Whodunnit! এই শব্দটি মূলত ব্যবহার করা হয় ডিটেকটিভ স্টোরি বা ক্রাইম থ্রিলারের ক্ষেত্রে। শব্দটি খুব পুরনো নয়, ত্রিশের দশকে এর ব্যবহার শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়টায় ডিটেকটিভ ফিকশনের ধরন এক কথায় বুঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করাতে। শব্দটি পড়ে যা মনে হচ্ছে, অর্থটাও তেমনই—একটা ক্রাইম বা মার্ডার আসলে কে করেছে, সেটা নিয়ে লেখা কোনো ফিকশন বা সিনেমাকে এই নামে ডাকা হয়।
আমাদের আলচ্য বিষয় ‘নাইভস আউট’ সিনেমাটিও একটি আধুনিক হুডানিট। একেবারে শেষ পর্যন্ত যাওয়া ছাড়া আমাদের সত্যিকার অর্থে জানার কোনো উপায়ই নেই যে অপরাধী কে। দর্শক হিসেবে আমরা হয়তো একের পর এক অনুমান করে যেতে পারি, অনুমান করার জন্যে একের পর এক সূত্রও দিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু রহস্যের পর্দা উন্মোচন হওয়ার জন্যে সিনেটামার শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা নিয়ে বসে থাকতে হয়।
নাইভস আউটের শুরুটা হয় একটি সুইসাইড দিয়ে। নভেম্বরের ৮ তারিখে হারলান থ্রম্বি মারা যান। সিনেমার কাহিনী যত সামনের দিকে এগোতে থাকে, ততোই আমাদের মনে প্রশ্ন বাড়তে থাকে—আচ্ছা, এটি সুইসাইড না হয়ে খুনও হতে পারে। খুন হওয়ার সম্ভাবনাই মনে হয় বেশি। যদি সুইসাইড না হয়ে খুনই হয়ে থাকে, তবে সেটা করেছেটা কে!
হারলান থ্রম্বি একজন রহস্য ঔপন্যাসিক। প্রতি বছর তার ছোট ছেলে ওয়াল্টকে তিনি দুটো করে বই দেন প্রকাশ করার জন্যে। তাদের একটি প্রকাশনা সংস্থা আছে, যার সিইও হচ্ছেন ওয়াল্ট। তার বাবার এই বইগুলো প্রকাশ করার মাধ্যমে এই প্রকাশনা সংস্থার বেশ নামডাক ছড়িয়েছে। হারলান থ্রম্বির লেখা রহস্য উপন্যাসগুলো ৮০ মিলিয়ন কপির বেশি বিক্রি হয়েছে, অনূদিত হয়েছে ৩০টি ভাষায়।
ওয়াল্ট সবসময় চাইতেন, এই বইগুলোর ফিল্ম এবং টিভি রাইট বিক্রি করতে। নেটফ্লিক্স থেকে এই বইগুলোর অ্যাডাপ্টেশনের রাইট কেনার প্রস্তাব দেয়ার পর, ওয়াল্ট তার বাবার জন্মদিনের পার্টিতে তাকে এই ব্যাপারটা জানান। তিনি তার বাবা হারলানকে জোরাজুরি করতে থাকেন, যাতে তার বাবা নেটফ্লিক্সের দেয়া প্রস্তাবটা অন্তত একবার বিবেচনা করে দেখেন। নেটফ্লিক্স বেশ ভালো অংকের টাকাই দিবে, টাকার পরিমাণটা একবার নিজ চোখে দেখে এরপরে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে হারলানকে তিনি অনুরোধ করেন। হারলান আসলে তার বইয়ের ফিল্ম অ্যাডাপ্টেশনের স্বত্ব বিক্রি করতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। তিনি সেই আলোচনার সময়েই ওয়াল্টকে জানিয়ে দেন যে, যে বইগুলোর স্বত্ব নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই বইগুলোর স্বত্ব হারলানের নিজের। পুরো পরিবারের নয়, ওয়াল্টের তো নয়ই। কাজেই বইয়ের অ্যাডাপ্টেশনের ব্যাপারে হারলানের কথাই চূড়ান্ত এবং সেদিন থেকে হারলানের প্রকাশনা সংস্থার দায়িত্বও আর ওয়াল্টের থাকছে না। এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে ওয়াল্ট চুপসে যান, এবং পার্টির বাকি সময়টা একরকম চুপচাপ কাটিয়ে দেন।
হারলানের বড় মেয়ের নাম লিন্ডা। লিন্ডার হাজব্যান্ড রিচার্ড, আর তাদের ছেলে র্যানসাম। র্যানসাম বয়সে তরুণ, কিন্তু সে কোনো চাকরিবাকরি করে না। জন্মদিনের পার্টির রাতে হারলান থ্রম্বির সঙ্গে র্যানসামের বেশ বড়সড় একটা ঝগড়া হয়। আলাদা একটা রুমে দরজা বন্ধ অবস্থায় সেই ঝগড়া হওয়ায় বাড়ির বাকি লোকজন ঝগড়ার বিষয়বস্তু নিয়ে তেমন কিছুই জানতে পারেনি। ওয়াল্টের ছেলে জ্যাকব পাশের বাথরুমে ছিল দেখে, তাদের ঝগড়ার এক-দুটো লাইন কেবল শুনতে পায়। পার্টি থেকে র্যানসাম বেশ আগেই চলে যায় হারলানের সঙ্গে ঝগড়া করে।
এছাড়া জন্মদিনের পার্টির দিন বেশ খানিকটা আগেই এসে পৌঁছেছিল রিচার্ড। পার্টির আগে রিচার্ডের সঙ্গেও হারলানের একটা ছোটখাটো ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়া হওয়ার কারণ, অন্য এক নারীর সঙ্গে রিচার্ডের অ্যাফেয়ার চলছিল, আর সে অ্যাফেয়ারের প্রমাণ পেয়েছিলেন হারলান। হারলান রিচার্ডকে তার অ্যাফেয়ারের প্রমাণ হিসেবে বেশ কিছু ছবি দেখিয়ে তাকে বলেন লিন্ডাকে বিষয়টা জানাতে। রিচার্ড যদি নিজে থেকে লিন্ডা—তার ওয়াইফকে এই অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে না জানান, তাহলে হারলান নিজেই লিন্ডাকে জানাবেন বলে রিচার্ডকে হুমকি দেন। একটা চিঠির খাম দেখিয়ে তিনি রিচার্ডকে বলেন, লিন্ডাকে এই চিঠি দিয়ে তিনি সবকিছু জানাবেন, যদি না রিচার্ড লিন্ডাকে আগেই জানান। দুজনের মধ্যে এই যে ঝগড়া চলছিল, সেটা পার্টির কেটারারদের একজন শুনেছিল।
জন্মদিনের পার্টিতে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে অন্য একজনও আগে আগেই চলে আসেন। হারলানের ছেলে নিলের ওয়াইফ জনি থ্রম্বি। নিল প্রায় ১৫ বছর আগেই মারা গেছেন। জনি একটা স্কিনকেয়ার ও লাইফ-স্টাইল ব্র্যান্ডের মালিক—‘লাইফ-স্টাইল গুরু’ও ডাকা হয় তাকে। তার মেয়ে মেগ একটা লিবারেল আর্টস কলেজে পড়ে, যে কলেজের টিউশন ফিস পরিশোধ করেন দাদা হারলান। পাশাপাশি ছেলের বউ জনিকেও তিনি একটা বাৎসরিক খরচ দেন। হারলান কিছুদিন আগেই টের পান যে, জনি তার মেয়ের টিউশন ফিসের নামে হারলানের কাছ থেকে টাকা লোপাট করছে। এটা টের পেয়ে তিনি মেগের টিউশন ফিস পরিশোধ করা বন্ধ করে দেন। জনি এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্যে মূলত আগে আগেই হারলানের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। হারলান জনিকে জানান, তিনি এই শেষবারের মতো মেগের টিউশন ফি এর জন্যে একটা চেক লিখে দিচ্ছেন। এরপর তিনি তাদেরকে আর কোনো টাকাপয়সা দিতে পারবেন না। এটা কষ্ট পাওয়ার মতো ব্যাপার বটে, কিন্তু তিনি মনে করেন এটা শেষ পর্যন্ত তাদের জন্যে ভালোই হবে। দর্শক হয়তো এই পর্যায়ে অনুমান করবেন যে, জনি তার মেয়ের টিউশন ফিের নামে যে দ্বিগুণ টাকা হারলানের কাছ থেকে নিচ্ছিলেন, সে টাকা হয়তো তিনি ব্যয় করছিলেন তার সেই লাইফ-স্টাইল ব্র্যান্ড ‘ফ্ল্যামের’ পেছনে, কিংবা তিনি যে একজন লাইফ-স্টাইল গুরু তথা ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার, তার সেই অ্যাপিয়ারেন্স বজায় রাখতে।
হারলানের ৮৫তম জন্মদিনের পার্টিতে আরো ছিলেন ওয়াল্টের ওয়াইফ ডনা, জনির মেয়ে মেগ, হারলানের নার্স মার্টা কাবরেরা, বাড়ির কেয়ারটেকার ফ্র্যান এবং হারলানের মা, গ্রেট ন্যানা—ওয়ানেটা থ্রম্বি। জন্মদিনের পার্টি শেষে রাত সাড়ে ১১টার দিকে মার্টা ওষুধ দেয়ার জন্যে হারলানকে নিয়ে বাড়ির তিনতলায় তার অফিসে চলে যায়। জনি তখন নিজ রুমে মেডিটেশনে বসেছিলেন। জনির মেয়ে মেগ আরো আগেই পার্টি থেকে চলে গিয়েছিল তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিতে। ওপরের তলায় বেশ জোরে একটা শব্দ শুনে জনি হারলানকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে তার অবস্থা জানার জন্য হারলানের অফিসে যান। দরজায় নক করার পর হারলান দরজা খুলে জনিকে বলেন, তিনি মার্টার সঙ্গে ‘গো’ নামের বোর্ড গেমটা খেলছিলেন। বোর্ড এবং গুটিগুলো ফ্লোরে উলটে পড়ে যাওয়াতেই শব্দটা হয়েছে। জনি এটা শুনে নিশ্চিন্তে নিজের রুমে ফিরে আসেন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে জনি ওপরে যাবার সময়, সিঁড়িটা নড়বড়ে হওয়ার কারণে শব্দ হয়েছিল। সেই শব্দে নিচতলায় ঘুমিয়ে থাকা লিন্ডার ঘুম ভেঙ্গে যায়। লিন্ডা ঘুমচ্ছিলেন রিচার্ডের সঙ্গে। লিন্ডার ঘুম বেশ হালকা, সেজন্যে সিঁড়ির শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তবে সে রাতে লিন্ডার ঘুম যে সিঁড়ির শব্দে কেবল একবার ভেঙ্গে গিয়েছিল, তা নয়। দুবার করে ভেঙ্গেছিল। একবার মধ্যরাতে মার্টা কাজ শেষে তাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময়, আর দ্বিতীয়বার হারলান তার রুম থেকে কিছু একটা নাস্তা করার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসায়। এ সময় ওয়াল্ট এবং তার ছেলে জ্যাকব বাড়ির সামনে ছিলেন; ওয়াল্ট একটা চুরুট ফুঁকছিলেন, জ্যাকব ব্যস্ত ছিল তার ফোন নিয়ে। এরপর রাত সাড়ে বারোটার দিকে মেগ বাড়িতে ফিরে আসে, এবং ঘুমোতে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পর ওয়াল্ট এবং জ্যাকবও ঘুমোতে যায়।
পরদিন সকাল বেলা হাউজকিপার ফ্র্যান নাস্তা নিয়ে হারলান থ্রম্বির অফিসে গিয়ে দেখতে পায়, একটা সোফার ওপর হারলানেরর নিস্তেজ শরীর পড়ে আছে, সোফায় রক্ত, নিচের মাদুরে রক্ত, আর নিচে একটা রক্তমাখা ছুরি পড়ে আছে। ফ্র্যানের হাতের ট্রে প্রায় উলটে পড়ে যায় যায় অবস্থা হয়েছিল। যাই হোক, পুলিশে খবর দেয়া হয়, বাড়িতে পুলিশ আসে। স্থানীয় পুলিশের একজন ডিটেকটিভ, একজন স্টেট ট্রুপার। তারা পরিবারের সদস্যদেরকে হারলানের মৃত্যু সম্পর্কিত নানান বিষয়ে প্রশ্ন করেন। কিন্তু সিনেমার শুরুতে আমরা দেখি, হারলান থ্রম্বি মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে এ দুজন বাড়ির সবাইকেই আবারো একে একে প্রশ্ন করছেন। এই দফায় তাদের সঙ্গে আছেন এক নতুন চরিত্র—দুঁদে গোয়েন্দা বেনোয়া ব্লংক!
নাইভস আউট দেখতে শুরু করার পর, যখন বাড়ির সদস্যদের একে একে প্রশ্ন করা হচ্ছিল, প্রথমদিকে ব্লংক পেছনের দিকে একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ বাড়ির কোন সদস্যদের উত্তর শুনে পাশে রাখা পিয়ানোর কি-তে চাপ দিচ্ছিলেন, আর টুং করে সেটা বেজে উঠছিল। দর্শক হিসেবে আমরা তখনো জানি না যে, রুমের পেছন দিকে, একটা কোণায় বসা এই লোকটা কে, আর কেনই বা তিনি হাতে একটা কয়েন নিয়ে সেটাকে ঘুরাতে ঘুরাতে চুপচাপ সবার কথা শুনছেন, আর কোন কোন উত্তর শুনে পিয়ানোর একেকটা কি বাজাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য আমরা তার পরিচয় পাই। তিনি একজন বিখ্যাত গোয়েন্দা, নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে আর্টিকেল ছাপা হয়েছে, বেশ কিছু কঠিন কেইস তিনি সমাধান করেছেন। নিজের পরিচয় দেয়ার সময় তার ওয়ার্ড-চয়েজ বেশ ইন্টারেস্টিং—Respectful, quiet and passive observer of the truth!
নাইভস আউট সিনেমাটাটে দুটো চরিত্র প্রধান—হারলানের নার্স মার্টা এবং ডিটেকটিভ ব্লংক। হারলানের সুইসাইডের আগে তাকে সর্বশেষ দেখেছিল মার্টা। তার সঙ্গে সর্বশেষ কথাও হয়েছিল মার্টার। পুরো সিনেমা জুড়ে আমরা সবচেয়ে সংবেদনশীল যে চরিত্রটাকে দেখতে পাই, সেটা মার্টা। মিথ্যে বলা নিয়ে তার যে লিটারালি একধরনের সমস্যা আছে, সেটা আমরা একটা অদ্ভুত উপায়ে দেখতে পাই, বারবার। কাজেই মার্টাকে হারলানের মৃত্যু নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার মাধ্যমে যে তার মৃত্যু রহস্য খোলাসা করা যাবে, সেটা একরকম নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু সিনেমার কাহিনী যতই সামনে এগুতে থাকে, আমাদের সামনে রহস্য খোলাসা হওয়ার পরিবর্তে তত বেশি গাঢ় হতে থাকে। এর পেছনের কারণ ডিটেকটিভ ব্লংক। তাকে হায়ার কে করেছে, সেটা তিনি নিজেও জানেন না। একদিন আগে তার অ্যাপার্টমেন্টে একটি নাম-পরিচয় বিহীন খাম আসে। ভেতরে একগাদা টাকা আর হারলান থ্রম্বির মারা যাওয়ার পেপারকাটিং। মানে, কেউ একজন চাইছে, বিখ্যাত গোয়েন্দা বেনোয়া ব্লংক হারলান থ্রম্বির মৃত্যু রহস্যের কিনারা করুক। অন্য সবাই যদি ধরে নেয়ও যে এটা একটা সুইসাইড ছিল, আদতে সেটা সুইসাইড নাকি মার্ডার, সেটা ডিটেকটিভ ব্লাঙ্ক ইনভেস্টিগেট করলেই বেরিয়ে আসবে।
সেই ইনভেস্টিগেশন আমাদের সামনে চমকপ্রদ একটা মার্ডার-মিস্ট্রি দেখার সুযোগ করে দেয়। একের পর এক টুইস্ট এবং টার্ন আসতে থাকার কারণে নাইভস আউট দেখার সময় কখনো মনে হবে না যে কাহিনী ঝুলে গেছে। নাথান জনসনের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং স্টিভ ইয়েডলিনের সিনেমাটোগ্রাফির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। রায়ান জনসনের স্ক্রিনপ্লে আমাদের সামনে ঘটনাগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে, দর্শক হয়তো একটা পর্যায়ে ভাবতে পারেন, তিনি কাহিনীর পুরোটুকুই জেনে গেছেন, কিন্তু পরের মুহূর্তেই নতুন একটা টুইস্ট দর্শকের ধারণাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে। ফলে অনুমান করার খেলাটা দর্শকের মনে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলতেই থাকে। একটা আদর্শ হুডানিটে এটা তো হবেই, তাই না!