইট লোটাসে ছুটি কাটাতে আসাকে কেন্দ্র করে অ্যান্থলজি সিরিজ ‘The White Lotus’।
প্রতি সিজনে মাইক হোয়াইট নতুন নতুন চরিত্রদের সাথে দর্শকদের নিয়ে যান ভিন্ন লোকেশনের হোয়াইট লোটাস হোটেলে। সিজনের প্রথম দৃশ্যেই আভাস দেয়া হয় ভবিষ্যতে ঘটে যাওয়া কোনো মৃত্যুর ঘটনার। এরপর সারা সিজন দর্শকরা গল্পের সাথে সেই অনিবার্য ঘটনার রহস্য নিয়ে নিজেদের মতো থিওরি বানাতে থাকেন। পুরো ব্যাপারটাই এই ডার্ক কমেডি সিরিজের উপভোগ্যতাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়।
সীমার বাইরে ধনসম্পদ মানুষকে কীভাবে বাস্তবতার সাথে সংযোগহীন বানিয়ে মানবতা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, এর এক উৎকৃষ্ট কেস স্টাডি হোয়াইট লোটাস। বিশেষ করে ইতালিতে সেট করা দ্বিতীয় সিজনের চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে ধনসম্পদের সাধনায় মানুষ কীভাবে জীবনের আদি সুখগুলো বিসর্জন দেয় তা দেখানো হয়েছে চমৎকারভাবে। ইতালির অতি মনোরম, চোখ ভোলানো সৌন্দর্যের ছড়াছড়ির মাঝে এই চরিত্রগুলো একবিন্দুও মানসিক শান্তি খুঁজে পায় না। কেননা, তারা ভুলে গেছে কীভাবে সৌন্দর্য ভোগ করতে হয়, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক ভোগেই যে তারা ব্যস্ত!
৪) The Menu
নামকরা রাঁধুনি, শেফ স্লোয়িকের তৈরি করা ‘বিশেষ’ মেন্যুর স্বাদ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বিচ্ছিন্ন এক আইল্যান্ডে হাজির হয় বিত্তবান একদল মানুষ। তারা আইল্যান্ডে পৌঁছানোর পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী নিয়ে মার্ক মাইলডের থ্রিলার/ব্ল্যাক কমেডি ‘The Menu’। ‘Game of Thrones’, ‘Succession’, ‘Shameless’ এর মতো সিরিজে পরিচালনার কাজ করা মার্ক মাইলড থেকে যে পরিমাণ কারুকার্যের আশা করা যায়, তার সবই আছে এই মুভিতে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে কমেডি, চাপা উত্তেজনা, আর আতঙ্কের মজাদার এক মিশেল রয়েছে গল্পে, ঠিক যেন সযত্নে তৈরি করা এক রাঁধুনির মেন্যু। অতিশয় বিনোদনমূলক এই থ্রিলারে আছে রেস্টুরেন্ট এবং ফুড ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে চিন্তা উদ্রেককারী কিছু কথাবার্তা। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক ‘ফুডি কালচার’ নিয়েও আছে বাস্তবসম্মত ও নির্ভুল পর্যবেক্ষণ। খাবারের মতো একান্তই খাঁটি ও রূচিকর একটি অভিজ্ঞতা কীভাবে পুঁজিবাদের নেশায় কৃত্রিম বাণিজ্যিক শোপিসে পরিণত হচ্ছে, এই মূল বক্তব্যকে ঘিরে মার্ক মাইলড তৈরি করেছেন পৌনে দুই ঘন্টার এই চরম উপভোগ্য থ্রিলার।
টিভি, সিনেমায় পুঁজিবাদবিরোধী এই ধারা ভৌগোলিক সীমানা পার করে পাচ্ছে বিশ্বজনীন জনপ্রিয়তা। আর কেনই বা হবে না? বর্তমান বিশ্বের দর্শকদের সিংহভাগের কাছে এ ধারার গল্প যে তাদের নিজেদের জীবন ও সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সাথে এ ধারার প্রজেক্টগুলো যে অবিশ্বাস্য রকমের উপভোগ্য সে ব্যাপারটাও সাহায্য করে নিশ্চয়ই!
মুভি, সিরিজ দেখে মজা পাওয়ার পাশাপাশি ধন-সম্পদের পাহাড় গড়া ওলিগার্কদের উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করার সুযোগের কারণেই বোধহয় এই ঘরানার বিনোদন চরম মাত্রার জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। সৃজনশীল বিনোদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ- চিন্তার স্বাধীনতা থাকা, একই জিনিসকে একটু ভিন্নভাবে দেখা। উপরে আলোচিত চারটি প্রজেক্টের মূল সূত্র এক হলেও নেপথ্যে থাকা সৃজনশীল নির্মাতাদের কল্যাণে প্রজেক্টগুলো হয়ে উঠেছে একান্তই মৌলিক। সিনেমা/টিভিতে পুঁজিবাদবিরোধী এই ধারার এমন সৃজনশীলতা বজায় থাকাই বর্তমান দর্শকদের কাম্য।