‘দ্য ইনোসেন্ট,’ ৮ পর্বের স্প্যানিশ এই সিরিজের পরিচালক ওরিয়ল পাওলো। সিনেমা বানিয়েছেন ৩টি (এখন পর্যন্ত)। এবং সবকটিই বেশ সমাদৃত বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে। বিশেষ করে ‘দ্য বডি’ (২০১২), এবং ‘দ্য ইনভিজিবল গেস্ট’ (২০১৬)। শৈল্পিক উৎকর্ষের দিক হতে ঢের ভালো কাজ যে এসব হয়েছে তেমনটি নয়। তবে দর্শকমাত্রই, বিশেষত এই অঞ্চলের এবং উপমহাদেশের, নন্দন; ন্যারেটিভ ফর্ম ছেড়ে দিয়ে ‘কন্টেন্ট’ কামড়ে থাকবেন। আর সেদিক থেকে বুদ্ধিমান ওরিয়ল পাওলো জানেন, দর্শকের ঘাড় শক্ত করে ধরে আপোষেই কীভাবে চেয়ারে বসিয়ে রাখতে হয় ‘এন্ড ক্রেডিট’ রোলে যাওয়ার আগপর্যন্ত।
বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা, প্রযুক্তির সহজলভ্যতার আগ্রাসন, মানুষের দিশেহারা ও স্বার্থবাদী অবস্থা, পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ধুম্রজালের ধাঁধা- সব মিলিয়ে সময়টা বড্ড নাজেহাল আর নাজুক। তাই এখন ২ ঘণ্টার আর্টহাউস সিনেমা কিংবা ভাবনার উদ্রেক ঘটানোর মতো সিনেমা দেখে তৃপ্তি পাওয়ার চেয়ে ৭/৮ ঘণ্টার কোনো ভায়োলেন্ট ক্রাইম, থ্রিলার কন্টেন্ট এক বসায় দেখাই হতবুদ্ধিকরভাবে সহজ! বিষয়গুলো টানছি, কারণ সেই সবকিছুই কিন্তু আজকের বাজারে, ভায়োলেন্ট কন্টেন্টের চাহিদা সর্বোচ্চে পৌঁছিয়েছে। আর আলোচিত সিরিজ তো তেমন চাহিদারই কন্টেন্ট। যাকগে সেই আলাপ। এটা আলোচনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবে। অনেক দীর্ঘ আলোচনা। কিন্তু টোনটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই আনা হয়েছে। সিরিজটা মানুষ উপভোগ করুক, কিন্তু যে ‘কিন্তু’ থেকে যায়, সেটাতেও কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করুক। অস্পষ্ট আর রহস্যময় শোনালে, তা-ই শ্রেয়।
চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক ওরিয়ল পাওলোর কথা বলছিলাম। তার সিনেমাগুলো দর্শকপ্রিয় হবার কারণ তার নিজস্ব ফর্মুলা। থ্রিল থাকে, গল্পে প্রচুর অপ্রত্যাশিত বাঁক থাকে, আপাতদৃষ্টিতে টুইস্টের যৌক্তিক ব্যাখ্যা আর কারণ থাকে, এবং পৃষ্ঠতলে রেখেই ধূর্ততার সাথে ‘বিবরণীয়’ করে তুলতে পারেন নিজের কাজ, চরিত্রগুলোকে আবেগ দ্বারা সিদ্ধান্ত নিতে আর চালিত হতে দেন। সর্বোপরি, সেই আবেগ ড্রামাটিক পন্থাতেই দর্শকের মাঝে সঞ্চার করতে পারেন। ‘দ্য বডি’ আর ‘দ্য ইনভিজিবল গেস্ট’-এর কথাই ধরুন না। তবে প্রত্যাশিতভাবেই, তার সর্বাপেক্ষা উচ্চাকাঙ্ক্ষী আর দক্ষতাসম্পন্ন কাজ এই সিরিজ- ‘দ্য ইনোসেন্ট’।
প্রথম এপিসোডে গল্প শুরু হয় ম্যাথিউ ভিদালকে দিয়ে। পড়ালেখায় তীক্ষ্ণ, সাতপাঁচে না থাকা, জ্বলজ্বলে ভবিষ্যৎওয়ালা যুবক। কিন্তু এক রাতের লাল, নীলের চোখ-ধাঁধানো আলোর পার্টিতেই তার জীবনের জ্যামিতিক সমীকরণ নির্দয়ভাবে পালটে যায়। অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে বেঁধে যায় হাতাহাতি। সদ্য যুবক বয়সে উত্তীর্ণ হয়েছে। টগবগে রক্ত তো নারী আর মাদকই চাইবে। হরমোনের বাঁধাহীন দৌড়ের সময় তো এখনই। তুচ্ছ ঘটনার মূলকেন্দ্রে তো সেটাই। ভিদাল কিন্তু জড়াতে চায়নি কোনোভাবেই। ওপাশ থেকেই বাধ্য করা হয়েছে। হাতাহাতির একপর্যায়ে বেখেয়ালের ধাক্কায় পাথরে মাথা ঠুকেই ঘাড় মটকালো বিপক্ষের ছেলেটার! দানি নাম। ঘটনাস্থলেই মৃত। ভিদালের চোখে ভয়, অনুশোচনা। চার বছরের জেল হলো। ভিদাল নিজ হাতে একটা মাছিকেও আঘাত করার সক্ষমতা রাখত না। কিন্তু স্থান, কাল, পাত্র কতকিছুর দিকেই তো ধাবিত করে। ধাবিত হতে বাধ্য করে।
ভিদাল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ভাইয়ের ফার্মহাউজে ঢুকল ব্যবসা সামলাতে। ‘দ্য ওয়ান’কেও পেল। স্ট্রোক করে ভাই মারা গেল। অতীত জেনেও ভিদালের ‘দ্য ওয়ান’ অর্থাৎ অলিভিয়া কোস্টা রয়ে গেল। সন্তান আসার সুখবরও পেল তারা। সেদিনই হাসপাতালে দানির বাবাকে দেখল। সন্তানহারা সেই বাবা। জেলে তাদেরকে ডেকেছিল ভিদাল। ক্ষমা চেয়েছে, কেঁদেছে। দুর্ঘটনাই ছিল আসলে। দানির মা ভিদালের চোখে সত্যিকারের অনুশোচনা, সত্যতা দেখল। কিন্তু বাবা ঘৃণায় অন্ধ। সে নিজেও যে এক অপরাধবোধে ভুগছে! ভিদালকে ৮ বছর পর হাসপাতালে দেখে চকিতেই যেন আবার অতল শূন্যতা আর ক্রোধ বাসা বাঁধল। ভিদাল তো বুঝতে পারেনি তার সাজানো গোছানো জীবন যে ওলটপালট হবে, এটা তার পূর্বাভাস!
অলিভিয়াকে অফিসের কাজে যেতে হলো বার্লিনে। এরই মধ্যে ভিদালের মোবাইলে ছবি এলো। বিছানায় প্রায় নগ্ন অলিভিয়া ঘুমোচ্ছে। আর সেটার ভিডিও করে নিজেকেও আয়নায় প্রকাশ করছে অন্য একজন পুরুষ। ভিদাল জানে না, সে কে। কী চায়। কিন্তু অলিভিয়ার উপর তার বিশ্বাস আছে। হৃদয়ের গভীর থেকেই কিছু একটা তাকে ইংগিত দিচ্ছে। এর মধ্যে গানপয়েন্টে রেখে হত্যার হুমকিও দিয়ে গেলো একজন। জেলে থাকাকালীন ভিদালকে সর্বদা উত্যক্ত করা এক বন্দী ঘাড় মটকে মারা গিয়েছিল। হত্যাটা আসলেই ভিদাল করেছিল কিনা, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই; অনুমান ছাড়া। সেই ঘটনার কোনো যোগ কি আছে বর্তমানে? আর অলিভিয়া কে, তার অতীতই বা কী?
গল্পের দ্বিতীয় ন্যারেটিভ ডিটেক্টিভ ওর্তিজকে ঘিরে। বাবাই ছিল পরম বন্ধু। কিন্তু চোখের সামনেই সেই বাবাকে পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করতে দেখে ওর্তিজ। মায়ের সাথে থাকা হয়নি। বড় হয়েছে একা। সব শ্রম ঢেলে পুলিশ হয়েছে। ভালোবাসা পেয়েছে এক ছেলের। গর্ভবতী হয়েছে। কিন্তু পরিবার শুরু করাই তার কাছে দুঃস্বপ্নের। প্রেমিককে না জানিয়ে হয় গর্ভপাত। তারপর তার কাছ থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিচ্ছিন্ন করল। আবার একা। আবার পরিশ্রম। অবশেষে ডিটেক্টিভ হয়েই ছেড়েছে এই মেয়ে। প্রথম বড় কেইস হলো এক নানের বীভৎস হত্যা। উপর থেকে পড়ে গোটা মুখমণ্ডল থেঁতলে গেছে একদম। চেনার উপায় নেই। আত্মহত্যা মনে হলেও ওর্তিজ নিশ্চিত, শেকড় অনেক গভীরে। নানের পূর্বপরিচয় আছে। স্বেচ্ছায় আসেনি এই পথে। ছদ্মবেশের কয়েক বছর আগে সম্পূর্ণ অন্য এক জীবন ছিল। সেই পরিচয় জানতে গিয়েই উপরমহলের বাঁধা। সাধারণ কোনো নান মারিয়া ছিল না।
হত্যাকারী কিছু খুঁজতে এসেছিল। হত্যার আগে ফোন গিয়েছিল ভিদালের নাম্বারে। অথচ ভিদালের সংযুক্তি থাকারই কথা না! ওর্তিজ হাজির হলো ভিদালের দুয়ারে। তাতে কিছু সহজও আর হয়নি। ওদিকে এস.সি.ইউ-র দুই অফিসার ছুটছে কিছু ভিডিওটেপের পেছনে। বেহাত হয়ে গেলে অনেক রাঘববোয়াল আটকা পড়বে জালে। সেই জাল ছিন্নভিন্ন করতে গিয়ে তারা ধ্বংসের মুখে দাঁড় করাতে পারে গোটা সিস্টেমকে। আর ওই কুখ্যাত মাফিয়া অ্যানিবেল কি আদৌ গিয়ে পড়েছে নরকের দুয়ারে? ভিদাল, অলিভিয়া, নান মারিয়া, ডিটেক্টিভ ওর্তিজ, কিমি, ইবাই সাইজ, দানির বাবা-মা; নিজ বৃত্ত থেকে ছোটা এই প্রত্যেকেরই নিজস্ব উদ্দেশ্য আছে। কোনো না কোনো জায়গায় তাদের আন্তঃসংযোগ তৈরি হচ্ছে কিংবা একটা দ্বন্দ্ব গড়ে উঠছে, যা একান্তই ব্যক্তিগত।
ওরিয়ল পাওলোর এই সিরিজের মূল ভিত্তিপ্রস্তর, অনুষঙ্গ নেওয়া হয়েছে আমেরিকান থ্রিলার ঔপন্যাসিক হারলান কোবেনের একই নামের উপন্যাস থেকে। বর্তমান বিশ্বে থ্রিলার লেখক হিসেবে তিনি ভালোই জনপ্রিয়। ‘টেল নো ওয়ান’, ‘ডোন্ট লেট গো’, ‘কট’, ‘গন ফর গুড’, ‘ফুল মি ওয়ান্স’- এই উপন্যাসগুলো অনুবাদের সুবাদে হারলান কোবেন বাংলা অঞ্চলেও বেশ সুপরিচিত। সেসব যাক। তবে ওই সূত্রে দুটো কথা তার লেখা নিয়ে বলতে হয়, সিরিজের গল্পের প্রকৃতি বিশ্লেষণে। ভদ্রলোক বেশ ভালোই থ্রিলার লেখেন। তার গল্প সাজানোতে, লেখার ভাষাতে, চরিত্রায়নে কিন্তু চল্লিশ দশকের ফিল্ম-নোয়াহ্ সহ, ‘৭০, ‘৮০ দশকের ক্লাসিক হলিউডি থ্রিলারের ভাব পাওয়া যায় ভালোভাবেই। অনেক অনুষঙ্গ চোখে পড়ে। স্টাইলটা সিনেমারই। তার বয়ানভঙ্গী যথেষ্ট শক্তপোক্ত। ফলে পাঠককে ধরে রাখতে পারেন। টুইস্ট এন্ড টার্ন দেবার ক্ষেত্রেই তার খুব খ্যাতি। এবং এই ব্যাপারে আসলেই কোবেন অত্যন্ত বিচক্ষণতা আর বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দেন।
তবে তার যে ব্যাপারটি প্রশংসনীয়, সবশেষে গিয়ে কোবেন কিন্তু ধূর্ততার সহিত সাধারণ। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডিসেপ্টিভলি সিম্পল।’ কোবেন গল্পের পুরোটা সময় ধরে যেভাবে অপ্রত্যাশিত উপায়ে বাঁক ঘুরান, চড়াই উতরাইতে নিয়ে যান, একেকজনের রহস্যময় পরিচিতি খোলাসা করেন, সেভাবে পরিসমাপ্তিতে ওই অপ্রত্যাশিতরূপেই আসল উদ্দেশ্যটাকে সাধারণ বিষয়ের মোড়কে সামনে আনেন। কাব্যিকভাবে এই ব্যাপারকে একটু অন্যরূপে ব্যাখ্যা করা যায়, ‘একটি ফুলের জন্য।’ দিনশেষে জীবনটা ভীষণ আটপৌরে। আটপৌরে বলেই, সেটাকে ঢাকতে জীবনের এত জটিল সব সমীকরণ। একটু ভারিক্কি বিশেষণ ব্যবহার করলে বলতে হয়- কোবেন ‘মর্মভেদী’। গোটা গ্যামুট শেষ করে এসে আবেগটাকে ছোঁন, এটাই সার কথা। এবং এই প্রত্যেকটা গ্যামুট, এসকল বিষয়াদি এক রেখেই লেখা এই সিরিজের গল্পও। আলাদা করে আর কিছু যোগের দরকার পড়ে না। হারলান কোবেনের উপন্যাস থ্রিলার সিনেমা, সিরিজ বানানোর জন্য উৎকৃষ্ট। কারণ ওই যে, সিনেম্যাটিক কড়চা। এই অংশের শুরুতেই তো সেটা নিয়ে বলা হয়েছে। আর নেটফ্লিক্স সেটা বুঝেছে বলেই, কোবেনের ১৪টি বই থেকে লিমিটেড সিরিজ নির্মাণের চুক্তি করেছে। এই সিরিজ সেই চুক্তিরই প্রথম কাজ।
সিরিজের চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক ওরিয়ল পাওলো কোবেনের লেখার আসল রসদ আর নির্যাস দুটোই যে পুরোদমে বুঝেছেন তা বেশ পরিষ্কার। তার ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্ট দেখে সেটা আঁচ করা যায় খুব সহজেই। তার স্টাইল আর গল্পকার কোবেনের স্টাইল একটা সমতার জায়গায় আগে থেকেই ছিল বিধায় এই সিরিজ ভালোভাবেই কাজ করেছে; যেভাবে করার কথা। অপ্রত্যাশিত বাঁক, থ্রিল, টুইস্টের যৌক্তিক ব্যাখ্যায় একজনের উপন্যাস আর আরেকজনের চিত্রনাট্য— দুটোই সহাবস্থানে থেকেছে।
ওরিয়ল পাওলো কালক্ষেপণ না করে, সিরিজের এপিসোডিক ফরম্যাট বুঝে শুরু থেকেই চরিত্র গঠনের কাজে লেগে পড়েছেন এবং প্রত্যেক এপিসোডের শেষে একটা করে বাঁক বদল করেছেন, যেটা দর্শককে ধরে রাখায় কাজ করেছে অমোঘ রূপে। অথচ সচেতন আর সরলরৈখিকভাবে গোটা জিনিসটাকে দেখলে বোঝা যাবে- কোনো কোণই খুব ভিন্ন, অনন্য নয়। কিন্তু সাজানো আর জোড়া লাগানো হয়েছে এমনভাবে, প্রকাশ করা হয়েছে এমন মুহূর্তে যেটা অনুমেয় নয়। এ কারণেই তো একাধিকবার ‘ধূর্ততা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা যতটা কোবেনের গল্প লেখায়, ততটাই ওরিয়ল পাওলোর চিত্রনাট্য লেখায় আর পরিচালনায়।
তবে তুলনামূলক সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা হলো, ভয়েসওভার ন্যারেশানে চরিত্রদের সম্পর্কে যাবতীয় সকল তথ্য আওড়ে যাওয়া। চরিত্রগুলো বর্তমানে যে প্রেরণা নিয়ে ছুটছে, সেই জায়গায় আসার আগ অব্দি তাদের গোটা জীবনটাকেই ভয়েসওভার ন্যারেশানে বর্ণনা করা হয়েছে। তা-ও সেটা দর্শককে তাদের জায়গায় বসিয়ে। হয়তো একটু ইন্টারেক্টিভ সংযোগ তৈরির চেষ্টা। সামনের দর্শককে “তুমি/আপনি” সম্বোধন করে, সেই চরিত্র বানিয়ে এরপর জীবন বৃত্তান্ত ভয়েসওভারে পড়ে শোনা হয়। প্রথম এপিসোড থেকেই বিভিন্ন চরিত্র সম্বন্ধে দর্শককে জানাতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। হয়তো এই ধারা উপন্যাস থেকেই নেওয়া। কিন্তু জিনিসটি লেখ্যরূপে কাজ করলেও ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্টে করেনি।
শটের পর শট বসিয়ে, ভয়েসওভারে সবকিছুর বিবৃতি দেওয়াটা পুরোপুরি একটা স্থুল সিদ্ধান্তই হয়েছে। ক্লেশ জাগায়। সিনেমা হলেও বিষয়টা দৈর্ঘ্যের চিন্তায় আমলে নেওয়া যেত। কিন্তু সাড়ে ৭ ঘণ্টা পেয়েও, এই উপায়ে বিবৃতি দেওয়াটা উপযুক্ত হয়নি। বরং মেট্রিক মন্তাজ আর ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ সমানভাবে ব্যবহার করে, এই তথ্যগুলো আরো প্রভাবশালী ভিজ্যুয়ালে দেওয়া যেত। এছাড়া, সিরিজের বিস্তৃত গল্প আরো অনেক ছোট ছোট পিস, ‘রেড হেরিং’ টেকনিক জায়গায় জায়গায় রেখেছে রহস্য ঘনীভূত করার জন্য। কিছু পিস পরিসমাপ্তি না পেলেও, খুব একটা ভাবায় না। প্রথমেই যেহেতু ধরে নিতে হচ্ছে, সাসপেন্স আর থ্রিলই এখানে মুখ্য; তাই ওগুলো অদেখা তো করতেই হয়। সূক্ষ্মভাবে নজর দেওয়া ছাড়া সেসব চোখেও পড়বে না অবশ্য। বুদ্ধিদীপ্ততার সাথেই ঢাকা হয়েছে।
গভীর বিষয়াদি কিংবা বক্তব্য নিয়ে এই সিরিজ ডিল করেনি। মানে, সাবটেক্সটবহুল না আরকি। পৃষ্ঠতলেরই কাজ। তবে যে ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে এসেছে তা হলো- জীবনে দ্বিতীয় একটা সুযোগ পাওয়া। জীবন সবাইকেই দ্বিতীয় সুযোগ দেয়। সেটা দেখতে আর বুঝতে সে-ই পারবে, যার মাঝে সেই সদিচ্ছা আছে। অন্যেরা তো অভিযোগেই দায় সারবে। তো এই সিরিজেরও কেন্দ্রের বিষয় সেটা। ভিদাল, অলিভিয়া, মারিয়া, কিমি, ওর্তিজ— সবার চরিত্রেই যেটা ফিরে ফিরে আসে। এই সুযোগে বলতেই হয়, নিখুঁত কাস্টিং পেয়েছে এই সিরিজ। সকলের অভিনয় এতটা পরিমিত আর বিশ্বাসযোগ্য যে, গল্পের ধারাবাহিকতায় দর্শককে ধরে রাখতে তারাও ভূমিকা রেখেছে। আর ওরিয়ল পাওলোর কাজের আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, থ্রিল ও টুইস্টের পরতে ড্রামাটিক্যালি প্রভাবযুক্ত হওয়াটা। এই সিরিজ সেক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা যোগ্য উদাহরণ।
তাড়াহুড়ো ছাড়া ধীরে সুস্থেই এই সিরিজ তার কোণগুলো, চরিত্রগুলো প্রতিষ্ঠা করেছে, এগিয়েছে; ড্রামাটিক মেকানিজমেই। তার পেসিং স্টাইলটা মসৃণ হবার কারণে গতিতেও মারদাঙ্গা থ্রিলারের ভাব অনুভূত হয়। ড্রামা ঠিকঠাক রেখে, মেলোড্রামাটিক না হয়েই, দর্শকের আবেগ ধরতে পেরেছে সিরিজটি। আবেগীয় দিক থেকে ভার আছে যথেষ্ট। সেটা আবার আছে ভায়োলেন্সের দিক থেকেও। গোরি ইমেজারিগুলো প্রচন্ড অস্বস্তিদায়ক। রীতিমতো স্ল্যাশার সিনেমার মতো। কিন্তু সেগুলোর মতো মজাদার অনুভূতি দেওয়ার চেষ্টা করেনি। বরং, দেখে থাকা দায় হয়ে উঠেছে অনেক দৃশ্যে। এবং সেটা করা হয়েছে ভায়োলেন্সকে আকর্ষণীয় না করে তুলতে। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো। ওরিয়ল পাওলো ভিডিওটেপগুলোকে ‘ম্যাকগাফিন’-এর মতো একটা উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। না, ম্যাকগাফিন নয়। কারণ এক্ষেত্রে দর্শক জানে, টেপগুলো কীসের। ব্যবহার পদ্ধতির কথাতেই মূলত ম্যাকগাফিনের রেফারেন্স এসেছে।
শেষ এপিসোডে এসে, ওরিয়ল পাওলো সংসক্তি রেখেই পিসগুলো জোড়া লাগিয়েছেন। নিগূঢ় রহস্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যাটাই সামনে এনেছেন, যেমনটা তার স্টাইল। চরিত্রগুলোকে সবসময় তিনি একটা চরম পরীক্ষার অবস্থায় আটকে দেন, যেখানে থেকে ফিরে আসা দায়। এই সিরিজেও সেটা ছিল। এবং তার সাথে অনেক অনেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডিটেলের যোগটাও করেছেন সূক্ষ্ম আর সতর্করূপে। ওই, আলোচনার শুরুতে যেমনটা বলেছিলাম, পৃষ্ঠতলেই রাখেন, কিন্তু তার মাঝেই ‘বিবরণীয়’ করে তোলেন। ফিল্মমেকিং বেসিক স্টাইলে রেখেই চিত্রনাট্যে মনোযোগ দেন। তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রোডাকশন সেই বিষয়টাই নিশ্চিত করে। নেটফ্লিক্সের এই যুগে ‘বিঞ্জ’ নামক খেলো টার্মটা তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণই হয়ে উঠেছে সিরিজ বিবেচনার ক্ষেত্রে। তো সেটাকে ধরেই বলতে হয়, স্প্যানিশ সিরিজ ‘দ্য ইনোসেন্ট’ তেমনই একটি সিরিজ। এবং একইসাথে ইমোশনালি ক্ষমতাধর।