আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল ছাড়ি না। এটা আমার স্টাইল না।
সিনেমার একপর্যায়ে এক প্রসাদের উদ্দেশ্য আরেক প্রসাদের করা এই উক্তিই তার চরিত্রকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করে দেয়, দর্শকদের সামনে উন্মোচিত হয় তার চিন্তাভাবনার পদ্ধতি। মালায়ালাম ভাষার সিনেমা থোন্ডিমুথালাম দৃকশাকশিয়াম-এর মুক্তি ২০১৭ সালে। ইংরেজিতে এটির নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘The Exhibits and the Eye Witness’। সাধারণত একটি বা দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এমন পরিচালকদের পরবর্তী সিনেমা নিয়ে খুব একটা মাতামাতি হতে দেখা যায় না। কিন্তু এটি নিয়ে দর্শকদের মাঝে ছিল বিপুল আগ্রহ। তার কারণ দুটি- ১. এটির পরিচালক মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির পরিচিত মুখ দিলীশ পোথেন। এবং ২. তার নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘মাহেশিন্তে প্রাথিকারাম’-এর প্রবল দর্শকপ্রিয়তা।
দর্শকদের প্রবল আগ্রহের প্রতিদান ভালোভাবেই দিতে পেরেছেন পোথেন। এখানেও তাকে জুটি বাঁধতে দেখা গেছে ফাহাদ ফাসিলের সাথে। উল্লেখ্য, জোজি নামের পোথেনের ৩য় সিনেমাতেও এই জুটিকে একসাথে দেখা গেছে।
যেহেতু এই সিনেমার মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত পরিচালক কেবল আর একটি মুভিই পরিচালনা করেছিলেন, সেহেতু আগের সিনেমার সাথে তুলনা আসাটা অবধারিত। আর আগের সিনেমাটি যদি কেউ উপভোগ করে থাকে, তাহলে এটি উপভোগ না করার কোনো কারণ নেই। মাহেশিন্তে প্রাথিকারাম দর্শকরা উপভোগ করেছিলেন সেটির বাস্তবমুখীতা এবং সূক্ষ্মতার কারণে। সেখানেও ইন-ডেপথ ক্যারেক্টার স্টাডি ছিল, তবে এখানে ক্যারেক্টার স্টাডির ব্যাপারটাকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর তা কেবল মূল চরিত্রের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ওখানকার গল্পের সাথে মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির প্রচলিত ব্যাপার-স্যাপারের মিল লক্ষ করা গেলেও, এখানকার গল্প কিছু আনকনভেনশনাল। এখানে চরিত্রসমূহকে আমরা যে সমস্ত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে দেখি, তার সাথে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দারাই মিল খুঁজে পাবেন বলে মনে হয়।
এবার সিনেমার গল্পের দিকে মনোযোগ দেই। শুরুতে আমরা দেখতে পাই গল্পের দুইটি মূল চরিত্রকে। এদের একজন হলো প্রসাদ (সুরাজ ভেঞ্জারামুদু) এবং অন্যজন হলো শ্রীজা (নিমীষা সাজায়ান)। একটি ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে তাদের পরিচয় হয় এবং পরবর্তীতে সেটা পরিণয়ের দিকে এগোয়। কিন্তু এই পরিণয় নির্ঝঞ্ঝাট না, কারণ তাদের ধর্ম ভিন্ন। ফলে কোনো পরিবারই তাদের বিয়ে মনে নেয় না।
এমতাবস্থায় তারা নিজেদের এলাকা ছেড়ে কাসারগড নামক এলাকায় চলে যায়। প্রসাদ সিদ্ধান্ত নেয় এখানে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে। কিন্তু ঝামেলা নতুন আবাসস্থলেও তাদের পিছু ছাড়ে না। কেননা, তারা চাষের জন্য যে জমি কেনে; সেটিতে সেচ ছাড়া ফসল ফলানো সম্ভব না। আর সেচের জন্য খনন করতে হবে কূপ। কিন্তু সেটার টাকা নবদম্পতির কাছে নেই। তখন প্রসাদ স্ত্রীর অলংকার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। এই লক্ষ্যে যখন তারা বাসে করে যাচ্ছিল, তখনই খোয়া যায় শ্রীজার চেইন। শ্রীজার মতে তার চেইন কে নিয়েছে তা সে দেখেছে এবং চোরকেও শনাক্ত করে ফেলে সে। কিন্তু চোর নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। এই ব্যাপার নিয়ে বাসের ভেতর ব্যাপক বচসা হয় এবং ঘটনা থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। এরপর কী হয় তা-ই ১৩৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমার মূল বিষয়বস্তু। এটিকে সাসপেন্স ড্রামার মতো করেই নির্মাণ করেছেন পোথেন, সাথে যুক্ত করেছেন হিউমার ও অন্যান্য নির্যাস।
পয়েন্ট এ থেকে ঘটনাপ্রবাহ পয়েন্ট বি-তে যাবে এবং শেষে সুখকর একটা সমাপ্তি হবে, থোন্ডিমুথালাম দৃকশাকশিয়াম-এর স্ট্রাকচার এমন না। আমরা যে সাসপেন্সের আবহ অনুভব এবং অবলোকন করি, তার পুরোটাই সৃষ্টি হয় চোরের রহস্যময় আচরণের ফলে। তবে কেবল মুখ্য চরিত্ররাই যে এখানে গুরুত্ব পায় তা কিন্তু নয়। সিনেমা জুড়ে আমরা আরো বহু চরিত্রের কার্যকলাপ পর্দায় দেখতে পাই। এবং তাদের আচার-আচরণে চিত্রনাট্যের নানা বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিক্ত সত্য ফুটে ওঠে।
প্রসাদ এবং শ্রীজার সম্পর্ককে আর দশটা সাধারণ দম্পতির মতো করেই রচনা করা হয়েছে। আর চারপাশে যেসকল ঘটনা ঘটে, তাতে তারা অন্য দম্পতিদের মতোই প্রভাবিত এবং চাপ অনুভব করে। ভিন্ন ধর্মের হওয়ায় তাদের বিয়েতে উভয়ের পরিবারই নিজেদের সম্মানহানি হয়েছে বলে মনে করে। পরিবারের ভাবনাচিন্তা কীভাবে তাদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলে সেটা সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুণতার সাথে। এছাড়া অলংকার চুরি বা পুলিশ স্টেশনে ঘটা ঘটনাবলীর প্রভাবে তাদের সম্পর্কের কেমন অবস্থা হয় তাও ফুটে উঠেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।
২০১৬ সালের অ্যাকশন হিরো বিজু-এর পর এই চলচ্চিত্রেও দেখা গেছে উপমহাদেশের পুলিশ স্টেশনের বাস্তবিক উপস্থাপন। সিনেমার এক সিকোয়েন্সে আমরা দেখি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে শ্রীজার স্বামী চোরকে বলে, “তুই আসলে কেমন মানুষ?”
দর্শকরাও চোরের ব্যাপারে প্রসাদের এই ভাবের সাথে সহমত পোষণ করবেন। যারা সরাসরি তার আচরণের কারণ সম্পর্কে জানতে চান, তারা হয়তো তার আচরণের ওপেন এন্ডেড দিকটি দেখে কিছুটা হতাশ হবেন। কিন্তু এটিকে তার একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে ভেবে নিতে পারেন।
দিলীশ পোথেন সিনেমার ট্রেইলার, পোস্টার সব জায়গায় ফাহাদ ফাসিলের ছবি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সিনেমায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমরা তার দেখা পাই না। যখন পাই, সেটা হয় অনেকটা নাটকীয়ভাবে। পর্দায় কেবল চোখ দুটোর প্রদর্শনের মাধ্যমে ফাহাদ যেভাবে আসেন, তা অনেকটা বাণিজ্যিক বা ম্যাস ছবিতে হিরোর এন্ট্রিকে মনে করিয়ে দেয়। তবে পরের সিকোয়েন্সেই আবার আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, ফাহাদ একজন ক্যারেক্টার আর্টিস্ট। গল্পের স্বার্থে তিনি নিজের ঠাটবাটকে পাশে সরিয়ে রাখতে পারেন।
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যে চোরের কথা আলোচনা করছিলাম, তার চরিত্রেই অভিনয় করেছেন ফাহাদ ফাসিল। গল্পের ৩য় গুরুত্বপূর্ণ এই চরিত্রের কী নাম তা খোলাসা করেননি পরিচালক। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে জবাব দেয় তার নাম প্রসাদ। কিন্তু প্রসাদ আর শ্রীজার কাছে মনে হয় চেইনের মতো প্রসাদের নামটিও চুরি করে সে নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। এই চরিত্রের সাথে তিনি এতটাই ভালোভাবে মিশে গেছেন যে, আমরা দর্শকরাও বুঝতে পারি না তার কোন কথা সত্য আর কোন কথা মিথ্যা; বা কীভাবে তার আচার-আচরণের বিচার আমরা করবো। তার বলা ডায়লগ আর আচার-আচরণে সিনেফাইলরা আলাপ-আলোচনার প্রচুর খোরাক খুঁজে পাবেন।
ফাহাদের পার্ফম্যান্স নিয়ে মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির ভক্ত মাত্রই জানেন একটা চরিত্রকে তিনি কতটা গুরুত্বের সাথে নেন। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সুরাজ ভেঞ্জারামুদু সুযোগ পেয়েছেন একটি টিপিক্যাল উপমহাদেশীয় পুরুষের চরিত্র রূপায়ণের। আর কোনো খামখেয়ালীপনা বিহীন এই চরিত্রে তিনি উৎরে গেছেন অনায়াসে। শ্রীজা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই বড় পর্দায় অভিষেক ঘটলো নিমীষা সাজায়ানের। শ্রীজার চরিত্রের ভালোবাসা, ত্যাগ, সংকল্পবদ্ধতা এসব ভাব তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সফলতার সাথে। অ্যালেন্সিয়ার লেই লোপেজকে দেখা গেছে চন্দ্রন নামের একজন পুলিশ অফিসারের চরিত্রে। তদন্ত চলাকালীন সময়ে মানসিক চাপে যার অবস্থা টালমাটাল হয়ে পড়ে। নিজের চরিত্রে তিনিও ছিলেন অসাধারণ।
সিনেমায় বাস্তবতার উপস্থাপনের ব্যাপারটি পোথেনের নামের সাথে মিশে গেছে মাহেশিন্তে প্রাথিকারামের সময় থেকেই। এখানেও একই পথ অনুসরণ করেছেন তিনি। নির্মাতারা কাস্টিং করার সময় বাস্তবে পুলিশে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন লোকজনকে খুঁজেছিলেন আর এই সিদ্ধান্ত কাজ করেছে টনিকের মতো। সিবি থমাস অভিনীত এসআই চরিত্রটি, কখনো ইউনিফর্ম না পরা পুলিশ সদস্য, সিআইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা, ঐ পুলিশের লোক যে অনুসন্ধানের সময় পথ হারিয়ে ফেলে; এদের সবার কথাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাকি চরিত্ররাও গল্পের সাথে মিশে গেছে সহজেই। কাউকে বেখাপ্পা লাগেনি।
পরিচালক চলচ্চিত্রকে আরো আকর্ষণীয় করতে ম্যাড়ম্যাড়ে মুহূর্তগুলোতে কিছু বাস্তবিকভাবে হাস্যকর পরিস্থিতি জুড়ে দিয়েছেন। যার ফলে আর্ট আর বাণিজ্যিক ফিল্মের সীমারেখা অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে, বেড়েছে উপভোগ্যতার মাত্রা। একটি চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিনেমার কাহিনী আবর্তিত হলেও এখানে মব মেন্টালিটি, বর্ণবৈষম্যসহ আরো নানা ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে৷ রানটাইমকে ভালোমতো ব্যবহার করা হয়েছে। সোলার প্যানেল, মোবাইল টাওয়ারের ঐ দৃশ্যগুলোরও কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয়েছে।
সাজিভ পাজহুর চিত্রনাট্য লেখার সময় তাতে পুলিশি অনুসন্ধানের সূক্ষ্মতম ব্যাপারগুলোকে সংযুক্ত করেছেন, যেটিকে আরো বাস্তবসম্মত করেছে শ্যাম পুষ্করণের লেখা ডায়লগ। সিনেমার শেষে দর্শক চোর, প্রসাদ, শ্রীজা, এসআই, চন্দ্রন এদের মনস্তত্ত্ব এবং আচার-আচরণের মোটিভের ব্যাপারে আরো ব্যাপক ধারণা লাভ করে। সিনেম্যাটোগ্রাফার রাজিভ রাভির কথা বলতে হয় বিশেষ করে। তিনি সুচারুভাবে ফ্রেমের মাঝে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং কৌতূহলের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সিনেমাটিকে তিনি এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যাতে দর্শকের মনে হয় এসব ঘটনা তার চোখের সামনেই ঘটছে। এটি থোন্ডিমুথালাম দৃকশাকশিয়াম-এর সফলতার ক্ষেত্রে বেশ ভূমিকা রেখেছে। পুলিশ স্টেশনে পানি দিতে আসা লোকটিকেও তখন আর অপাংক্তেয় মনে হয়নি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের উপস্থিতি খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও তা খুব কাজের, এডিটিংও হৃদয়গ্রাহী।
এই সিনেমা একেক দর্শকের কাছে একেক রূপে ধরা দেবে। হয়তো দেখবেন, দেখতে বসে আপনিই সিনেমার নতুন কোনো দিক বা কোনো চরিত্রের নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করে বসে আছেন! ধূসর রংয়ের কালার গ্রেডিং আর ফ্রেম থেকে ক্ষরিত হওয়া বাস্তবমুখীতার সমন্বয়ে থোন্ডিমুথালাম দৃকশাকশিয়াম আপনার মস্তিষ্কে থেকে যাবে আরো বহুদিন।