মার্ভিন লেরয়ের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সিনেমার নাম করলে নির্দ্বিধায় ‘আই অ্যাম অ্যা ফিউজিটিভ ফ্রম অ্যা চেইন গ্যাং’-এর নাম উচ্চারিত হবে। এবং বলতে হয়, ‘প্রিজন ফিল্ম’ জনরার একদম প্রথম দিককার এক মাইলফলক এই সিনেমা। এই অর্জন নিয়ে অবশ্য খুব কম সময়ই বলা হয়। তা যাক। ওতে সিনেমার মাহাত্ম্য কিছু কমছে না।
লেরয় এর আগের বছর ‘লিটল সিজার’ দিয়ে গ্যাংস্টার জনরার উত্থান ঘটান। আর পরের বছরই এই সিনেমা দিয়ে ‘প্রিজন ফিল্ম’ জনরাকে সমৃদ্ধ করেন, যে লিগ্যাসি ধরে ‘ব্রুট ফোর্স’ (১৯৪৭), ‘কুল হ্যান্ড লিউক’ (১৯৬৭), ‘প্যাপিলন’ (১৯৭৩), ‘দ্য গ্রেট এস্কেইপ’ (১৯৬৩), ‘দ্য হোল’ (১৯৬০), ‘বার্ডম্যান অফ আলকাত্রাজ’ (১৯৬২), ‘দ্য গ্রীন মাইল’ (১৯৯৯), ‘মিডনাইট এক্সপ্রেস’ (১৯৭৮), ‘হাঙ্গার’ (২০০৮)-সহ আরো অসাধারণ সব প্রিজন সিনেমা এসেছে।
অবশ্য লেরয়ের এই সিনেমা মূলত চরিত্রনির্ভর ড্রামা। কিন্তু জেল ভেঙে পালানো, জেলের ভেতরের অবর্ণনীয় কঠিন অবস্থা, নির্দোষীর নির্দোষ প্রমাণের ব্যর্থতা ও সংগ্রাম- সবকিছুই এতে আছে, যা প্রিজন ফিল্ম জনরার উপাদান/অলংকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এসেছে। বলা যায়, জনরার অনেক রূপরেখাকেই বিস্ময়কর দক্ষতার সাথে ‘রূপরেখা’ হিসেবে প্রণয়ন করেছে এই সিনেমা।
এই গল্প জেমস অ্যালেনকে নিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে, যুদ্ধের ময়দান হতে ঘরে ফিরেছে। মেডেল জিতেছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ অনেকটা বদলে দিয়েছে পরিস্থিতি এবং তাকে। যুদ্ধের ময়দানেই সে ঠিক করে রেখেছে, ঘরে ফিরে ইঞ্জিনিয়ার হবে। অফিস ক্লার্কের সেই নিরানন্দ, ঢিমেতালের চাকরি তাকে দিয়ে আর হবে না। ঠিক এখানেই তার পরিবর্তন। যুদ্ধের ওই উত্তেজনা তার ভেতরে এমনভাবে সঞ্চারিত হয়েছে যে, ধীরতাকে সে বিসর্জন দিয়েছে। কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় অ্যালেন। নিজমুখে তাই বলে, “আমি আর আগের মানুষটা নেই। যুদ্ধ আমাকে পরিবর্তন করেছে।” মা আর ভাইয়ের আপত্তির স্নেহবাক্য ডিঙিয়ে অ্যালেন হেঁটে যায় সেই পথে। মানচিত্রের এপাশ হতে ওপাশে হাঁটে। উত্তর থেকে দক্ষিণে। কাছে কিংবা দূরে। কিন্তু বেকারত্ব আর ঘোচে না।
খাবারটাও ঠিকঠাক জোটে না। এই খাবারের জন্যই তো অপরিচিত ওই লোকের ফাঁদে পড়া। ভেবেছিল খাওয়াবে। কিন্তু ওই বেটা যে তাকেও লুটপাটে অংশ নিতে বাধ্য করবে, তা কে জানতো! অ্যালেন পয়সা কয়টা পকেটে পুরেছিল পাশের লোকটার অস্ত্র হাতে ধরা কুণ্ঠাহীন নির্দেশে। হতভম্ব অবস্থায়।
এর মধ্যে পুলিশ এলো। পাশের লোকের উপর গুলি চালালো। অ্যালেন ধরা পড়লো। নির্দোষ হবার কথা জানালো। কিন্তু পয়সা যে তার পকেটে। আর কী! জেল হলো, পায়ে বেড়ি পড়লো তারও। জেলের এক সঙ্গী যখন বলছিল, “কী কারণে জেলে?” অ্যালেনের উত্তর, “হ্যামবার্গারের জন্য।” ও-ই তো আসলে সত্যি। কী নির্মম সেই অংশটুকু! কিন্তু নির্দোষ অ্যালেন জেলে পড়ে থাকবে কেন? তাই সে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরে সেই প্রক্রিয়ার ফলাফল দিয়েই সিনেমা শেষ হয় না। আরো অনেককিছুই ঘটে। আরো অনেক ক্ষুধা ছড়িয়ে থাকা রুক্ষ পথে অ্যালেনের সাথে দর্শকের হাঁটা বাকি।
‘৩৪ সালের মাঝামাঝি থেকে প্রোডাকশন কোড বা ‘হেইস কোড’ আরোপিত হবার আগের সিনেমা হওয়ায় অনেককিছুই বাস্তবিকতা অটুট রেখে প্রদর্শন করতে পেরেছে এই সিনেমা। প্রোডাকশন সিস্টেমের মাঝেও লেরয়ের সিনেমাগুলো কঠোর বাস্তবতাকে অনেকাংশে ধারণ করতে পারতো। গ্রিটি রিয়ালিজম বা নোংরা বাস্তবতা তো লেরয়ের নিজস্ব স্টাইলের মধ্যেই পড়ে। ওটার একটা বড় নজির এই সিনেমা। আর ত্রিশের দশকের গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাব তো তার কাজে খুব প্রতীয়মান। সচেতনভাবেই সেটাকে ন্যারেটিভে আসতে দিতেন। ‘গোল্ড ডিগার্স অব ১৯৩৩’-এ সরাসরি উল্লেখ করেছেন আর ‘লিটল সিজার’ও এই সিনেমায় বলা ছাড়াই সুস্পষ্টরূপে রেখেছেন। এই যে জেমস অ্যালেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটছে কিন্তু কর্মহীন, ক্ষুধায় কাতর, আর অপরাধের বৃদ্ধি- এসব তো ডিপ্রেশন এরারই প্রভাব।
সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমা আজ প্রায় ৯০ বছর পর এসেও কিন্তু একইরকম মর্মান্তিক এবং প্রভাবশালী। চেইন গ্যাং; এই চেইন গ্যাং তো ছিল দাসত্বরেই আরেক অমানবিক রূপ। উনিশ শতকের গোড়ায় জেলখানার কয়েদীদের একসাথে বেড়ি দিয়ে বেঁধে কোনো ভারী কাজ করতে দেওয়া হতো শাস্তিস্বরূপ। এই সিনেমায় যেমনটা দেওয়া হয় পাহাড় ভেঙে রাস্তা বানানোর কাজ। লেরয় সহমর্মিতার সাথেই সেই সমস্ত কাজের মর্মান্তিকতা অনুভব হওয়ার মতো করেই ক্যামেরায় তুলেছেন। কাজ করতে করতে কেউ ঘেমে গেলে সেই ঘাম মোছার জন্যও অনুমতি নিতে হয় জেলের রক্ষক নামের ভক্ষকদের কাছ থেকে। এই সকল দৃশ্য খুবই শক্তিশালী এবং একই পরিমাণ অনুনাদী। সাথে একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে সিস্টেমের যাঁতাকলে পড়ে যায়, সিস্টেম কীভাবে তাকে শোষণ করে; তারই বক্তব্যপূর্ণ সিনেমা এটি।
এবং আমেরিকান সমাজে সেটার বাস্তব প্রভাব সিনেমা মুক্তির পর পরই দেখা যায়। জেলখানার অনেক আসামীই যে কোনো অপরাধ না করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়, সেটা নিয়ে দর্শকরা প্রশ্ন করা শুরু করে। এবং যেহেতু সত্য ঘটনা অবলম্বনে এটি তৈরি, তাই এই স্বর আরো জোরদার হয়। আমেরিকার আইনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মূল গল্পের লেখকেরই বাস্তব অভিজ্ঞতার নামান্তর এই সিনেমা। সিনেমা মুক্তির সময়ও তিনি জেলে বন্দী ছিলেন। এরপরই জানুয়ারি ১৯৩৩-এ লেখকসহ আরো কয়েকজন আপিল করার সুযোগ পান, এবং ছাড়াও পান।
এই সিনেমার আবেদন সরাসরি গোছের হওয়ায় বাস্তবতাটা দর্শকের কাছে আরো অভিঘাতী হয়ে ধরা দেয়। সেই সাথে লেরয়ের টেকনিক শৈল্পিক জায়গা থেকেও সিনেমাকে কালোত্তীর্ণ করে তুলেছে। জেমস অ্যালেন হাঁটছে, ওদিকে ডিসল্ভ ব্যবহার করে ম্যাপে স্থান পরিবর্তন দেখানো হচ্ছে, আবার হাঁটছে, ডিসল্ভ হয়ে আবার স্থান বদলাচ্ছে; সম্পাদনাও এক্ষেত্রে যতটা দুর্দান্ত, ততটাই দক্ষভাবে প্রকাশ পেয়েছে বক্তব্য। আবার ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে একদিকে সাইরেন, ওদিকে গাড়ির ছুটে চলা, পিছু নেওয়া গাড়ির এগিয়ে আসা; এই প্রত্যেকটি বেজোড় শটে নিখুঁত কম্পোজিশন তো আছেই, এবং সম্পাদনার টেবিলে কুইক কাট ব্যবহার করে গোটা সিকুয়েন্স যেভাবে সাজানো হয়েছে তার অভিঘাত, উত্তেজনা নিঃসন্দেহে চরম মাত্রাতেই অবস্থান করে।
আর আরো একটা গ্রেট ফ্যাক্টর তো কেন্দ্রীয় চরিত্র পল মুনি। সংযত অভিনয়ের এক ব্যাকরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এই চরিত্রের অভিনয়ে। প্যাশন আর চরিত্রের বেদনাকে একত্র করে অভিনয় করেছেন তিনি। কেনই বা তা হবে না? কোনো চরিত্রে কাজ করার আগে সময় নিয়ে, প্রস্তুতি নিয়ে যে চরিত্রকেই ধারণ করতেন পল মুনি! আর তার মেকাপের শৈল্পিকতা তো জ্ঞানীকূলে চর্চিতই।
লেরয়ের শ্রেষ্ঠ কাজ ‘আই অ্যাম অ্যা ফিউজিটিভ ফ্রম অ্যা চেইন গ্যাং’ (১৯৩২) জেলের করুণ অবস্থা, জেলের রক্ষীদের নৃশংসতাকে পর্দায় রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সামাজিক দলিল স্বরূপ সিনেমা। এতে ক্ষোভ আছে, সাহস আছে। সবশেষে, করুণ সুরটা ভেতরে আঘাত করার মতো ক্ষমতাও আছে।