“কখন কোথায় কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে, এবং কে তা ঘটাবে সেটা জানতে আমাদের অনেক বাকি আছে…”
লোলিত কুমার। বেঁচে থাকতে ছিলেন একজন ফিল্মমেকার। তবে মৃত্যুর পরও আর ঐ পেশা ছাড়তে পারেননি। সার্বক্ষণিক ক্যামেরা অন করে তীক্ষ্ণ নজর রেখে যাচ্ছিলেন ছেলের ওপর। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো কই? হ্যাঁ, তার ক্যামেরা এবার আপনার দিকেই তাক করা… অ্যাকশন!
হারবার্ট সরকার ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে সুইসাইড করেছেন। মৃত্যুর আগে সুইসাইড নোটে লিখে রেখে গেছেন, “চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চললো। দোবেড়ের চ্যাং দেকবি? দোবেড়ের চ্যাং দেকাবো? ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ।” মৃত্যুতে নিঃশেষ হয়নি তার। বরং হয়েছেন মিডিয়ার প্রধান শিরোনাম। তিনি অশনি বার্তা দিয়েছেন শব হয়ে শ্মশানে যাবার পরে। কিন্তু কে এই মৃত্যুঞ্জয়ী? উত্তরে হয়তো অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে হারবার্টকে। তবে পুলিশের অনুমান- এই ব্যক্তির সন্ত্রাসবাদী বা গোলমালকারীদের সাথে সংযোগ ছিল। পুরনো রেকর্ড বলে- নকশালবাদীদের সাথে একসময় ছিল তার ঘোর আঁতাত। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্য আকাদেমি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত উপন্যাস অবলম্বনে হারবার্ট নির্মাণ করেছেন।
আপাদমস্তক রাজনৈতিক ফিল্ম বলতে যেরকম বোঝায়, হারবার্ট পুরোপুরি সেরকম। আপাত আলাভোলা উদ্ভট স্বভাবের হাস্যরস সৃষ্টিকারী হারবার্টকে কেন্দ্র করে নির্মাতা তুলে ধরেছেন সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলন প্রেক্ষাপট। সেই আন্দোলনের চেতনা যে এখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, এবং যেকোনো মুহূর্তেই তা আবার প্রতিবাদী রূপ নিতে পারে- সেই সংকেতও দিতে চেষ্টা করা হয়েছে মুভিতে। সেই প্রতিবাদ হতে পারে বিনুর মতো সচেতন কোনো সংগ্রামীর পক্ষ থেকে, অথবা হারবার্টের মতো নিরীহ, শোষিত, উপেক্ষিত কোনো উৎস দ্বারা। শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বহুদিনের সুপ্ত প্রতিবাদ প্রবলভাবে বিস্ফোরিত হয়ে ত্রাসে রূপ নিতে পারে। এমন কঠিনতর বার্তাই দিতে চায় এ ফিল্ম। ক্রসওয়ার্ড পাজলের রীতিতে বোনা হারবার্ট প্রকল্পনার পরতে পরতে ডার্ক হিউমারের বাঁকা হাসি। সেই বাঁকা হাসি কখন অট্টহাসিতে রূপ নিয়ে বিশ্বকে চমকে দেবে তারই অপেক্ষায় আপামর জনতা। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটে শ্মশানের চুল্লিতে শবদাহে। চুল্লিতে প্রবেশ করে হারবার্ট জানান দেন, তাকে নিয়ে গবেষণার এখনো ঢের বাকি! রাজনৈতিক এ সিনেমায় ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের রয়েছে দারুণ প্রভাব।
জন্মের পর থেকেই হারবার্ট অসংখ্য মৃত্যু দেখে বড় হয়েছে। প্রথম জন্মদিনে চলচ্চিত্র পরিচালক বাবা লোলিত মারা গেল। এরপর একদিন হঠাৎ মা শোভা, মারা যান ছাদে কাপড় শুকাতে দিতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। সিনেমাটোগ্রাফার সোমক মুখার্জীর সেই সিনের চিত্রগ্রহণ দুর্দান্ত। বিদ্যুতায়িত হওয়া না দেখিয়েও যেভাবে মৃত্যুকে উপস্থাপন করলেন তা অসাধারণ। কৈশোরের বন্ধু রবি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বেছে নেয় পানিতে ডুবে মরার সিদ্ধান্ত। এদিকে স্নেহের ভাইপো নকশালবাদী কমরেড বিনু খুন হয় পুলিশের গুলিতে। এই ভাইপো বিনুর সাথেই হারবার্ট একসাথে আওয়াজ তুলেছে— “পুলিশের লাঠি, ঝাঁটার কাঠি, ভয় করে না কম্যুনিস্ট পার্টি”। হারবার্টের জীবন চিত্রনাট্যের পুরোটাই অপমৃত্যুতে ঠাসা। কৈশোরে ওর একটা প্রেম ছিল- বনলতা, যাকে ও ডাকত ‘বুকি’ বলে। তার ট্র্যাজিক জীবনে সেই প্রেমেরও যবনিকা ঘটে বছর না ঘুরতেই।
অনাদরে বড় হওয়া হারবার্ট বয়সকালে তন্ত্রমন্ত্র, প্ল্যানচ্যাট ইত্যাদি বুজরুকি করে পয়সা রোজগার করতে শুরু করে। মৃত ব্যক্তি কেমন আছে জানতে তার নিকট শরণাপন্ন হলে সে পানি না পেয়ে চাঁপাগাছ মরে যাচ্ছে, তাই গাছের মালিক পরলোকে কষ্ট পাচ্ছে বলে অনুসারীদের জানায়। এর সাথে পরামর্শ দেয় গাছটা মরে গেলে তুলে ফেলে সেখানে নতুন আরেকটা চারাগাছ লাগিয়ে দিতে। আর বেঁচে থাকলে একটু পানি দিতে, যেন মৃতপ্রায় গাছটা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কে জানে এ কীসের ইঙ্গিত বহন করে! হয়তো এই চাঁপাগাছটিই প্রতীকি ‘নকশালবাদ’! ঘটনাচক্রে একদিন বাধা আসে আধ্যাত্মিক উপায়ে করা তার আয় রোজগারে। কোন এক যুক্তিবাদী সংগঠন দলবল নিয়ে এসে শাসিয়ে যায় এই বলে যে, লোক ঠকানো ব্যবসার জন্য তাকে জেলে পাঠানো হবে। তাতেই নিরুপায় হারবার্টের বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছাটা মরে যায়। সুতরাং মৃত্যুতে ইতি টানতে চায় তার ট্র্যাজিক জীবনের।
লেলিন, স্টালিন, মাও হো; লাল সালাম, লাল সালাম। বস্তুত, এ সিনেমা বিপ্লবীদের আক্ষরিকভাবেই লাল সালাম জানায়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে হারবার্ট কোনো বামপন্থী বিপ্লবী নন। তার জ্যাঠাতো ভাই কৃষ্ণ নকশাল আন্দোলনের সমর্থক। তার কাছ থেকে লেনিনের বই নিয়ে চিলছাদে শুয়ে শুয়ে পাতা ওল্টায় হারবার্ট। এসব পড়ে মাওবাদ, লেলিনবাদ নিয়ে আধো আধো অপরিপক্ক ধারণা গড়ে ওঠে। কালের পরিক্রমায় অজান্তেই হয়ে ওঠে বিনুর সহযোদ্ধা। যদিও সে অতশত বুঝে সমর্থন করে না। বিনুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা হারবার্টকে পরিণত করে একজন কমরেডে। অথচ কী নির্মমতা! বিনুর মৃত্যুদৃশ্যেই সে দেখে তার আদরের ভাইপোর পায়ে পুলিশের শিকল পরানো। ভয় এতই প্রকট যে, গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু বিপ্লবীকে হাসপাতালেও পুলিশ শেকলে বেঁধে রেখেছে। যেন বিপ্লবের নামে অরাজকতা ঘটাতে না পারে! পরে অবশ্য হারবার্টকে পোড়ানোর চুল্লিঘরে ঐ বিপ্লবের আভাস দেখা যায়— “পুলিশের কুত্তা, দেবী রায় হুঁশিয়ার।”
ময়ুখ ভৌমিকের করা মিউজিক পুরো ছবিতে প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। ছবিটি যে বিপ্লবী চেতনাকে ধারণ করে তা আরও হৃদয়গ্রাহী হয়েছে সুরের মূর্ছনায়। আবহসঙ্গীত যেন মিশে গেছে জলের মাঝে মাছের মতো করে। অর্ঘ্যকমল মিত্রের চিত্রসম্পাদনা সময়কালের ক্রমাগত যাতায়াতে পার্থক্য ধরতে সহায়তা করেছে। কলকাতার সিনেমার সুপরিচিত মুখ শুভাশিস মুখোপাধ্যায় চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে ক্যারেক্টারকে ধারণ করতে পারার পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। বলা বাহুল্য, নবারুণের হারবার্ট, সুমনের হারবার্টকে নতুন প্রাণ দিয়েছেন শুভাশিস। অনুরূপভাবে নির্মাতা সুমন দেখিয়েছেন তার নির্মাণ-দূরদর্শিতা। প্রারম্ভের টাইটেলে হারবার্টের ‘মৃতের সাথে কথোপকথন’ সাইনবোর্ডের যথাযথ ব্যবহার করায় তিনি বিশেষ সাধুবাদ পাবেন। পক্ষান্তরে, হারবার্টের সচেতন দর্শককে এত খোলাসা করে বিস্ফোরণে বিনুর সম্পৃক্ততার সিন দেখিয়ে দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেননি নির্মাতা। বরং এই বাহুল্যদৃশ্য দর্শক প্রজ্ঞাকে অবমূল্যায়ন করে দর্শকের ধীশক্তি ব্যবহারে বাধা প্রদান করেছে।
হারবার্ট সরকার কারো কাছে আবোলতাবোল প্রলাপ বকা ছা-পোষা। যে কিনা কবিতা লিখেছে— “কী গরম পড়েছে। উহ! আরশোলা কানে করে কুহ!” তবে সচেতন পর্যবেক্ষণে ‘হারবার্ট’ চেতনার ভিত নাড়িয়ে দেয়া নাম। হারবার্ট নিষ্পেষণের শিকার অবহেলিত এক তরুণ। তাই তো বিনুর বিপ্লবী ডিনামাইট বহুদিন সুপ্ত থেকে হারবার্টে ভর করে শ্মশানের চুল্লিঘরে প্রবল বিস্ফোরণে ফেটে আক্রোশ মিটিয়েছে। সুমন মুখোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্র ‘হারবার্ট’ মাও সে তুং-এর সাথে গলা মিলিয়ে বলতে চেয়েছে— “এমন কি স্বার্থ আছে যা আমরা ত্যাগ করতে পারি না, অথবা এমন কি ভুল আছে যা আমরা শুধরে নিতে পারব না!”
চলচ্চিত্র: হারবার্ট (Herbert)
সাল: ২০০৬
পরিচালক: সুমন মুখোপাধ্যায়
জনরা: ক্রাইম ড্রামা