বাইবেলে বলা আছে, প্রথম মানুষ আদম মৃত্যুর পর মাটিতে ফিরে যান। তার মতো করে একইভাবে যেসব মানুষ মারা যায়, তারাও মাটিতে ফিরে যায়।
তাই নিজের মরণশীলতার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ কখনও নির্জলা। আবার কখনও ভয় মিশ্রিত। এ নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র গান, কবিতা, সাহিত্য। অগণিত দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ মৃত্যু বিষয়ক নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে নিজেদের জীবন উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সন্তোষজনক উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি। বর্তমান যুগে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের শীর্ষে বসবাস করেও আমাদের কাছে মৃত্যু বরাবরের মতোই রহস্যময়। মানুষ তাকে জয় করতে পারেনি। সে সর্বদা ওঁৎ পেতে থাকে আমাদের আশেপাশে। শেক্সপিয়র মৃত্যুকে তুলনা করেছিলেন এক অচিন দেশের সাথে, যেখান থেকে কোনো পথিক ফেরেনি।
যারা নিয়মিত সিনেমা দেখেন এবং সিনেমা নিয়ে ভাবেন, তাদের ইংমার বার্গম্যানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। স্বীয় কর্মগুণে সুইডিশ এই মায়েস্ত্রো বিশ্ব সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তার ভাবনা আর কাজ সিনেমাপ্রেমী ও পরিচালক উভয়ের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল, আছে এবং থাকবে। খুব কম মানুষই সিনেমাশিল্পে তার মতো ছাপ রাখতে পেরেছেন।
অজ্ঞেয়বাদী মানুষটির সিনেমায় মৃত্যুভাবনা বার বার ফিরে এসেছে। তার ফিল্মোগ্রাফির দিকে তাকালেই তা আমরা বুঝতে পারব। ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপারস-ও এর ব্যতিক্রম নয়। বার্গম্যানের সেরা সিনেমার কথা বললে সকলে দ্য সেভেন্থ সীল (১৯৫৭), পারসোনা (১৯৬৬) বা ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭)-এর নাম নেবেন। ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপারসের নাম সেই তালিকার উপরের দিকে হয়তো স্থান পাবে না। তবে এটি তার সবচেয়ে সুনির্মিত চলচ্চিত্রসমূহের একটি, হয়তো বিষাদময়তার দিক থেকেও শীর্ষস্থানীয়।
ধরুন, কেউ কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তিনি জানেন যেকোনো সময় দর্শন দিতে পারে যমদূত। কিন্তু মৃত্যু ঠিক কখন আসবে তা তিনি জানেন না। তাই অপেক্ষায় আছেন তার দেখা পাবার জন্য। মৃত্যুর জন্য পথ চেয়ে থাকার চেয়ে করাল কোনো অভিজ্ঞতা সম্ভবত হতে পারে না। ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপারস-এ আমরা এমনই এক পরিস্থিতির দেখা পাই।
সিনেমার মূল বিষয়বস্তু অ্যাগনেস (হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসন)-এর মৃত্যুযাত্রা। আমরা বুঝতে পারি তার কোনো একধরনের ক্যান্সার হয়েছে। এবং এই রোগ ক্রমশ তার ভেতরকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে। ক্ষণে ক্ষণে সে আর্তনাদ করছে, কখনও কখনও কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতেও। তবুও মাঝে মাঝে সে সুখ খুঁজে নিচ্ছে সহজ-সরল ব্যাপারগুলোতে। যেমন- একটু সময়ের জন্য বাইরে হাঁটতে পারা বা শান্তিমতো এক চুমুক পানি পান করায়। শেষ দিনগুলোতে তাকে সঙ্গ দিচ্ছে তার বিশ্বস্ত সহচর অ্যানা (ক্যারি সিলওয়ান)। আরও উপস্থিত আছে তার আপন দুই বোন; কারিন (ইনগ্রিড থুলিন) এবং মারিয়া (লিভ উলম্যান)।
এখানে বার্গম্যানের গল্প বলার ধরন নন-লিনিয়ার। তিনি সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছেন ফ্ল্যাশব্যাক এবং ড্রীম সিকোয়েন্সের। অ্যাগনেসের ডায়েরিতে করা স্মৃতিচারণের দৃশ্যায়নও হতে দেখি আমরা, যা থেকে আমরা বুঝতে পারি তিন বোনের ভেতর এককালে হৃদ্যতা থাকলেও সেই তন্তু বর্তমানে কেটে গেছে। এসব সিকোয়েন্স আমাদের এখানকার চরিত্রদের ব্যাপারে তথ্য দিলেও গল্পের এগিয়ে যাওয়াতে গতিসঞ্চার করে না। গল্পের ফোকাস থেকে যায় অ্যাগনেসের আসন্ন মৃত্যুর উপরই। সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাওয়া দূরত্বের দরুন দুই বোন অ্যাগনেসের যন্ত্রণাক্লিষ্ট সময়ে দূরে সরে থাকে। তার ভরসা কেবল ঐ অ্যানা, যে তাকে স্নেহ করে নিজের মৃত মেয়ের মতো।
চারটি প্রধান চরিত্রের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাব পেশায় চিত্রশিল্পী অ্যাগনেস ছিল অবিবাহিত। দুই বোনের অনুপস্থিতিতে সে প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকতো। অতীতের স্মৃতিতে আমরা দেখি তার সাথে তার মায়ের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তিনি তার চেয়ে মারিয়াকে বেশি পছন্দ করতেন এবং তা সরাসরি তাকে বুঝিয়েও দিতেন।
কারিনের ক্ষেত্রে ঝামেলা হলো সে অন্যের স্পর্শ সহ্য করতে পারে না। সে বার বার সবাইকে নিষেধ করে তাকে না ছুঁতে। অন্যের পাশাপাশি সে নিজেকেও সমপরিমাণ ঘৃণা করে। একটা দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, সে বৈবাহিক কর্তব্য পালনের চেয়ে নিজেকে রক্তাক্ত করে তা থেকে নিস্তার পাওয়াকেই শ্রেয় বিবেচনা করে। এসবের কারণে তার সাথে কারো বন্ধুত্ব হওয়া দুষ্কর। কিন্তু তার বন্ধু কেউ হোক, তা-ও আসলে সে চায় না।
অন্যদিকে, মারিয়া চরম মাত্রায় ম্যানিপুলেটিভ। সে স্বামীর উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে অপকর্মে লিপ্ত হয়। এবং পরবর্তীতে স্বামীকেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে। এ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই।
চার নারীচরিত্রের সর্বশেষজন অ্যানা। তার মাঝে আদর্শ খ্রিস্টান এবং চিরায়ত নারী চরিত্রের সমস্ত গুণাবলি প্রকাশিত হয়। কম বয়সে কন্যা হারালেও সে স্রষ্টায় বিশ্বাস হারায়নি। আবার রক্তের কেউ না হয়েও সে-ই অ্যাগনেসের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়।
নিজেদের চরিত্রে সকল অভিনেত্রী তাদের সেরাটা দিয়েছেন, যা এর কাল্ট স্ট্যাটাস আনয়নে সহায়তা করেছে। এছাড়া ঐ সময়ে বাণিজ্যিকভাবে বার্গম্যানের সিনেমা খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। মূল তিন অভিনেত্রী রাজি হন ডিস্ট্রিবিউশনের পর নিজেদের পারিশ্রমিক নিতে, যে কারণে আলাদা সম্মান তারা পেতেই পারেন।
কারিন চরিত্রের নামসহ ৯১ মিনিট ব্যাপ্তির সিনেমার মূল ভাবনা বার্গম্যান পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকে। এ থেকে মায়ের সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। সিনেমার একপর্যায়ে অ্যাগনেস বাইরে তাকাতে গেলেও, সেই দৃশ্য আমাদের দেখতে দেন না পরিচালক। তিনি ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেন ঘরের ভেতর। এভাবে একই ঘরে চার নারী চরিত্রকে বন্দী করে তিনি সম্ভবত বলতে চান- এরা একই আত্মার চারটি দিক।
বার্গম্যানের অন্যান্য সিনেমার চেয়ে এটি একদিক থেকে ব্যতিক্রমীও। এখানে পর্দায় আমরা বার বার দেখতে পাই ক্রিমসন বা ঘন লাল রঙের ব্যবহার। পর্দায় লালের ছড়াছড়ি থেকে শুরু করে, প্রাসাদোপম বাড়ির সাজসজ্জা; সর্বত্র লালের প্রাবল্য। তার কারণ?
বার্গম্যানের মতে আত্মার রং লাল!
এছাড়া সাদা এবং কালো রংয়ের ব্যবহারও পরিলক্ষিত হয়েছে এখানে। এসব রংয়ের ব্যবহারের মাধ্যমে চরিত্রদের গূঢ় অনুভূতিকে ভাষা দিয়েছেন পরিচালক। তার নিজের ভাষ্য হলো, এটি ব্যতীত তার সকল সিনেমাকে চাইলেই সাদা-কালোতে ভাবা যায়।
ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপারসে সিনেম্যাটোগ্রাফির কাজ করেছেন স্ভেন নিকভিস্ট, যার সাথে প্রায়শই কাজ করতে দেখা গেছে বার্গম্যানকে। ১৯৭৪ সালের অস্কারে বেস্ট পিকচার, বেস্ট সিনেম্যাটোগ্রাফিসহ মোট ৫টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায় সিনেমাটি। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো অস্কার বগলদাবা করেন নিকভিস্ট।
কেবল এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালুর জন্য সিনেমাটি দেখতে বসলে হতাশ হতে হবে। অন্যান্য শক্তিশালী সিনেমার মতো এটাও কেবলমাত্র দেখার চেয়ে অনুভব করার মতো বিষয়। এছাড়া, বার্গম্যান আর তার সৃষ্ট চরিত্রদের জটিল মনস্তত্ত্ব, উনবিংশ শতকে সুইডিশ আচার-সংস্কৃতির উপস্থাপন- এসবের ফলে কেবল দেখতে বসাটাও জটিল। কারণ এখানকার চরিত্ররা অনেক কার্যকলাপ করে, যা থেকে দর্শক চোখ সরিয়ে নিতে চাইবেন। কিন্তু বার্গম্যান বা নিকভিস্ট, কেউই আমাদের দৃষ্টি সরাতে দেন না।
এটি আপনাকে ভাবনার খোরাক দিতে পারে। আপনি অনুভব করতে পারেন একজন গুণী মানুষের মৃত্যুভাবনা এবং সেটাকে সেলুলয়েডে বন্দী করায় তার মুন্সিয়ানা।