হলিউডের বক্স অফিস বর্তমানে শাসন করছে সিক্যুয়েল, প্রিকুয়েল আর রিবুট। অস্কারের মৌসুমে গিয়েও প্রথাগত ফর্মুলাতে বায়োপিক আর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোরই প্রাধান্য বেশি। এর ভিড়ে লাইমলাইট পাচ্ছে না মৌলিক গল্পগুলো। এরকম এক সময়েই দক্ষিণ কোরিয়া উপহার দিয়ে দিলো ‘প্যারাসাইট (২০১৯)’, যার অভিনব কাহিনীকে হাজার চেষ্টা করলেও নির্দিষ্ট কোনো জনরায় ফেলা যাবে না।
স্ত্রী এবং দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কিম কি তায়েকের টানাপোড়েনের সংসার। কর্মক্ষম হলেও দুর্ভাগ্যবশত চারজনেই তারা বেকার। আক্ষরিক অর্থেই এক অন্ধকূপে আটকে গেছে তাদের জীবন। রাস্তার মাঝামাঝি উচ্চতার স্যাঁতসেঁতে অ্যাপার্টমেন্টে বসে যখন তারা কঠিন এই জীবনের হিসাব-নিকেশ মেলানোর চেষ্টা করছে, তখন তাদের জন্য দেবদূত হয়ে দেখা দেয় কিমের ছেলে জি-উর বন্ধু। সে তাকে মহাধনী এক পরিবারে প্রাইভেট টিউটরের চাকরি জুটিয়ে দেয়।
তাদের প্রাসাদোপম বাড়িতে গিয়ে চোয়াল ঝুলে পড়ার উপক্রম হলেও নিজেকে সামলে নেয় জি-উ। সেই বাড়ির কর্ত্রী, সহজ সরল মিসেস পার্ককে হাত করে নিজের বোনের একটা চাকরিও বাগিয়ে নেয় সে। জি-উ এবং কি-জিওং, দুই ভাইবোনেরই চিকন বুদ্ধির কোনো অভাব নেই। চক্রান্ত করে বাড়ির ড্রাইভার আর হাউজকিপারের চাকরি ছুটিয়ে দিতে তাদের বিবেকে বাঁধে না একটুও। আস্তে আস্তে নিজের অজান্তেই মিস্টার পার্ক হয়ে ওঠেন পুরো কিম পরিবারের আয়ের মূল উৎস।
আইটি ফার্মের মালিক মিস্টার পার্কের আপাত নিখুঁত জীবনেও বিপত্তি আসে মাঝে মাঝে। তার আদরের খামখেয়ালী ছোট্ট ছেলেটা নাম না জানা কোনো ভয়ে ট্রমাটাইজড। মিসেস পার্কের মধ্যে সার্বক্ষণিক একটা অসুখী ভাব দেখা যায় প্রায়ই। আলিশান জীবনযাপন করেও আত্মবিশ্বাসের ছিটেফোঁটা নেই পার্কের মেয়ে দা-হিয়ের মধ্যে। তাদের কার্যকলাপও হাস্যকর। অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে এক ফ্যান্টাসির জগতে বসবাস তাদের। নিজেদের মিশনে সফল হলেও হঠাৎ করে কিম পরিবারে নেমে আসে দুর্যোগ। ফেলে আসা অতীত হঠাৎ করে একই রেখায় নিয়ে আসে কিম, পার্ক আর মুন-গোয়াং এর পরিবারকে।
শুধু কাহিনীর অভিনবত্ব না, উপস্থাপনাও কৃতিত্বের দাবিদার। এক পরিবার বসে বসে যে বৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করছে, ভাগ্যের পরিহাসে সেই বৃষ্টির তোড়েই আরেক পরিবারের স্বপ্ন ভেসে ভেসে যাচ্ছে। আরেকটি দৃশ্যে মিস্টার পার্ক সন্দেহ করেন যে, তার ড্রাইভার দরিদ্র কাউকে গাড়িতে তুলে তার সাথে রাত কাটিয়েছে। পরবর্তীতে মিস্টার এবং মিসেস পার্ক সোফার ওপরে রোল-প্লে করার সময়ে সেই ঘটনার আদলে দরিদ্র হবার ভান করেন। তাদের রঙিন দুনিয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করা দরিদ্ররা হলো হাসি-ঠাট্টার পাত্র। তবে চোখে আঙুল দিয়ে উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের মাঝে ফারাক দেখানো এই মুভির একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে হয় না। মুভির টুইস্টের থেকেও বড় ধাক্কা লাগবে তখন, যখন মনে হবে যে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ফলে এভাবে বিবেকহীন দানবের জন্ম হলেও হতে পারে।
২০১৯ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের পরে কানের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম ডি ‘অর জিতে নেয় ‘প্যারাসাইট’। মাত্র ১১ মিলিয়ন বাজেটের বিপরীতে এখন পর্যন্ত এর আয় ৮৮ মিলিয়ন ডলার। আইএমডিবিতে দর্শকদের ভোটে এর রেটিং ৮.৬/১০, রোটেন টমাটোজে রেটিং ১০০% ফ্রেশ। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা যেভাবে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন, তাতে আসন্ন অস্কারে সেরা বিদেশী চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনয়নও প্রায় নিশ্চিত।
প্যারাসাইট মুভির এ সাফল্যে অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই। মুভির পরিচালনায় ছিলেন কোরিয়ান কিংবদন্তী বং জুন হু। কোরিয়ার সর্বসেরা থ্রিলারের সামনের সারিতেই থাকা ‘মেমোরিস অফ মার্ডার (২০০৩)’ মুভিটি তারই সৃষ্টি। ২০০৯ সালে ‘মাদার’ মুভি নির্মাণের পরে তিনি হলিউডে গিয়ে ‘স্নোপিয়ার্সার (২০১৩)’ এবং ‘ওকজা (২০১৭)’ এর মতো দুটি ভিন্নধর্মী সায়েন্স ফিকশন নির্মাণ করেন। এই দুই মুভি কিংবা ‘দ্য হোস্ট (২০০৬)’ এর মাধ্যমে তিনি শ্রেণীবৈষম্য আর কর্পোরেটতন্ত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন রূপকের সাহায্যে। অবশেষে দশ বছর পরে নিজের শিকড়ে ফিরে এলেন সেই শ্রেণীবৈষম্য নিয়েই। এবার অবশ্য তার গল্প বলার ধরন অন্যরকম, জিন ওন-হানের সাথে এমনভাবে কাহিনী সাজিয়েছেন যে শেষে এসে তা ঈশপের গল্প বলে মনে হতে পারে।
তবে পরিচালকের পাশাপাশি বড় কৃতিত্ব দিতে হবে মুভির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। বং জুন হুর সাথে নিয়মিতই কাজ করা ক্যাং হো সং ছিলেন কিমের ভূমিকায়। ভেটেরান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে নতুনরাও পরিবারের সদস্যদের মাঝে হৃদ্যতা আশ্চর্য কুশলে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিছুটা যেন কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মতোই অবস্থা, মানবেতর পরিস্থিতিতে হাস্যরসাত্মক দৃশ্যগুলো চরিত্রগুলোর পাশাপাশি দর্শকের ওপরও চাপ কমিয়ে দিয়েছে। বং জুন হু বলেছেন,
টানা দুই ঘণ্টা ধরে ট্র্যাজেডি কিংবা কমেডি দেখানোটাই আমার কাছে উদ্ভট ঠেকে। আর মানুষের জীবনও আদতে এই দুইয়ের মিশেলে গড়ে ওঠে। এমনকি অতিভয়ানক পরিস্থিতিতেও হাসি আসার মতো অনেক ঘটনা ঘটে। আমি সেটাই আমার কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করেছি।
সিনেমার মূল উদ্দেশ্য হলো বিনোদন, আর সেই বিনোদনের বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই ‘প্যারাসাইট’ মুভিতে। পিচের অ্যালার্জিকে কাজে লাগানো, দুর্যোগের সময়ে কমোডে বসে সিগারেট ধরানো কিংবা পোকা মারার ওষুধ দিতে আসার সময়ে জানালা খুলে দেয়ার মতো দৃশ্যগুলো ডার্ক কমেডির অনবদ্য উৎস। কথার পিঠে কথা সাজিয়ে সংলাপের পথ ধরে কাহিনীকার পৌঁছে গেছেন চরিত্রগুলোর গভীরে। আর চরিত্রপ্রধান এই ড্রামাকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে সিনেমাটোগ্রাফার হং কিয়াং-পিয়ো সুকৌশলী ট্র্যাকিং শট। তিনি এমনভাবে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল করেছেন, যাতে পর্দার দিকে তাকিয়েই চরিত্রগুলোর সামাজিক অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যায় দর্শকদের কাছে। এছাড়াও মুভির আবহ সঙ্গীত ছিল অনন্য। পার্কদের বাড়িকে একটা গা ছমছমে ভাব এনে দিচ্ছিল ক্লাসিক্যাল পিয়ানো। আবার বিশেষ কিছু সাসপেন্সের মুহূর্তে আবহ সঙ্গীতকে থমকে দিয়ে দর্শকের স্নায়ুকে নিয়ে ভালোই খেলেছেন জেইল জুং।
সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ কোরিয়ায় শ্রেণীবৈষম্য বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে, তাই তা প্রায়ই উঠে আসছে তাদের মিডিয়ায়। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা কিম পরিবারের চাপা ক্ষোভ আর অসন্তোষকে কিন্তু পরিচালক কখনোই ওভার-ড্রামাটিক করে তুলে ধরেননি। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের সহজেই মানিয়ে নেয়ার কিংবা আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে প্রথম প্রথম একটু অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে।
মুভির প্রথমার্ধ সাধারণ ফ্যামিলি ড্রামা এবং ব্ল্যাক কমেডিকে পুঁজি করে এগোলেও কিছু পরেই শুরু হয়ে যায় কমেডি অফ এররের নতুন খেলা। শেষে গিয়ে মুভির অতর্কিত ট্রানজিশন কারো কারো মানসিক পীড়ার কারণ হতে পারে। ‘দ্য ডার্ক নাইট (২০০৮)’ মুভিতে জোকারের একটা বিখ্যাত উক্তি হলো, “madness is like gravity, all it needs is a little push”। ‘প্যারাসাইট’ এর শেষ অঙ্ককে ঠিক এই একটা লাইন দিয়েই প্রকাশ করে ফেলা যায়।
কোনো নৈতিক মূল্যবোধ না থাকলেও চরিত্রগুলোর প্রতি একটি অদ্ভুত টান অনুভব করবেন দর্শক। অমীমাংসিত সমাপ্তিকে আশাবাদী দর্শকেরা হয়তো সুখী পরিণতি হিসেবেই ধরে নেবেন। খটকা লাগার মতো কিছু বিষয় থাকলেও এই ট্র্যাজিকমেডি যে কালজয়ী কোরিয়ান চলচ্চিত্রগুলোর তালিকায় জায়গা করে নিতেই পারে। এই গল্পের পৃথিবীও কিন্তু অচেনা কিছু নয়। একটু মোটা দাগে দেখানো হয়েছে বটে, তবে মুভিতে চরিত্রগুলোর যে মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে, বাস্তবে এরকম কিছু ঘটা অসম্ভব কিছু না।