সাহিত্যের দুনিয়ায় রুশ সাহিত্যিকদের আলাদা কদর আছে। পুরো বিশ্বের সাহিত্য তো বটেই, রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি সমাজেও রুশ সাহিত্যের একটা প্রভাব দেখা যায়। ছোট-বড় প্রায় প্রত্যেক লেখক ও পাঠককেই রুশ সাহিত্যের সমাদর করতে দেখা যায়। কোনো একটি দেশের সাহিত্যিকদের এত প্রভাবের উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি নেই। দীর্ঘ রুশ সাহিত্য উনবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রাচুর্যের চূড়ায় পৌঁছায়। নতুন ভাষায়, নতুন শিল্পে, আধুনিকতা ও অলঙ্কারে রুশ সাহিত্য তখন নিয়ে আসে এক বিপ্লব। যে বিপ্লবের ঢেউ রাশিয়া ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় সমগ্র বিশ্বে। এখনও বিশ্ব আচ্ছন্ন হয়ে আছে রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগের সৌরভে।
এই স্বর্ণযুগকে মহিমান্বিত করেছেন অনেক মহান লেখক। নিজ গুণে করেছেন সমৃদ্ধ। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে নিয়ে আজকের এই আলোচনা।
আলেকজান্ডার পুশকিন
আলেক্সজান্ডার সের্গেয়েভিচ পুশকিনকে রুশ সাহিত্যের শেক্সপিয়ার বলা হয়। রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগ শুরু হয় পুশকিনের হাত ধরে। আধুনিক রুশ কবিতার জনক বলা হলেও তিনি নাটক, ছোটগল্প এবং উপন্যাসের মাধ্যমে পুরো রুশ সাহিত্যকেই জাগিয়ে তোলেন।
পুশকিনের জন্ম ১৭৯৯ সালে এবং মৃত্যু ১৮৩৭ সালে। মস্কোর জার শাসিত এক অভিজাত পরিবারে পুশকিনের জন্ম। আভিজাত্যে জন্ম হলেও তিনি বিপ্লবী এবং সংগ্রামী এক জীবন কাটিয়েছেন। রুশ সাহিত্যের জনক, অথচ জীবনের প্রথম দশ বছর মূলত ফরাসি ভাষাতেই কথা বলেছেন তিনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কবিতা লিখে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। তার কবিতাগুলো মূলত রোম্যান্টিক। ‘ম্যাসেজ অফ ইউরোপ’, ‘রুসলাম অ্যান্ড লুদমান’, ‘দ্য ব্রোঞ্জ হর্সম্যান’, ‘বোরিস গোদুনোভ’ তার কয়েকটি বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম। সমগ্র জীবন ব্যয় করে লেখা কাব্য উপন্যাস ‘ইয়েভেজেনি ওনেজিন’ তার সবচেয়ে প্রিয় সাহিত্যকর্ম। যদিও এটা এতটাই দুর্বোধ্য যে মাত্র ১০০ পৃষ্ঠার বই ইংরেজিতে অনুবাদ করতে দুটি ভল্যুমের প্রয়োজন পড়েছিল।
পুশকিন কান্ট এবং ভলতেয়ার উদারনৈতিক দর্শন ধারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সংস্কারবাদী, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লিখেছেন ক্রমাগত। বিপ্লবী কবিতা লিখে বার বার পড়েছেন সরকারের রোষানলে। নির্বাসনে থাকতে হয়েছে কয়েক বছর। তার কবিতা ও জীবনযাপন একে অন্যকে পূর্ণ করেছে। পুশকিনই প্রথম রাশিয়ান সাহিত্যিক যার লেখা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
পাগলাটে এক জীবন কাটিয়েছেন আলেক্সান্ডার পুশকিন। ছিলেন একগুয়ে ও রগচটা। অসংখ্যবার ডুয়েলে লড়েছেন। ব্ল্যাক নদীর পাড়ে এমনই এক ডুয়েলে লড়ে গুলি খান কবি। দু’দিন পর মাত্র ৩৮ বছর বয়সী মারা যান ঋণগ্রস্ত, খামখেয়ালী পুশকিন, ততদিনে পাল্টে দিয়েছেন রুশ সাহিত্যের মানচিত্র।
নিকোলাই গোগোল
পুশকিনের বন্ধু গোগোলের জন্ম পুশকিনের ১০ বছর পর (১৮০৯ সালে), আর মৃত্যু ১৫ বছর পর (১৮৫২ সালে)। অর্থাৎ পুশকিনের মতো গোগোলও সংক্ষিপ্ত এক জীবন কাটিয়েছেন, মাত্র ৪৩ বছর। গোগোলের জন্ম ইউক্রেনের এক সাহিত্যমনা পরিবারে, তখনকার রোমান সাম্রাজ্যে। সাহিত্যমনা পরিবারের উত্তরাধিকারী হিসেবে ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। অল্প বয়সেই হাত পাকান নাটক ও কাব্যে।
পুশকিনের বন্ধু পুশকিনের মতোই কাটিয়েছেন পাগলাটে এক জীবন। গোগোল তার প্রথম কবিতা বই প্রকাশ করেন নিজের খরচায়। যখন কেউই বইটার কোনো কপি কিনল না, তখন তিনি রাগের মাথায় সব কপি আগুনে পুড়িয়ে দেন। যদিও লেখালেখি থামাননি। ক্রমাগত লিখেছেন। ঘুরেছেন সমগ্র সোভিয়েত, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ইতালি। এমনকি ফিলিস্তিনেও গিয়েছেন। বন্ধুত্ব করেছেন সোভিয়েতের সব দার্শনিক, সাহিত্যিক, এমনকি কিছু আধ্যাত্মিক গুরুর সাথেও। চাকরি করেছেন বেশ কিছু, কোনোটিতেই মন বসাতে পারেননি যদিও।
নিকোলাই গোগোল তার প্রথম জীবনে ইউক্রেনের গ্রামের কথাগুলো দিয়ে কাব্য ও গল্প লিখতেন। ধীরে ধীরে তার লেখায় পরিবর্তন দেখা যায়। বিশেষ করে পুশকিনের সাথে তার বন্ধুত্ব তাকে সাহিত্যিক হিসেবে সমৃদ্ধ করেছিল, যেমনটি করেছিল পুশকিনকেও। তার লেখায় বাস্তবের সাথে প্রহসন বা স্যাটায়ারের মিশ্রণের ছাপ প্রকট, যা তাকে সবার চেয়ে আলাদা করেছিল। ধারণা করা হয়, লেখায় তিনি জারতন্ত্রকে ব্যঙ্গ করতেন। অনেক লেখার মধ্যে তার সবচেয়ে বিখ্যাত ছোটগল্প দ্য ওভারকোট, আর উপন্যাস Myortvye Dushi বা ডেড সোলস । মূলত এই উপন্যাস রচনার কারণেই গোগোলকে আধুনিক রুশ উপন্যাসের পথিকৃৎ বলা হয়।
১৮৩৭ সালে প্রিয় বন্ধু পুশকিনের মৃত্যুর পর গোগোল ভেঙে পড়েন। ধীরে ধীরে তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ক্রমাগত তিনি আধ্যাত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করতে থাকেন। তার মনে হতে লাগলো- শয়তান তাকে দিয়ে পাপাচারী লেখা লিখিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে তিনি তার শেষ রচনা ডেড সোলসের দ্বিতীয় খণ্ড পুড়িয়ে ফেলেন। এভাবেই জীবনের প্রথম ও শেষ রচনা পুড়িয়ে তিনি এক চক্র পূরণ করেন। শেষ লেখা পুড়িয়ে তিনি শয্যাশায়ী হন, বাদ দেন আহার গ্রহণ, নিজেকে ক্রমাগত কষ্ট দিয়ে ১০ দিন পর পৃথিবী ত্যাগ করেন আধুনিক রুশ সাহিত্যের অন্যতম সেরা মেধা নিকোলাই গোগোল।
ফিওদর দস্তয়োভস্কি
সাল ১৮৪৯; তখন জারের শাসন চলছে রাশিয়ায়। প্রগতিশীল একটা গোপন সংগঠন চালানোর অপরাধে ফায়ারিং স্কোয়াডে নেয়া হলো একদল মানুষকে। প্রস্তুত মঞ্চ। গুলি করে মারা হবে বিপ্লবীদের। একদম শেষ মুহুর্তে নতুন আদেশ আসলো, মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেয়া হয় বন্দীদের। নির্বাসনে পাঠানো হলো তাদের। দীর্ঘ ঠান্ডা পথ অতিক্রম করতে করতে একজন মানসিক বৈকল্য হারান। বাকিরা সাইবেরিয়ায় যান, কাটান ৪ বছরের কঠিন নির্বাসন জীবন। এরপর বাধ্যতামূলক সামরিক জীবন আরো পাঁচ বছর। এই দলের একজন ফিওদর দস্তয়োভস্কি; ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও দার্শনিক। বিশ্বসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নাম।
১৮২১ সালে মস্কোয় ফিওদর দস্তয়োভস্কির জন্ম। ২৪ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘পুওর ফোক’ প্রকাশিত হয়, যাকে বলা হয় রাশিয়ার প্রথম সামাজিক উপন্যাস। তার চারটি প্রধান উপন্যাস ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘দ্য ইডিয়ট’, ‘দ্য ডেমনস’, এবং ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’। উপন্যাসগুলোতে স্টিম অভ কনসাশনেস ব্যবহার করার কারণে বিখ্যাত তিনি, যা পরবর্তীতে জেমস জয়েস বিখ্যাত করে তুলেছেন। তার চরিত্রগুলো কঠিন, রূঢ়। নীতিনৈতিকতার এক বিশেষ অবস্থায় পড়ে চরিত্রগুলো ক্লান্ত ও বিভ্রান্ত। তার উপন্যাসগুলো, জেমস জয়েসের ভাষায়, ‘ভায়োলেন্স’-এ ভরপুর।
দস্তয়োভস্কি তার লেখা ও দর্শন দিয়ে বিপুল সংখ্যক লেখক ও দার্শনিকদের প্রভাবিত করে গেছেন। যেমন- জেমস জয়েস তার ‘ইউলিসিস’-এর ধারণা দস্তয়োভস্কির ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ থেকে পেয়েছেন। তার লেখায় ব্যাপক মাত্রায় প্রভাবিত হয়েছেন আলবের কাম্যু, ফ্রানৎস কাফকা, ফ্রেডরিক নিৎসে, স্যামুয়েল বাকিট, এমনকি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনও।
দস্তয়োভস্কি অল্প বয়সে মৃগী রোগে আক্রান্ত হন, এবং সারাজীবন এই রোগে ভুগে গেছেন। ছিলেন ভয়ানক জুয়াড়ি। জার্মানির এক ক্যাসিনোতে এখনও তার মূর্তি স্থাপন করা আছে। জুয়া খেলে হারিয়েছেন জমানো সব টাকা, এমনকি থাকা-খাওয়ার সব টাকাও, ফিরিয়ে এনেছেন অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জমানোর টাকা, দেনা শোধ করতে চুক্তিতে লিখেছেন উপন্যাস। তারপরও জুয়া খেলেই গেছেন। প্রথম স্ত্রীর সাথে মিলছিল না তার, স্ত্রীও যক্ষ্মায় ভুগে মারা যান। দ্রুত উপন্যাস লিখতে স্টেনোগ্রাফের সাহায্য নেন তিনি। ২৫ বছরের ছোট স্টেনোগ্রাফার আনার প্রেমে পড়েন নতুন করে। বিয়ে করেন। আনা তার জীবন অনেকটাই গুছিয়ে এনেছিলেন। ১৮৮১ সালে ৫৯ বছর বয়সে মৃত্যুর ২ মাস আগে ফিওদর দস্তয়োভস্কি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ শেষ করেন, যা তিনি উৎসর্গ করে যান প্রিয়তম স্ত্রী আনাকে।
লিও তলস্তয়
১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে নোবেল দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নোবেলের সবচেয়ে বড় বিতর্ক হচ্ছে সাহিত্যে লিও তলস্তয়কে নোবেল পুরস্কার দিতে না পারা। ১৯১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন মহামতি তলস্তয়। তখনও বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে বড় নাম লিও তলস্তয়কে নোবেল দিতে পারেনি নোবেল কমিটি। শুধু তখনই না, বরং এখনও বিশ্বসাহিত্যের মহীরুহ হয়ে আছেন তলস্তয়। তার লেখা ‘ওয়ার এন্ড পিস’ এবং ‘আন্না কারেনিনা’ বিশ্বসাহিত্যের যেকোনো শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকায় সবচেয়ে উপরের দুটি নাম।
‘ওয়ার এন্ড পিস’ লেখা হয়েছে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে, হাজারের উপর পৃষ্ঠা উপন্যাসটির। চরিত্রের সংখ্যাই ছয় শতাধিক। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের রাশিয়া আক্রমণ ও কয়েকটি অভিজাত পরিবারের ভাঙাগড়ার খেলা নিয়ে এর কাহিনী। ‘আন্না কারেনিনা’ ৩ বছর ধরে লেখা উপন্যাস। তৎকালীন বিস্তৃত রাশিয়ান সমাজ ও একটা নিরেট ঝামেলাপূর্ণ প্রেমের গল্প আন্না কারেনিনা, এটাও এক বিশাল উপন্যাস। রিসারেকশন, আত্মজীবনী এবং বেশ কয়েকটি কালজয়ী গল্প লিখে গেলেও লিও তলস্তয়ের পরিচয় এই দুটো উপন্যাসই।
১৮২৮ সালে এক সম্ভ্রান্ত রুশ পরিবারে তলস্তয়ের জন্ম। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান। ছোটবেলা থেকে অসম্ভব মেধাবী ও পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। ম্যাক্সিম গোর্কির মতে, তলস্তয় নিজেই একটা পৃথিবী। নিজ আগ্রহে শেখেন লাতিন, ইংরেজি, আরবি, ইতালীয়, হিব্রুসহ আরো কয়েকটি ভাষা। প্রচুর বই পড়তেন তিনি, যখনই মনে হতো একটা বিদেশী বই মূল ভাষায় পড়া দরকার, তাহলেই ঐ মূল ভাষা শিখেই বই পড়ার চেষ্ঠা করতেন।
কম বয়সে তিনি বুঝতে পারছিলেন না সাহিত্যের জগতে আসবেন কিনা। কাছের বন্ধু আরেক বিখ্যাত লেখক তুর্গেনেভের অনুপ্রেরণায় লিখতে বসেন। তার প্রথম বই ‘চাইল্ডহুড’, কয়েক বছরের মধ্যে অটোবায়োগ্রাফির অপর দুই খন্ডও লিখে ফেলেন। সাধারণত মানুষ জীবনের শেষের দিকে আত্মজীবনী লিখে থাকেন, অথচ তলস্তয় তার লেখালেখি শুরুই করেন আত্মজীবনী দিয়ে। তার জীবন ছিল এতটাই ঘটনাবহুল। অল্প বয়সে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর দাদির মৃত্যু, পরে এক ফুফুর আশ্রয়ে বড় হতে থাকলে ফুফুও মৃত্যুবরণ করেন। এত সব দুঃখ সামলে নিজের পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি তিনি। আকৃষ্ট হয়ে যান মন্টেস্কো আর রুশোর দর্শনে। বাড়িতে এসে জমিদারী করতে গিয়ে আবার ব্যর্থ হন। ইউরোপ সফরে বের হন। সৈনিক হিসেবে যান ক্রিমিয়ার যুদ্ধ লড়তে।
এত অভিজ্ঞতা তলস্তয়কে একজন ভালো লেখক হিসেবে সমৃদ্ধই করে গেছে শুধু। প্রচুর লিখেছেন তিনি। শুধু উপন্যাসই না, তার লেখা গল্পও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ছিলেন দার্শনিকও। তার দেখানো অহিংস দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। শেষ দিকে তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে মনোযোগ দেন। নিজের মতো ধর্মচর্চায় মনোযোগ দেন। নিজের প্রায় সব সম্পদ বিলিয়ে যেতে লাগলেন। কপর্দকশূন্য অবস্থায় ৮২ বছর বয়সে বের হয়ে যান ঘর থেকে, আক্রান্ত হন নিউমোনিয়ায়। রাশিয়ার ছোট এক স্টেশনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর একজন মহামতি লিও তলস্তয়।
আন্তন চেখভ
কালজয়ী রুশ সাহিত্যিকদের ধারা বজায় রেখে আন্তন চেখভও ৪৪ বছরের এক সংক্ষিপ্ত জীবন কাটিয়েছেন। চেখভের জন্ম ১৮৬০ সালে, মৃত্যু ১৯০৪ সালে। বাবা ছিলেন সম্ভ্রান্ত কৃষক, মা ইউক্রেনীয়। কঠিন এক পারিবারিক আবহে বড় হন চেখভ। তার ভাষায়- তার মধ্যে আছে মায়ের হৃদয় আর বাবার প্রতিভা।
চেখভ ছিলেন একজন ডাক্তার। তবে এই পেশা থেকে সামান্যই অর্জন হতো তার। বিনামূল্যে ঘুরে ঘুরে মানুষদের সাহায্য করেছেন। বানিয়েছেন হাসপাতাল। ঘুরে বেড়িয়েছেন পুরো রাশিয়া, ইউক্রেন, এমনকি জাপানের বন্দীশিবির। কলেরা প্রাদুর্ভাবে উপদ্রুতদের দেন চিকিৎসা। এই সময় তিনি লিখেন কিছু চিঠি, যে চিঠিগুলো তার শ্রেষ্ঠ চিঠি বলে গণ্য।
চেখভ লেখালেখি শুরু করেন অর্থ উপার্জন করবেন বলে। হঠাৎ পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ায় তিনি বিকল্প অর্থের সন্ধানে পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন- লেখালেখিই তার ভবিষ্যৎ। সংক্ষিপ্ত জীবনে এবং তার মৃত্যুর পরও তার লেখা তাকে পৌঁছে দেয় সবচেয়ে উঁচু জায়গায়। চেখভকে বলা হয় বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার। তার লেখা নাটক আছে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার প্রদর্শিত নাটকগুলোর তালিকায়।
তার সেরা নাটকের মধ্যে আছে ‘থ্রি সিস্টার্স’, ‘দ্য সিগাল’, ‘দ্য চেরি অরচার্ড’। শুরুতেই এত মনোযোগ লাভ না করলেও ক্রমেই বাড়তে থাকে তার জনপ্রিয়তা। তার লেখা সেরা ছোটগল্পগুলোর মধ্যে আছে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ডগ’, ‘দ্য ক্যামিলিওন’, ‘দ্য ব্ল্যাক মঙ্ক’, ‘দ্য স্টেপ‘, ‘এ ড্রিয়েরি স্টেপ’ এবং আরো অনেক। তার গল্পগুলো ছিল প্রথাগত গল্পের চেয়ে বেশি রূঢ়। দস্তয়োভস্কির মতো চেখভও বিখ্যাত ছিলেন স্টিম অব কনশাসনেসের জন্য।
বিবাহভীতিতে ভোগা চেখভ মৃত্যুর ৩ বছর আগে বিয়ে করেন। তিনি ও তার স্ত্রী দুজন দুই শহরে বাস করতেন। তার মৃত্যুও হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। দীর্ঘদিন যক্ষ্মায় ভুগে তিনি তখন ভয়ানক রোগাগ্রস্ত ও শয্যশায়ী। হুট করে শোয়া থেকে উঠে জার্মান ভাষায় বললেন, “আমি মারা যাচ্ছি“, যদিও জার্মান ভাষা তিনি ভালো জানতেন না। মৃদু হেসে একটা শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিলেন। এক চুমুকে পুরো গ্লাস শেষ করে দিয়ে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। সময় তখন ১৯০৪। বিদায় নিলেন বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা গল্পকার ও নাট্যকার।