জামিম-উল-দীন-আল-সালাহ, এই নাম থেকে জুডাস নামটা কীভাবে এসেছে, তা স্ক্রিনপ্লেতে শেষের দিকে দেখানোর আগপর্যন্ত দর্শক থাকবেন সাসপেন্সে। কে এই জুডাস?
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিঞ্জ-এ সদ্য রিলিজ হওয়া ওয়েব সিরিজ ‘কিস অব জুডাস’-এর মনোরম এক নির্মাণ দর্শককে গল্পের ভেতরে ডুবিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে দারুণভাবে। গড়ে ২৫-২৬ মিনিটের একেকটি পর্ব নিয়ে, মোট আট পর্বে নির্মিত এই ওয়েব সিরিজটিতে মূল বিষয়, ২০২১ সালের এক সময়ে প্রযুক্তি নির্ভর সামাজিক অপরাধ।
‘কিস অব জুডাস’ মূলত ইংরেজি সাহিত্য নির্ভর একটি রূপক, যেটি দিয়ে সাধারণত বোঝানো হয় বিশ্বাসঘাতকতাকে। ওয়েব সিরিজ ‘কিস অব জুডাস’-এর নামটুকুও এখানে বিশ্বাসঘাতকতার সাথে মিলিয়েছে অনেক মেটাফোরকে, মিলিয়েছে মাদকের ব্যবহার, শিক্ষকের সাথে সম্পর্ক, মানুষের সাথে মানুষের বোঝাপড়া- এমন নানান দৃশ্যকল্পকে।
এই গল্প শুরু হয় এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক শুভকে দিয়ে, যার স্বচ্ছল পরিবার ভেঙে যায় এবং বাবা কারাবন্দী হয়। বাসা থেকে কোন টাকা না আসায় ঢাকা শহরের মতো ব্যয়বহুল শহরে তার বেঁচে থাকাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বাঁচা-মরার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এক চরম মুহূর্তে তার কাছে ফোন আসে এক অপরিচিত নম্বর থেকে। সেই এক ফোনকলই বদলে দেয় তার জীবনের গতিপথ।
নতুন এই গতিপথের প্রতিটি দৃশ্যেই দর্শক বুঝতে পারবেন হ্যাকিং, নতুন নতুন মাদক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার ইত্যাদি কীভাবে কাজ করছে প্রযুক্তিতে ব্রাত্য হয়ে ওঠা মানুষের জীবনে। কীভাবে দ্রুত মানুষের জীবনের মোড়গুলো ঘুরে যাচ্ছে; সস্তা হতে হতে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে মৃত্যুর মতো কঠিন বাস্তবতা- তার একটা লেখচিত্র যেন এই ওয়েব সিরিজ। এই সময়ে আমাদের প্রত্যেকেই প্রযুক্তির কাছে, মাদকের কাছে, আমাদের চারপাশের অনেকরকমের মানুষের কাছে কতটা অনিরাপদ- তার একটা চাক্ষুষ সাক্ষী যদি আর কিছুকাল পরে কেউ খুঁজতে চায়, তাহলে এই ওয়েব সিরিজটি হবে অন্যতম। সবশেষে এই জটিলতা থেকে শুভ মুক্তি পাবে কিনা, তা জানতে হলে আপনাকে দেখতে হবে সিরিজটি।
পরিচালক হাবিব শাকিল সিরিজের গল্পগুলোকে সাজাতে পেরেছেন সুন্দরভাবেই। প্রতিটি ফ্রেমই ছিল যথাযথ। বিশেষ করে, ওয়াইড ফ্রেমে যে টেকগুলো নেওয়া হচ্ছিল, সেগুলোতে সরাসরি ডিম-এ না গিয়ে একটা প্যান শট নেওয়ার ব্যাপারটি চোখে এসেছে প্রতিবারে। এই প্রবণতা সাধারণত দেখা যায় না। ক্লোজ শটে ক্যামেরা আর লাইটের সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্য এই কাজকে গল্পের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করেছে। সিনেমাটোগ্রাফি ছিল চমৎকার। লং শটগুলোতে যখন কথোপকথন চলছিল তখন স্লো ক্যামেরা মুভমেন্ট ছিল। এধরনের মুভমেন্ট দর্শককে মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ওয়েব সিরিজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য জরুরি একটি বিষয় হলো, সিরিজের এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে যাওয়ার আগে সাসপেন্স কিংবা ইন্টারেস্ট যা-ই বলা হোক, সে ব্যাপারটি উপস্থিত রাখতে পারা। হাবিব শাকিল এই জায়গায় বেশ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছেন, বোঝা যায়। প্রায় প্রতিটি পর্বেই ইন্ট্রোর আগে তিনি নতুন একটি গল্প তৈরি করতে পেরেছেন, আবার প্রত্যেক পর্ব শেষ হওয়ার আগেই তিনি নতুন এক সাসপেন্স তৈরি করতে পেরেছেন। কেবল পঞ্চম আর ষষ্ঠ পর্বের ক্ষেত্রে কিছুটা আগেই আঁচ করা গেছে পরের পর্বের পরিণতি।
সিরিজটিতে চোখ ধাঁধানোর মতো ছিল প্রতিটি সেট, কস্টিউম, প্রপস আর এসবের সাথে লাইটের সমন্বয়। কোথাও এতটুকু ডার্ক কিংবা লাইট কম-বেশি মনে হয়নি। তবে কিছু খুঁতের কথা না বললেই নয়। তেমনই একটি হলো, তৃতীয় পর্বে জুডাসের পঞ্চম কেসকে চতুর্থ কেস বলে ফেলা এবং পরের দৃশ্যে একই ভুল চালিয়ে যাওয়া। সাধারণত পত্রিকার সংবাদে বাংলা ও ইংরেজির সরাসরি মিশেল এবং যতিচিহ্ন ব্যবহারের বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা হয়; অথচ এই সিরিজের দৃশ্যে পত্রিকার সংবাদে দুটোরই ত্রুটি চোখে পড়েছে। সম্ভবত সম্পাদনার সময়ে তাড়াহুড়ার কারণে এমনটি হয়েছে। একটি দৃশ্যে জামিমকে গণিতের শিক্ষক এবং পরে আবার তাকে জৈবরসায়নের শিক্ষক হিসেবে উপস্থাপনের কারণে ব্যাপারটা খাপছাড়া হয়ে গেছে। রাস্তার কয়েকটি ওয়াইড শটের সময়ে পথচারি কিংবা জুনিয়র আর্টিস্টদের ক্যামেরার দিকে তাকানো চোখে পড়েছে। আর আইনজীবী চরিত্রের শিল্পী যখন ডায়লগ ডেলিভারি দিচ্ছিলেন, কেমন যেন মুখস্ত বুলি আওড়াচ্ছেন বলে মনে হয়েছে।
এই ওয়েব সিরিজকে শহরাঞ্চলের মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা নিজেদের সাথে অনেক বেশি মেলাতে পারবেন এর ভাষাশৈলীর কারণে। ঢাকার ‘ট্রেন্ডি’ প্রজন্মের কথা বলার স্টাইলটা বেশ গুছিয়েই সাজিয়েছেন চিত্রনাট্যকার। বিশেষ করে ইংরেজিতে কথা বলার প্রবণতা, ইংরেজি ভাষায় গালি দেওয়া, আবার ত্রিশোর্ধ বয়সীদের এই তরুণদের সাথে ভাষার ব্যবহারে একটি অলিখিত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা এখানে ফুটে উঠেছে। ডায়লগ ডেলিভারি ছিল খানিকটা দ্রুত। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাজগুলোয় যেমনটা হয়, যেভাবে ডায়লগ ডেলিভারির ক্ষেত্রে একধরনের ধারাবাহিকতা থাকে, সেটা ‘কিস অব জুডাস’-এ উপস্থিত। কেবল শুভর এক মেসের বন্ধু যখন তাকে প্রথম পর্বে ‘লুজার’ বলছিল, তখন তা বেখাপ্পা লেগেছে খানিকটা- সেটা ওই চরিত্রের রোলটা এমন শব্দ ব্যবহার করে না বলেই।
গোটা সিরিজে সাউন্ডের ক্ষেত্রে বেশিভাগ জায়গাতেই ন্যাচারাল সাউন্ড নিয়ে কাজ করা হয়েছে। দৃশ্যগুলোকে প্রাণবন্ত করতে এটি সহায়ক ছিল বেশ। ডাবিং হয়েছে যে ক’টা জায়গায় সেখানে ছোটখাটো কিছু অসঙ্গতি ছিল। ভার্সিটির রেজিস্ট্রারের কাছে যাওয়ার আগে শুভর দুই বান্ধবীর সাথে দেখা করার সময়ের যে ডাবিং, সেখানে দুই বান্ধবীকেই ঠোঁট নাড়াতে দেখা গেলেও সাউন্ড এসেছে একজনের। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকগুলো আগ্রহ জাগায়, সাসপেন্স তৈরি করতে সহায়ক। ‘কেজে ট্যাবলেট’ সেবনের পরের মুহুর্তের অনুভূতি বোঝাতে যে মিউজিকটা ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি নান্দনিক। আর মোশন গ্রাফিকস ও ইন্ট্রো সাউন্ডের কাজ দেখেই আপনি খুশি হবেন এই ভেবে যে, বাংলাদেশেও এখন এত ভালো ভালো কাজ হয়। স্ক্রিনপ্লে ছিল চমৎকার। গল্পের সাসপেন্স ধরে রাখতে যেসব সিন এর দৃশ্য আগে-পরে করা হয়েছে, সেসবও যথাযথ ছিল। যদিও ড্রোন শটে একই ধরনের লোকেশন বারবার দেখানো আর সংলাপ বিহীন অনেকগুলো সিন দীর্ঘক্ষণ প্লে করাটা খানিকটা বিরক্তির ভাব আনছিল।
‘কিস অব জুডাস’ এর সকল চরিত্রই তাদের নামের সার্থকতা বহন করেছেন। অনেকদিন ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা নির্মাতা ওয়াহিদ তারেক অভিনয় করেছেন ‘জুডাস’ চরিত্রে। তার অঙ্গভঙ্গি, চাহনি, গম্ভীর ডায়লগ ডেলিভারি সবকিছুই যেন এই সিরিজের জন্য ‘সিক্রেট ইনগ্রেডিয়েন্ট’। ভার্সিটির অগোছালো প্রফেসর হিসেবেও নিজেকে দারুণভাবে গড়ে নিতে পেরেছেন তিনি।
সিমি চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিলরুবা দোয়েল। তাকে গল্পের প্রয়োজনে একেকবার একেকরকম কস্টিউম আর মেকআপ নিতে হয়েছে। প্রত্যেক শটেই তিনি দারুণ ছিলেন। তার কণ্ঠের কোমলতা তাকে ‘শুভর শুভানুধ্যায়ী’ এমন অভিব্যক্তি দিতে সাহায্য করেছে। তার চরিত্রের জন্য এই উপমহাদেশের শিল্পীদের মধ্যে তার তুলনা চলে শিনা চৌহানের সাথে। দিলরুবা দোয়েলের মতো শিল্পী যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির জন্যই দুর্লভ বলা চলে।
শুভ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবু হুরায়রা তানভীর। সেরা বাছাই নিঃসন্দেহে। তার প্রতিটি অভিব্যক্তিই চরিত্রটির জন্য দর্শকের কাছে একটি সেন্টিমেন্ট তৈরি করেছে। গল্পে তার উত্থান, তার পতন কিংবা মাঝখানের সংকট, সবখানেই তিনি সাবলীল। বিশেষ করে, একটি চরিত্রকে হারিয়ে কান্নার সময়ে ইংরেজিতে গালাগাল দেওয়ার দৃশ্যে অভিব্যক্তি ধরে রাখাটা কঠিন ছিল, তিনি পেরেছেন।
তানহা চরিত্রে অভিনয় করেছেন জান্নাতুল নুর মুন। তার অভিনয় অসাধারণ। কেবল কয়েকটি জায়গায় দীর্ঘ সংলাপের সময় রেশটা ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু শেষ অংশে তিনি যেসব চ্যালেঞ্জিং রোল প্লে করেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
নাসিরউদ্দিন খান এর অভিনয়ও ছিল দারুণ। আর শুভর বন্ধু তানজীম এই ওয়েব সিরিজে নজর কেড়ে নিয়েছেন। এধরনের পার্শ্বচরিত্রগুলোয় ভালো ভালো শিল্পীর সন্ধান মিলছে এখন। তারা সামনে যে মূল চরিত্র হতে চলেছেন সহজেই অনুমেয়।
‘কিস অব জুডাস’ যে বিশ্বাসঘাতকতার গল্প বলে, তা আমার আপনার আশেপাশেই দেখা যায় রোজ। দেশে এলএসডির সন্ধান পাওয়ার সময়েই মুক্তি পেল কেজের গল্প। আপনি এই গল্পের গভীরে ঢুকতে ঢুকতে নিজেই ভাবতে থাকবেন, আপনিও এই গল্পের অংশ কিনা। একটি অসাধারণ, আন্তর্জাতিক মানের ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করেছেন হাবিব শাকিল। খুব বেশি প্রচারণা হয়তো হয়নি, তাই বহু দর্শকেরই চোখের অন্তরালে থেকে যাচ্ছে ‘কিস অব জুডাস’, সেটি নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক।