চলচ্চিত্রের কাজ কী? অনেকের কাছেই অনেক উত্তর জমা থাকতে পারে। কেউ বলতে পারেন চলচ্চিত্রের কাজ হলো সমাজ বাস্তবতাকে তুলে ধরা। কেউ বলতে পারেন চলচ্চিত্রের কাজ হলো দর্শককে পথপ্রদর্শন করা; সত্য-মিথ্যা ও ঠিক-ভুলের তফাৎ দেখিয়ে দেয়া। আবার কারো কারো কাছে চলচ্চিত্র হতে পারে নিছকই বিনোদনের মাধ্যম।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের একমাত্রিকতাই আমাদের চোখে পড়ে। বহুমাত্রিক ধর্ম কোথায় একটা যেন হারিয়ে গেছে। এবং এ নিয়ে বোদ্ধাশ্রেণীর দর্শকের হা-হুতাশেরও অন্ত নেই।
তবে এসব ডামাডোলের মাঝেই প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু বেশ একটা চলচ্চিত্র বিপ্লব ঘটে গেছে গত দশকে। সেই বিপ্লবের পথ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এক নতুন ঘরানার চলচ্চিত্র, যার গালভরা নাম তারা দিয়েছে নিও-মেইনস্ট্রিম। কথাটির কিছুটা আলগা বাংলা পরিভাষা হতে পারে নব্য মূলধারা।
তো এই নিও-মেইনস্ট্রিম বা নব্য মূলধারার ছবির আগমনে যেটি হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের দর্শক আজকাল স্থূল প্রেম-ভালোবাসা, মারামারি কিংবা চুটকি জাতীয় সংলাপ সর্বস্ব ছবি আর ‘খাচ্ছে’ না। একসময় সেখানে কমার্শিয়াল ফিল্ম আর আর্ট ফিল্মের মাঝে যে দেয়াল ছিল, সেটি এখন ভেঙে গেছে। আলাদা করে কমার্শিয়াল কিংবা আর্ট ফিল্মের অস্তিত্বও আছে বটে, কিন্তু মোটা দাগে দর্শক এখন হল অথবা সিনেপ্লেক্সমুখী হয়ে সেসব গল্পনির্ভর ছবিকেই বাণিজ্যিকভাবে সফল করে তুলছে, যেগুলো হয়তো বছর দশেক আগেও নিশ্চিত লোকসান মেনে নিয়েই নির্মিত হতো।
তাই আমরা পেছন ফিরে দেখতে পাই, গত দশকে পশ্চিমবঙ্গের যে ছবিগুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, যেমন: অটোগ্রাফ, ভূতের ভবিষ্যৎ, রাজকাহিনী, প্রাক্তন, বেলাশেষে, শব্দ কিংবা চাঁদের পাহাড়- সেগুলো কোনোটিই কিন্তু তথাকথিত ‘মসলাদার’ ছবি নয়। প্রতিটি ছবিরই প্রেক্ষাপট ভিন্ন, গল্পের ধাঁচ ভিন্ন, সামগ্রিকভাবে উপস্থাপনার ধাঁচটাও আলাদা।
নব্য মূলধারার চলচ্চিত্রের ফলে শুধু যে নির্মাতাদের গভীরতর বিষয় নিয়ে ছবি নির্মাণের প্রবণতাই বৃদ্ধি পেয়েছে, তা কিন্তু নয়। সেই সাথে দর্শকদের রুচিবোধেরও ক্রমোন্নতি ঘটেছে। অর্থাৎ নব্য মূলধারার প্রবাহটা কেবল রাস্তার একপাশ দিয়ে নয়, দু’পাশ দিয়েই হয়েছে। এবং এভাবেই চলচ্চিত্রের আধেয় ও দর্শকের রুচিবোধ যখন একটা পরিণত অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের উদয় ঘটেছে: পরবর্তী ধাপটার দেখা মিলবে কবে? নব্য মূলধারার ছবি কবে সব ঢাক ঢাক গুড় গুড় বাদ দিয়ে, কেবল রূপক ও উপমা-নির্ভরতাকে পেছনে ফেলে, সত্যিকারের সাহসিকতা দেখাতে পারবে?
অনেকেই জেনে অবাক হবেন, সেই সাহসিকতার প্রদর্শন ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে, যদিও যে ছবিটির মাধ্যমে হয়েছে, সেটি নিয়ে এই ভার্চুয়াল জগতে চর্চা হয়েছে নিতান্তই কম। তাই খুব কম মানুষই অবগত আছেন ছবিটি সম্পর্কে, ছবিটির অসাধারণত্ব সম্পর্কে।
যে ছবিটিকে দিচ্ছি পশ্চিমবঙ্গের নব্য মূলধারার চলচ্চিত্রকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব, সেটি অপর্ণা সেনের ‘ঘরে বাইরে আজ’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১৬ সালের উপন্যাস ‘ঘরে বাইরে’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নির্মিত ছবিটি। এ উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৮৪ সালে দারুণ একটি ছবি বানিয়ে গেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও। কিন্তু তারপরও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে নির্মিত অপর্ণা সেনের এই ‘ঘরে বাইরে আজ’ পুরোপুরি স্বাতন্ত্র্য, স্বনির্ভর।
মূল উপন্যাসের সাথে ‘ঘরে বাইরে আজ’-এর প্রাসঙ্গিক পরিবর্তন কিন্তু তেমন একটা হয়নি। ‘ঘরে বাইরে’-তে রবি ঠাকুর যে চিরকালীন সম্পর্কের গল্প ফেঁদেছিলেন, আর সেটিকে দাঁড়া করিয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক অবস্থার পটভূমিতে, অপর্ণা সেনও সেখান থেকে এক চিলতে সরে আসেননি। পরিবর্তন যদি আদৌ কিছুর হয়ে থাকে, তবে সেটি সময়ের। এবং সেই সময়ের স্রোতেই কাহিনীর পটভূমি ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদিতে কিঞ্চিৎ রদবদল ঘটলেও, প্রকৃত নির্যাসটা সেই আদি ও অকৃত্রিমই রয়ে গেছে।
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের মতো ‘ঘরে বাইরে আজ’ ছবির কাহিনীও আবর্তিত হয় বিমলা, নিখিলেশ আর সন্দীপকে কেন্দ্র করেই। অবশ্য একুশ শতকে এসে বিমলাকে বাধ্য করা হয় তার জন্মপ্রাপ্ত নামটিকে ঝেড়ে ফেলতে। এর বদলে তাকে দেয়া হয় বৃন্দা নামটি। এ ছাড়া আর উপায়ও অবশ্য ছিল না। দলিত সম্প্রদায়ে জন্ম হয়েছিল তার। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কলকাতায় যে বাড়িতে তাকে আশ্রয় দেয়া হয়, এবং তার ‘ব্রাহ্মণীকরণ’ হয়, তাদেরই ইচ্ছা ছিল বৃন্দার (বিমলা) সাথে যেন তার দলিত পরিচয়ের শেষ সংস্পর্শটুকুও আর না থাকে। এছাড়া এই বৃন্দা লেখাপড়া শিখে উচ্চশিক্ষিত হবার পর আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী, কেননা বইয়ের প্রুফ রিডার হিসেবে কাজ করে সে। এরপরও সে যে ঘরমুখী, বাইরের জগতকে দেখার প্রতি খুব একটা টান নেই, তা বোধ করি ছোটবেলা থেকে রক্ষণশীলতার বৃত্তে বন্দি থাকার ফলে।
বৃন্দার স্বামী নিখিলেশের মধ্যে অবশ্য খুব বেশি পার্থক্য নেই। মূল উপন্যাসের ন্যায় জমিদার সে নয় বটে, কিন্তু বেশ বড় একটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক সে। প্রচণ্ড উদারনৈতিক আদর্শে পরিচালিত তার জীবন। তাই তো তাদের বাড়িতে আশ্রিত একটি দলিত মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করতেও সে দ্বিধাবোধ করে না। কোনো হুমকি-ধামকির তোয়াক্কা না করে উদারনীতির প্রচারণাও চালিয়ে যায় সে, স্বপ্ন দেখে ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশের।
আর বৃন্দা-নিখিলেশের সুখের সংসারে ভাঙনের স্রোত হয়ে আসে যে সন্দীপ, সে এখন স্বদেশী বিপ্লবী না হলেও, কট্টর হিন্দু-জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক ও রাজনীতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তার কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতাদর্শ ও বিশ্বাসই আসল, এমনকি অনেকে সেগুলোকে অন্ধ কুসংস্কার প্রতিপন্ন করলেও। সে মনে করে, মানুষের সেবা করতে গেলে তাদেরকে বদলে দেয়া নয়, বরং তাদেরই একজন হয়ে ওঠা আবশ্যক। এমন রাজনৈতিক চেতনার পাশাপাশি তার রয়েছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও, যা দিয়ে খুব সহজেই সে মন জয় করে নিতে পারে নারীদের।
নিখিলেশ ও সন্দীপ ছিল ছোটবেলার বন্ধু। ২০ বছর অবশ্য দেখা-সাক্ষাৎ নেই তাদের। অধ্যাপনার কাজে দিল্লিতে এসে নিখিলেশের বাড়িতে ওঠে সন্দীপ, এবং সেখান থেকেই শুরু হয় কাহিনী। সন্দীপের উপস্থিতিতে জটিলতা সৃষ্টি হতে থাকে বৃন্দা-নিখিলেশের সম্পর্কে, তৈরি হয় এক ত্রিকোণ প্রেমকাহিনী। কিন্তু এ তো কেবল ঘরের কথা। বাইরেও সমগতিতেই প্রবাহিত হতে থাকে দ্বন্দ্বের চোরাস্রোত। সেই দ্বন্দ্বের উৎস মূলত নিখিলেশ ও সন্দীপের আদর্শিক সাংঘর্ষিকতা। দুই পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হতে থাকে বৃন্দা, যে কি না বাইরের দুনিয়া চেনেই না বলতে গেলে।
এভাবেই আকর্ষণ, প্রেম, কামনা, যৌনতার মতো মৌলিক মানবিক বিষয়গুলোর সাথে হাত ধরাধরি করে চলতে থাকে আরো একটি মৌলিক প্রশ্ন: কোন রাজনৈতিক চেতনাকে ধারণ করবে ভারত? চলতে থাকে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি, ঘটে যায় ঘটনার ঘনঘটা। কাহিনী এগোতে থাকে একটি চরম পরিণতির দিকে। তবে রবি ঠাকুরের উপন্যাস কিংবা সত্যজিৎ রায়ের বানানো ছবিটি যেখানে থেমে যায়, ঠিক সেখানেই থামেন না অপর্ণা সেন। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তরণের চিত্রও তিনি পরম যত্নে আঁকেন এ ছবিতে, যা সময়ের দাবি, এবং যা না থাকলে হয়তো এ ছবি পুনঃনির্মাণের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই থাকত না।
এ ছবির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী? অবশ্যই পরিচালকের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতিফলন। তিনি অবশ্যই নিরপেক্ষ নন, কেননা শতভাগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তারপরও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন দুই পক্ষের যুক্তিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করতে। তাছাড়া অতি পরিচিত একটি ত্রিকোণ প্রেমের গল্পে তিনি যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থা, ডানপন্থী হিন্দু-জাতীয়তাবাদ ও দলিত সমাজের তিনটি অতি জটিল সমীকরণকে একীভূত করেছেন, তা-ও দর্শকমনে বিস্ময়াতীত ভালোলাগার জন্ম দিতে বাধ্য। তাই তো আর কেউ বলার আগে অপর্ণা সেন নিজেই স্বীকার করে নেন,
“ঘরে বাইরে আজ আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে রাজনৈতিক ও স্পষ্টভাষী চলচ্চিত্র।”
রাজনৈতিক কেন, তা তো কাহিনীর প্রেক্ষাপট থেকেই আঁচ করা যায়। কিন্তু কেন একে তিনি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্পষ্টভাষী চলচ্চিত্র হিসেবেও অভিহিত করছেন? যারা ছবিটি দেখবেন, প্রথমার্ধ শেষ হবার আগেই নিশ্চিতভাবে সেই উত্তর তারা পেয়ে যাবেন।
একটি বিতর্ককে বড় পর্দায় নিয়ে আসতে চেয়েছেন পরিচালক। এমন স্পর্শকাতর সেই বিতর্ক, যা নিয়ে ইতোপূর্বে কোনো মূলধারার বাংলা ছবিতে সরাসরি কথা বলা হয়নি। অপর্ণা সেনই প্রথম কাজটি করলেন, এবং কোনো রাখঢাক না রেখে একদম সোজাসাপ্টা ভঙ্গিতে। তাই একে স্পষ্টভাষিতার পাশাপাশি তার সবচেয়ে সাহসী চলচ্চিত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না।
রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে অপর্ণা সেন নিজের জাত চিনিয়েছেন আগেও। এর আগে ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ কিংবা ‘আরশিনগর’-এর মতো ছবিগুলোতে তিনি একধরনের রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। আবার ‘ঘরে বাইরে আজ’-এ এসে একদমই ব্যতিক্রমী অবস্থানে আবির্ভূত হতে দেখা যায় তাকে। কারণ দিনশেষে তার ছবি রাজনীতির চেয়েও মানবনীতির উপস্থাপনেই বেশি বিশ্বাসী।
এই ছবির কাহিনী নির্মাণে কিছুটা অনুপ্রেরণা অপর্ণা সেন নিয়েছেন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে। ২০১৭ সালে বেঙ্গালুরুতে নিজ বাড়ির বাইরে অজানা আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছিলেন এ সাংবাদিক। আবার সন্দীপের চরিত্রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পরিচালক ধার করেছেন রবি ঠাকুরেরই আরেকটি রচনার রেফারেন্স, উদাহরণ টেনেছেন গোরার। মূল উপন্যাসের চেয়েও আরো বিস্তৃত ও ব্যাপকতা লাভ করে এ ছবি, যখন ঋগ্বেদেরও ধর্না দেন তিনি। তখন আর কাহিনী একটি নির্দিষ্ট কালের কিংবা ভৌগোলিক সীমারেখার গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না। হয়ে ওঠে মহাকালীন, হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন।
এ ছবির মাইটোকন্ড্রিয়া বলা যায় ত্রিকোণ প্রেমকাহিনীকে। কারণ এ কথা মানতেই হবে, রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যতজন দর্শক ছবিটি দেখবেন, এর চেয়ে ঢের বেশি দর্শক ছবিটি দেখবেন ঐ প্রেমকাহিনীর লোভেই। তাই রাজনৈতিক বক্তব্যে গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে প্রেমকাহিনীকে পেছনের আসনে ফেলে রাখার সুযোগ পরিচালকের কাছে ছিল না। সেই চেষ্টাও তিনি করেননি। এক অনন্য মমত্ববোধ ও সহানুভূতির সাথে এ অংশটাকে পর্দায়িত করেছেন তিনি। বৃন্দাকে একটিবারের জন্যও দায়ী করেননি। এমনভাবে তার গল্পটা বলেছেন যে, কোনো কারণেই তাকে দুষতে ইচ্ছা তো করবেই না, বরং ভীষণ দুঃখ হবে তার জন্য। নিখিলেশের আপাত-নৈঃশব্দ্য যে কাপুরুষতা নয়, তার ভেতরের এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরির বহিঃপ্রকাশ, এই উপলব্ধিটা উপন্যাসের বিমলারও হয়েছিল, তবে বড্ড দেরিতে। কিন্তু ছবিতে বৃন্দার মনে এ উপলব্ধির পাশাপাশি এক উত্তরণের যাত্রাও তিনি দেখিয়েছেন, যা থেকে দর্শক এক অনাস্বাদিতপূর্ব ক্যাথারসিসের স্বাদ পাবে।
অপর্ণা সেনের ছবি নিয়ে বক্তব্য অসম্পূর্ণই থেকে যাবে, যদি কথা বলা না হয় টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে। প্রথমত, পর্দায় এত ঝকঝকে দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে! লোকেশন নির্বাচনে যেমন মুনশিয়ানা ছিল, ঠিক তেমনই অনবদ্য ক্যামেরার কাজও। শমীক হালদারের জীবনের অন্যতম সেরা কাজ নিঃসন্দেহে। তাছাড়া একইরকম ভালো লাগার জন্ম দিয়েছে রবিরঞ্জন মৈত্রের সম্পাদনাও। আর এই দুয়ের চেয়েও বেশি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে নীল দত্তের সঙ্গীত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘেষা গান ও নেপথ্য সঙ্গীত দর্শককে সাহায্য করে কাহিনীর আরো গভীরে প্রবেশ করতে, চোখের সামনে হেঁটে-চলে বেড়ানো চরিত্রগুলোকে আরো বেশি অনুভব করতে।
সব মিলিয়ে অপর্ণা সেনের এ যাবতকালের সবচেয়ে নান্দনিক উপস্থাপনার ছবি বোধহয় এটিই। পোশাকের রং থেকে টি-টেবিলে পড়ে থাকা পত্রিকা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রতিটি বিষয়ে যেন একটু বেশি মাত্রার যত্নের ছাপই তিনি রেখেছেন। মনে হয় যেন তার স্থির বিশ্বাস ছিল, তাৎক্ষণিক সাফল্য না মিললেও ইতিহাস মনে রাখতে চলেছে তার এই ছবিটিকে।
এবার আসা যাক অভিনয়ের প্রসঙ্গে। কে বেশি ভালো, নিখিলেশ চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য, নাকি সন্দীপ চরিত্রে যীশু সেনগুপ্ত? ছোট ও বড় পর্দার এই দুই ব্যোমকেশই যেন মিশে গিয়েছিলেন নিজ নিজ চরিত্রে। কেউ যেন কারো চেয়ে কম নয়। তবে চারিত্রিক পার্থক্যের ফলে অনির্বাণ ও যীশুর অভিনয়েও তফাৎ রয়েছে।
নিখিলেশের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার ছাপ পাওয়া গেছে অনির্বাণের চোখে-মুখে, কথা বলার আগে তার খানিকটা ভেবে নেয়ার বিরতিতে, তার শক্তিশালী শব্দচয়নের মৃদুভাষিতায়। অপরদিকে যীশু যেন অভিনয় করেছেন গোটা শরীর দিয়ে। পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার চ্যালেঞ্জে তিনি একশোয় একশো। কথা দ্বারা শ্রোতাদের প্রভাবিত করা, নিজেকে সবসময় একটা মুখোশের আড়ালে ঢেকে রাখা, কিংবা বৃন্দার সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের রসায়ন, প্রতিটি জায়গাতেই যীশু যেন সত্যি সত্যিই সন্দীপ হয়ে উঠেছিলেন। এমন প্রতিভাবান একজন অভিনেতাকে এর আগে এতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে না পারা অন্যান্য নির্মাতাদের ব্যর্থতা।
আর এ ছবির সবচেয়ে বড় আবিষ্কার অবশ্যই বৃন্দা চরিত্রে অভিনয় করা তুহিনা দাস। নিখিলেশের ‘বাচ্চা বউ’ হিসেবে, কিংবা সন্দীপের প্রতি একটু একটু করে প্রস্ফুটিত হতে থাকা প্রেমের (কিংবা ইনফ্যাচুয়েশন) মুহূর্তগুলোতে তার অভিনয় ছিল দেখার মতো। আবার শোকাভিভূত বৃন্দা হিসেবেও তার কোনো তুলনা হয় না। সাময়িক প্রেমের উচ্ছ্বাস থেকে অপরাধবোধ লুকাতে হুট করে রুক্ষ মেজাজি হয়ে যাওয়া, আবার এক পর্যায়ে চরম অবসাদ্গ্রস্ত হয়ে পড়া, এবং সবশেষে তার চরিত্রের সেই বহুল আলোচিত উত্তরণ, সব জায়গাতেই নিখুঁত মনে হয়েছে তুহিনার অভিনয়। ছবির একপর্যায়ে নিখিলেশ বলেছিল, সে ‘পজেস’ করে না বৃন্দাকে। কিন্তু নিখিলেশের কাছে না হলেও, বৃন্দা ঠিকই ‘পজেসড’ হয়েছে নবাগতা তুহিনার কাছে।
ভুললে চলবে না অমূল্য চরিত্রে অভিনয় করা ঋতব্রত মুখার্জির কথাও। দিন দিন নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন এই তরুণ অভিনেতা। চারিদিকে বাঘা বাঘা সব অভিনেতাদের ভিড়েও, দরকার মতো আলোর ছটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে ভুল করেননি তিনি। এছাড়া পার্শ্বচরিত্রগুলোতে অঞ্জন দত্ত থেকে শুরু করে শ্রীনন্দা শঙ্কর, সোহাগ সেন, বরুণ চন্দ বা অলকানন্দা রায় প্রত্যেকেই যেন এ ছবির একেকজন সম্পদ।
আর বাংলা চলচ্চিত্রের এক অমূল্য সম্পদ অপর্ণা সেনের ‘ঘরে বাইরে আজ’। যেমনটি আগেই বলেছি, তাৎক্ষণিক সাফল্য পায়নি তো কী হয়েছে, অনাগত ভবিষ্যতে ঠিকই যথাযথ মূল্যায়ন পাবে মূলধারার বাংলা চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপনে এক অভূতপূর্ব মাইলফলক তৈরি করে দেয়া ছবিটি।