হাউজ স্লিদারিনের জন্য নির্বাচিত হতে হলে যে গুণগুলো অবশ্যম্ভাবী, সেগুলো হচ্ছে ধূর্ততা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও রক্তের বিশুদ্ধতা। হাউজ স্লিদারিন ও হগওয়ার্টসের চার প্রতিষ্ঠাতার একজন সালাজার স্লিদারিনের কাছে এই গুণগুলো ছিল খাঁটি হীরের ন্যায় মূল্যবান। স্কুল জীবনে তিনি এসবের উপর প্রাধান্য দিয়েই নিজ হাউজে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছেন। এ ধরনের গুণাবলী সাথে নিয়ে টম রিডলের মতো ধূর্ত ছাত্ররা হেঁটেছে ঘোর অমানিশার পথ ধরে, যার পরিণতি ঠেকেছে গিয়ে কালো জাদুর আগ্রাসনে। এই হাউজের অনেক জাদুকরই অনুপ্রাণিত হয়েছে ভলডেমর্টের ঋণাত্মক চিন্তাভাবনায়, পরিণত হয়েছে ডেথ ইটারে।
তবুও, হাউজ স্লিদারিনের এমন জাদুকরের সংখ্যাও কম নয় যারা তাদের চালাকি, কৌশল এবং আকাঙ্ক্ষাকে ব্যবহার করেছেন নিঃস্বার্থ ও প্রশংসনীয় উপায়ে। ফলে, তারা হয়ে গেছেন জাদু জগতে জগদ্বিখ্যাত, স্থান করে নিয়েছেন সেরাদের তালিকায়। সবুজ-রূপালী রঙে আচ্ছাদিত স্লিদারিনের এমন কিছু শক্তিশালী জাদুকরকে নিয়েই আমাদের এই ছোটখাটো আয়োজন।
অ্যান্ড্রোমিডা টঙ্কস
ব্ল্যাক পরিবারের বিশুদ্ধ রক্তের আভিজাত্য ও অহমিকা প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে আসা এক মহীয়সী নারীর নাম অ্যান্ড্রোমিডা টঙ্কস। তিনি টেড টঙ্কস নামে এক মাগল-বর্নের সাথে ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন, যার পরিণতি গিয়ে ঠেকে বিবাহবন্ধনে। তিনি ছিলেন সাইগনাস ও ড্রুয়েলা ব্ল্যাকের দ্বিতীয় সন্তান। আরো খানিকটা পরিচিত পরিচয় দিতে চাইলে, তিনি বেল্লাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জের ছোট বোন, নারসিসা ম্যালফয়ের বড় বোন, নিমফ্যাডোরা টঙ্কসের মা, এবং সিরিয়াস ও রেগুলাস ব্ল্যাক হলো তার কাজিন।
হগওয়ার্টসে তার অধ্যয়নকাল ছিল ১৯৬০-এর মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত। হিলিং ম্যাজিকে তিনি অসম্ভব পারদর্শী ছিলেন। ব্যাটেল অভ সেভেন পটারসের পর তিনি হ্যাগ্রিডের জখম পুরোপুরিভাবে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। হাউজহোল্ড ম্যাজিকেও ছিল তার জুড়ি মেলা ভার। পুরো ঘরের কাজ তিনি সামলাতে পারতেন শুধুমাত্র মন্ত্র দ্বারা। নিমফ্যাডোরা টঙ্কসের মতে, প্যাক চার্মে অ্যান্ড্রোমিডা ছিলেন বিশেষ দক্ষ। অর্থাৎ, তিনি হাতের ইশারাতেই পুরো ঘর সাফ করে ফেলতে পারতেন।
ডেথ ইটারদের ক্রুশিয়াটাস কার্সের কাছেও তিনি ছিলেন ইস্পাতের মতো দৃঢ়-কঠিন। অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের গোপন তথ্য উদঘাটনের জন্য ডেথ ইটাররা অ্যান্ড্রোমিডা ও তার স্বামীকে ক্রুশিয়াটাস কার্সের মুখোমুখি দাঁড় করালেও দমে যাননি তিনি। দুনিয়া কাঁপানো দুই জাদুকর রেমাস লুপিন আর নিমফ্যাডোরা টঙ্কসের ছেলে টেড লুপিন মা-বাবার মৃত্যুর পর তার মাতামহী অ্যান্ড্রোমিডা টঙ্কসের কাছে বড় হতে থাকে। টেডের ধর্মপিতা ছিল হ্যারি পটার, তাই মাঝে মাঝেই হ্যারি তাকে দেখতে যেত।
লেটা লেস্ট্রেঞ্জ
অ্যালবাস ডাম্বলডোরের মতো জাদুকরের ভাষায়, লেটা লেস্ট্রেঞ্জ হলেন তার দেখা অন্যতম চতুর এক শিক্ষার্থী, যা পরোক্ষভাবে তার জাদু দক্ষতাকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসিয়েছে। গেলার্ট গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের সমসাময়িক এই নারী জাদুকর তখনকার যুগে জাদু জগৎ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, সেটা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না। গ্রিন্ডেলওয়াল্ড তাকে নিজ দলে ভেড়ার সুযোগ দিলেও, তিনি তা গর্বভরে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ভলডেমর্টের আমলে যেখানে স্লিদারিন ও পিওর-ব্লাড পরিবারের অধিকাংশ জাদুকর অন্ধকার পথ বেছে নিয়ে ভলডেমর্টের অনুসারী হয়েছে, সেখানে একই বৈশিষ্ট্য (স্লিদারিন ও পিওর ব্লাড) থাকা সত্ত্বেও তিনি যে স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন, তা অবশ্যই তারিফের যোগ্য।
হগওয়ার্টসে ছাত্রাবস্থায় থাকাকালীন তিনি বহুবার উৎপীড়ন-নিপীড়নের স্বীকার হয়েছেন। তখন হাউজ হাফলপাফের শিক্ষার্থী নিউট স্ক্যামান্ডারের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। নিজ যোগ্যতা বলে জাদু মন্ত্রণালয়ে চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। চার্মে বিশেষ দক্ষ এই শিক্ষার্থী তার ভেল্কি দেখেছিলেন তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীনই। তখন তিনি গ্রিফিন্ডরের এক নারী শিক্ষার্থীর উপর ডার্ক চার্ম ওসকাউসি প্রয়োগ করে তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মন্ত্রের মাধ্যমে তিনি ফরাসি জাদু মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড রুম থেকে লেস্ট্রেঞ্জ পরিবারের পুরো ইতিহাস চোখ পলকে বের করে ফেলেছিলেন, চিরকামরোটা চার্মের মাধ্যমে নিউট ও টিনার অবস্থান বের করে, রিভারতে চার্মের মাধ্যমে তাদেরকে আসল জায়গায় নিয়ে আসার ক্ষমতা দেখে বোঝা যায়, মন্ত্র প্রয়োগে তিনি কতটা পটু ছিলেন।
১৯২৭ সালে নিউটের বড় ভাই থিসেয়াস স্ক্যামান্ডারের সাথে বাগদান সম্পন্ন হয় লেটার। সে বছরই প্যারিসের জাদুকর সমাবেশে গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের হাতে প্রাণনাশ ঘটে মেধাবী এই জাদুকরের। তিনি মূলত নিজের জীবন উৎসর্গ করে ওখান থেকে স্ক্যামান্ডার ভাইদের পালানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সাথে এ-ও প্রমাণ করেছিলেন, হাউজ স্লিদারিন বা পিওর ব্লাড মানেই অন্ধকার পথ বেছে নেওয়া নয়।
রেগুলাস ব্ল্যাক
স্লিদারিনের অন্য জাদুকরদের দেখানো পথ ডেথ ইটারের দিকে এক পা এক পা করে এগোচ্ছিলেন রেগুলাস ব্ল্যাক। একজন সফল ডেথ ইটারে পরিণত হওয়া যেন ছিল তার লালিত স্বপ্ন, পারিবারিক দুষ্টচক্রের প্রভাবকও যেন যুগিয়েছিল পরিপূর্ণ সমর্থন তাতে। ১৯৬১ সালে গ্রেট ব্রিটেনে বিখ্যাত ব্ল্যাক পরিবার জন্মগ্রহণ করেন রেগুলাস। তিনি ছিলেন মহান জাদুকর সিরিয়াস ব্ল্যাকের আপন ছোট ভাই। ১৯৭২ সালে হগওয়ার্টসের স্লিদারিন হাউজে যুক্ত হবার পরেই ভলডেমর্টের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে দেন। কিন্তু কয়েক বছর যাওয়ার পরই মন-মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আসে রেগুলাসের। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে, ভলডেমর্ট ও ডেথ ইটারদের কাছ থেকে দূরে সরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কুইডিচে বেশ পারদর্শী হওয়ায় স্লিদারিনের সিকার পজিশনে জায়গা পেয়ে যান তিনি। হ্যারি পটার পরবর্তী সময়ে প্রফেসর স্লাগহর্নের সাথে রেগুলাস ও তার কুইডিচ দলের একটি ছবির সন্ধান পেয়েছিল।
তিনি ভলডেমর্ট দ্বারা এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে, ডেইলি প্রফেট পত্রিকা থেকে ডার্ক লর্ড ও তার অনুসারী ডেথ ইটারদের টুকরো টুকরো খবর কেটে-ছেঁটে সযত্নে সেঁটেছিলেন নিজ ঘরের দেয়ালে। পুরো দেয়াল জুড়ে শুধু ডেথ ইটার সমারোহ, প্রথম দেখায় কেউ মনে করতেই পারে, সে ভুলক্রমে ডেথ ইটারের রাজ্যে প্রবেশ করে ফেলেছে।
সবকিছু ঠিকমতোই চলছিল, কিন্তু গণ্ডগোলের সূচনা হয়েছিল হাউজ-এল্ফ ক্রিচারকে দিয়ে। তৈরি করা হরক্রাক্সগুলো কতটা সুরক্ষিত, ভলডেমর্ট তা পরীক্ষা করতে চাইলে স্লিদারিনের লকেটটাকে ক্রিস্টাল কেইভে (স্ফটিক গুহা) রেখে তার অনুগত ভৃত্য রেগুলাস ব্ল্যাকের হাউজ-এল্ফ ক্রিচারকে ওই গুহায় নিয়ে যায়। তারপর তাকে এমেরাল পোশন খাইয়ে ক্রিস্টাল কেইভ আইল্যান্ডে ছেড়ে দেওয়া হয়। ক্রিচার হাউজ-এল্ফ জাদুর দ্বারা ওখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিল।
ওখান থেকেই রেগুলাস বুঝতে পেরেছিলেন স্লিদারিনের লকেটটা মূলত একটা হরক্রাক্স। আর এই হরক্রাক্সের মাধ্যমে ভলডেমর্ট যদি অমরত্বের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে, তবে জাদু জগতকে কেউ আর বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না, পরিণত হবে অরাজকতার আখড়ায়। নষ্ট হবে এর সকল ভারসাম্য। তাই তিনি স্লিদারিনের লকেটের মতো দেখতে হুবহু নকল একটি লকেট তৈরি করে, এবং ক্রিচারকে সাথে নিয়ে আসল হরক্রাক্স চুরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান।
তিনি ক্রিচারকে আদেশ দিয়েছিলেন, তার মৃত্যু হলেও যাতে ক্রিচার হরক্রাক্সের সরানোর দায়িত্বটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। ক্রিস্টাল কেইভে ইনফেরির কবলে পড়ে মৃত্যু ঘটে রেগুলাসের। অন্যদিকে ক্রিচার সেখান থেকে লকেট নিয়ে পালিয়ে গিয়ে তার প্রভুর আদেশ পালন করতে সক্ষম হয়। সূচনাটা ভুল পথে হলেও, পরবর্তী সময়ে জাদু জগতকে কলুষতা থেকে মুক্ত করার জন্য নিজের মূল্যবান প্রাণটাও স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করে দিয়েছেন রেগুলাস ব্ল্যাক।
বিশুদ্ধ রক্তের অহমিকায় ডুবে থাকা কয়জন জাদুকর এমনটা করতে পেরেছে?
হোরেস স্লাগহর্ন
হোরেস স্লাগহর্নের মতো প্রতিভাবান জাদুকরেরা ছিলেন হগওয়ার্টস তথা জাদু জগতের মহামূল্যবান সম্পদ। জাদুবিদ্যার সকল নিগূঢ় তত্ত্ব ও প্রয়োগগত সফলতা ছিল তার হাতের মুঠোয়। সবচেয়ে জটিল, শক্তিশালী ও দুঃসাধ্য পোশন তৈরি করে তিনি এ যোগ্যতার ওজন দেখিয়েছেন বহু আগেই। ডার্ক ম্যাজিক ও পোশন সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রপ্ত করা এই পণ্ডিত ছিলেন স্লিদারিন থেকে বের হওয়া অন্যতম সেরা এক জাদুকর।
মেধাবী, চতুর, ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদের একত্র করার উদ্দেশ্যে তিনি হগওয়ার্টসে ‘স্লাগ ক্লাব’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন। লর্ড ভলডেমর্ট ওরফে টম রিডল ছিল স্লাগহর্নের প্রিয় এক শিক্ষার্থী। ষষ্ঠ বর্ষে থাকাকালীন রিডল প্রফেসর স্লাগহর্নকে হরক্রাক্স সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। সে জানতে চায়, একের বেশি হরক্রাক্স বানানো যাবে কি না। সে এই হরক্রাক্সের কথা মূলত নিষিদ্ধ বই থেকে জানতে পেরেছিল। স্লাগহর্ন সাত-পাঁচ কিছু না ভেবেই নির্দ্বিধায় টপাটপ সব উত্তর বাতলে দেন। কারণ, স্লাগহর্ন তখনো রিডলের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। ভেবেছিল, ছেলেটা বোধহয় কৌতূহল মেটানোর জন্য প্রশ্নগুলো করছে।
কিন্তু তার এই সহজ-সরল মনোভাবনা জাদু জগতে যে আরেকটা মহাযুদ্ধ ডেকে আনতে যাচ্ছে, তা তিনি জানতেন না ঘুণাক্ষরেও। বিষয়টা নিয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি ছিলেন দারুণ অনুতপ্ত। লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য তিনি জাদুর মাধ্যমে নিজের স্মৃতিটাকেই পালটে দিলেন, যাতে স্মৃতিপাত্র দ্বারা ভলডেমর্টের হরক্রাক্স সৃষ্টির মূল কাহিনী কেউ জানতে না পারে। তাতে ধোঁকা খেয়েছিলেন স্বয়ং অ্যালবাস ডাম্বলডোরও।
বলতে গেলে জাদু জগতের মোটামুটি সবক্ষেত্রেই ছিল স্লাগহর্নের অবাধ বিচরণ। জাদুবিদ্যার রপ্ত কৌশলে তিনি ছিলেন একেবারে খাঁটি সোনা। জাদু জগতের যত কঠিন কাজ আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সঠিক মাপে পোশন তৈরি করা। তিনি পোশন তৈরির ওস্তাদ ছিলেন বলেই, হগওয়ার্টসে সে বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পেরেছিলেন। ‘ফেলিক্স ফেলিচিস’ নামক সৌভাগ্যবর্ধক পোশন (লিকুইড লাক) তৈরি করা তার কাছে ছেলেখেলা ছিল মাত্র। পলিজুস পোশন, অ্যামরটেনশিয়া পোশনের মতো কঠিন জিনিসও তৈরি করাও তিনি দক্ষ হাতে সামাল দিতে পারতেন।
ট্রান্সফিগারেশনের মাধ্যমে যে তিনি চেয়ারে পরিণত হয়েছেন, তা কমবেশি সবাই সিনেমায় দেখেছে। ছড়ি হাতেও তিনি কতটা পারদর্শী, তা দেখা গিয়েছে হগওয়ার্টস সুরক্ষার ছাদ তৈরি করার সময়। কালো জগত কাঁপানো লর্ড ভলডেমর্টও স্লাগহর্নের কাছ থেকে প্রথম হরক্রাক্স সম্বন্ধে জেনে নিয়েছিল। এটা স্পষ্টভাবে জানান দেয়, তিনি ডার্ক আর্টস বা কালো সম্বন্ধে কত সূক্ষ্মভাবে জানতেন।
মার্লিন
মার্লিন হয়তো কখনো পটারভার্সে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু তাকে সর্বকালের সেরা জাদুকরদের একজন ধরা হয়। তিনি ছিলেন সালাজার স্লিদারিনের একেবারে নিজ হাতে গড়া ছাত্র, অর্থাৎ স্লিদারিনের আমলেই তিনি হগওয়ার্টসে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি হগওয়ার্টসের পাঁচটা গোপন কক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন, যেগুলো পরবর্তী সময়ে অভিশপ্ত ভল্ট হিসেবে সিল-গালা করে দেয়া হয়। কারণ, তিনি ওই কক্ষগুলো প্রাচীন জাদু দিয়ে আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন।
চকলেট ফ্রগ কার্ডের মাধ্যমে তিনি হগওয়ার্টসের শিক্ষার্থীদের কাছে অমর হয়ে আছেন। হ্যারি পটারের কাছে ওই কার্ডের একটা কপি সংরক্ষিত ছিল। উল্লেখ্য, মার্লিনের সম্মানার্থে যে সকল জাদুকর খ্যাতির চূড়ায় আহরণ করে, মেধা, সাহসিকতা ও সৃজনশীলতা দ্বারা অভাবনীয় সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারে, তাদেরকে ‘দ্য অর্ডার অভ মার্লিন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বেল্লাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জ
হ্যারি পটারের সময়ে যে ক’জন জাদুকরের জন্য স্লিদারিনের কুখ্যাতি কুড়িয়েছিল, তাদের মধ্যে বেল্লাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জ অন্যতম। সে ছিল ভলডেমর্টের অন্যতম অনুগত সহযোগী। বলতে গেলে তাকে ছাড়া ভলডেমর্ট ছিল খানিকটা অচল ও অসম্পূর্ণ। ভলডেমর্টের মালা জপতে জপতেই জীবনের প্রায় পুরোটা অংশ পার করে দিয়েছে সে। স্লিদারিনের এই শিক্ষার্থী স্কুলজীবন থেকেই অনেকটা সহিংস প্রকৃতির। সুযোগ পেলেই শিক্ষার্থীদের উপর ডার্ক আর্টসের সাহায্যে নিপীড়ন চালাত বলে, অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলত। কালো জাদুর প্রতি ভীষণ স্পৃহা থাকায়, সবকিছু বোঝার সাথে সাথেই সে নিজেকে ডেথ ইটারে পরিণত করে ফেলে। লর্ড ভলডেমর্টের সংস্পর্শে এসে নিজ জীবনের আসল অর্থ ও লক্ষ্য খুঁজে পায় বেল্লাট্রিক্স। জাদু জগতের প্রথম মহাযুদ্ধে সে ব্যাপক আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ফলে একসময় সে পরিণত হয় ডার্ক-লর্ডের সবচেয়ে অনুগত ভৃত্যে।
জাদু জগতের প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, নেভিল লংবটম যখন সবেমাত্র শিশু, তখন বেল্লাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জ, তার স্বামী, এবং বার্টি ক্রাউচ জুনিয়র মিলে নেভিল লংবটমের মাতা-পিতা অ্যালিস ও ফ্র্যাঙ্কের উপর অমানবিক জুলুম চালায়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে তাদেরকে সেন্ট মাঙ্গোস হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওদিকে ভলডেমর্ট শিশু হ্যারি হত্যা অভিযানে ব্যর্থ হয়ে গেলে, কোণঠাসা হয়ে পড়ে ডেথ ইটাররা। জাদু মন্ত্রণালয়ের অরোরেরা এই সংগঠনের সদস্যদের ধরে ধরে আজকাবানে প্রেরণ করে। তখন ডেথ ইটারদের কেউ কেউ জবানবন্দি দেয়, তাদেরকে জোর করিয়ে ও ভয় দেখিয়ে ভলডেমর্ট এ কাজে রাজি করিয়েছে। তবে দু’জন জাদুকর ভলডেমর্টের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিল; বেল্লাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জ ও তার স্বামী রডলফাস লেস্ট্রেঞ্জ। তারা স্বেচ্ছায় নিজেকে আজকাবান কারাগারে সমর্পণ করে দেয়।
ভলডেমর্টের প্রত্যাবর্তনের পর বেল্লাট্রিক্স সহ অনেক ডেথ ইটার আজকাবান থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। এরপরই শুরু হয়ে যায়, রণক্ষেত্রের ঘুঁটির চাল। মল্লযুদ্ধে বেল্লাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জ কতটা দক্ষ ছিল, তা আন্দাজ করা যায় সিরিয়াস ব্ল্যাক, ও নিমফ্যাডোরা টঙ্কসের উদাহরণ থেকেই। দুজনেই ছিলেন সুদক্ষ জাদুকর, অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের সক্রিয় সদস্য, এবং লেস্ট্রেঞ্জের আত্মীয়। অথচ দুর্ভাগ্যবশত দু’জনকেই প্রাণ হারাতে হয় এই বেল্লাট্রিক্সের কাছেই। তার মস্তিষ্কের ধার এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভলডেমর্টের প্রতি সেভেরাস স্নেইপের আনুগত্য নিয়ে সে-ই প্রথম সন্দেহের তীর তাক করেছিল। কালো জাদুর আদ্যোপান্ত জানা ছিল তার, সেজন্য এর ব্যবহারও খুব ভালো করে জানত সে। ভলডেমর্টের স্রোতে গা না ভাসালে বেল্লাট্রিক্স হয়তো জাদু দুনিয়া থেকে প্রচুর সম্মান, সুনাম ও খ্যাতি কুড়িয়ে নিতে পারত।
সালাজার স্লিদারিন
৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সালাজার স্লিদারিন প্রিয় বন্ধু গড্রিক গ্রিফিন্ডর, হেলগা হাফলপাফ, ও রোয়েনা র্যাভেনক্লকে সাথে নিয়ে অতি-যত্নে গড়ে তোলেন হগওয়ার্টস স্কুল অভ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রি। তারপর পুরো স্কুলকে চারটি হাউজ বা শাখায় ভাগ করা হয়। উদ্দেশ্য, চারজন প্রতিষ্ঠাতা তাদের পছন্দের গুণ অনুযায়ী নিজ হাউজে ছাত্র নির্বাচন করবেন।
অন্যান্য গুণ থেকে স্লিদারিন সুচতুরতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিশ্বস্ততা ও রক্তের বিশুদ্ধতাকে প্রাধান্য দিতেন বেশি। তিনি পিওর-ব্লাড ছাড়া বাকিদের তেমন পছন্দ করতেন না বলে নিজ হাউজে পিওর-ব্লাড ছাড়া অন্য কোনো শিক্ষার্থীকে ভর্তি করাতে কোনো আগ্রহ দেখাননি। নিজে বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী ও খানিকটা অহংকারী হওয়ায় অর্ধ-বিশুদ্ধ ও অবিশুদ্ধ রক্তের জাদুকরদের ঘৃণা করতেন স্লিদারিন। তার মতে, জাদুবিদ্যা শুধু পিওর-ব্লাডদেরই শেখার অধিকার আছে, আর মাগলরা হলো জাদু-শিক্ষায় অসমর্থ ও বিশ্বাসের অযোগ্য। সেজন্য, পিওর-ব্লাড ছাড়া অন্য কেউ যাতে হগওয়ার্টসের চৌকাঠ মাড়াতে না পারে, সে বিষয়ে তিনি হগওয়ার্টসের বাকি তিনজনের কাছে এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
সে প্রস্তাবে হেলগা, গড্রিক, ও রোয়েনা ঘোর আপত্তি করেন। গড্রিক স্লিদারিনের কাছের বন্ধু হওয়ায়, তার সাথে বাক-বিতণ্ডা শুরু করেন, যা একপর্যায়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে গিয়ে গড়ায়। যুদ্ধে জয় পান গড্রিক গ্রিফিন্ডর। এরপর চিরকালের জন্য হগওয়ার্টস ত্যাগ করেন সালাজার স্লিদারিন। সালাজার স্লিদারিন ও তার পরিবার সাপের ভাষায় (পার্সেলটাং) কথা বলতে পারতেন। এছাড়াও তিনি ব্যাসিলিস্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। ব্যাসিলিস্ককে তিনি হাজার বছর ধরে চেম্বার অভ সিক্রেটসে প্রহরায় নিযুক্ত করে রেখেছিলেন।
এ রকম কানাঘুষাও শোনা যায়, স্লিদারিন চেম্বার অভ সিক্রেটস বানিয়েছিলেন মূলত তার হাউজের শিক্ষার্থীদেরকে কালো জাদু বা ডাকিনীবিদ্যা শেখানোর জন্য। তিনি কিলিং কার্স, ইম্পেরিয়াস কার্স সহ অনেকগুলো অমার্জনীয় অভিশাপের ব্যবহার খুব ভালোভাবে জানতেন। জাদু জগতের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভলডেমর্টের অনুসারীদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল হাউজ স্লিদারিনের। ধারণা করা হয়, হাউজ স্লিদারিনের শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই নিষিদ্ধ জাদু চর্চার প্রতি আগ্রহ দেখায় বেশি। স্লিদারিন সর্প-কাঠ ও ব্যাসিলিস্কের শিং দিয়ে শক্তিশালী একটি জাদু ছড়ি তৈরি করেছিলেন। তার একটি লকেট প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়েছে। স্লিদারিনের শিক্ষার্থী ও তার বংশধর টম রিডল একটা সময় সেটাকে হরক্রাক্সে রূপান্তর করে ফেলে।
সেভেরাস স্নেইপ
যদি জিজ্ঞেস করা হয়, হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজিতে সবথেকে আইকনিক চরিত্রের প্রতিফলন কোনটা? মানব মনের ধূসর এবং জটিল ব্যক্তিত্ব সব থেকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে কোন চরিত্রটি? কিংবা অনুগত ভালোবাসায় প্রিয় মানুষটির স্মৃতি বছরের পর বছর হৃদয়-কোটরে আগলে রেখে দর্শকের চোখে অশ্রু আনতে সক্ষম হয়েছে কে? নির্দ্বিধায় উত্তর আসবে, সেভেরাস স্নেইপ। অসম সাহসের অধিকারী এই হগওয়ার্টস যোদ্ধা প্রথম দর্শন থেকে প্রায় শেষ অংক পর্যন্ত খলনায়ক বিশেষণে বিশেষিত হয়ে শেষ অব্দি তিনি দর্শক, পাঠকদের অনুভূতি নিয়ে বিয়োগান্তক খেলা খেলেছেন।
সেভেরাস স্নেইপ রোলিংয়ের সৃষ্টি করা এমন এক চরিত্র, যার আবেদন কোনোদিন ফুরোবে না। হগওয়ার্টসের খণ্ডিত ইতিহাস আর প্রেম-কাহিনীর এক অনুপম মিশ্রণে বই রাঙিয়েছে চরিত্রটাকে, যেখানে বাস্তবতার দিগন্তে এসে মিশেছে লেখকের প্রত্যক্ষ মর্মপীড়ার অনুভূতি। একদিকে যেমন দেখিয়েছেন, চরিত্রের কঠোর রূপ, অন্যদিকে দেখিয়েছেন গভীর অকৃত্রিম অনুরাগ। স্লিদারিন হাউজের সকল গুণকেই নিজের মধ্যে আগলে রেখে, তা ব্যবহার করেছেন একেবারে সঠিক পন্থায়। ডাবল এজেন্ট হিসেবে, একদিকে যেমন ভলডেমর্টের কাছে অনুগত থাকার নাটক করেছেন, তেমন ডাম্বলডোরের কাছে প্রেরণ করেছেন গোপন সকল তথ্য।
‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ-ব্লাড প্রিন্স’ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি পোশন বিদ্যায় কতটুকু পারদর্শী ছিলেন। ডার্ক আর্ট, পোশন, চার্ম, ট্রান্সফিগারেশন, স্পেল ক্রিয়েশন, নন-ভার্বাল ম্যাজিক, হিলিং ম্যাজিক, সবকিছুতেই তিনি ছিলেন একেবারে নিখুঁত, নির্ভুল ও সম্পূর্ণ। তার ছিটিয়ে দেয়া আলোক-দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছিল ডেথ ইটারদের অমানিশার বিস্তীর্ণ ললাটে। সার-বক্তব্যে, তিনি ছিলেন স্লিদারিনের শ্রেষ্ঠ দর্পণ। জাদু জগত এই মহামতি সেভেরাস স্নেইপকে শ্রদ্ধা-ভরে সবসময় স্মরণ করে।
লর্ড ভলডেমর্ট
জাদু জগতে যে ক’জন জাদুকর ত্রাস সৃষ্টি করতে পেরেছে, তাদের মধ্যে লর্ড ভলডেমর্ট ওরফে টম রিডল অন্যতম। তাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা ও শক্তিশালী কালো জাদুকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাদু জগতে সে এতটাই ত্রাস ছড়িয়েছিল যে, তার নাম মুখে আনতেই ভয় পেত সবাই। লর্ড ভলডেমর্টের পরিবর্তে তাকে ‘ইউ-নো-হু’, ‘হি-হু-মাস্ট-নট-বি-নেমড’ বলে সম্বোধন করা হতো। স্লিদারিনের এই শিক্ষার্থীর হগওয়ার্টসে নিষিদ্ধ হওয়া কালো-জাদু, ডাকিনীবিদ্যা ও পিশাচ-তত্ত্বের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল সবসময়ই।
টম রিডল সবসময়ই মনে অমর হবার ইচ্ছা পোষণ করত। সে মৃত্যুকে মনে করত লজ্জাজনক মানবীয় দুর্বলতা। মৃত্যুই ছিল তার একমাত্র ভয়। সেজন্য সে নিজের আত্মাকে সাতটি টুকরা করে হরক্রাক্সে পুরে দেয়। এভাবেই সে একের পর এক ঘটিয়ে দেয় দুই-দুইটি মহাযুদ্ধ। তার সময়ে কালো জাদুতে তাকে টেক্কা দেবার মতো কেউ ছিল না। পুরো দুনিয়ায় সে শুধু অ্যালবাস ডাম্বলডোরকে সমীহ করত।
কালো জাদুর জগত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা এই জাদুকর ডিমেন্টর, ডেথ ইটার, ওয়্যারওলভ, দৈত্য, ইনফেরিসহ আরও অনেককেই নিজ পরাশক্তির পুতুল বানিয়ে রেখে তুফানের মতো ত্রাস ছড়িয়ে গেছে অনেক বছর। হ্যারি পটার সিরিজে তার তৈরি কঠিন সুরক্ষার বেষ্টনী ভেদ করে হরক্রাক্সগুলোকে ধ্বংস করার পরেই সমাপ্তি ঘটে দুর্ধর্ষ এক খলনায়কের। জয় হয় সত্যের, পতন ঘটে জাদু-জগতের এক কালো অধ্যায়ের।