কথায় বলে, গান ভালোবাসে না, এমন মানুষ পাওয়া বেশ শক্ত। কখনো সুখের সাথী, কখনো দুঃখের আবার কখনোবা অবসর সময়টা কাটানোর একমাত্র সঙ্গী হয় এই সঙ্গীতজগত। গানের হাত ধরেই পরিচয় হয়ে যায় গানের স্রষ্টার সাথে। এভাবেই বিভিন্ন শিল্পী কিংবা ব্যান্ডের সাথে অনেকটা জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক গড়ে ওঠে গানখোরদের। শিল্পীদের পর্দার আড়াল থেকে জনসম্মুখে আসার গল্প কিন্তু সবসময় সুখকর হয় না। তাদের অনেক পাহাড়সম ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলস্বরূপ একদিন তাদের নিয়ে আমাদের মুখে জয়জয়কার শোনা যায়। এমন বিভিন্ন শিল্পীর জীবনের গল্প রূপালি পর্দায় নিয়ে এসেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। আজকে পাঠকদের সাথে এমন পাঁচটি সিনেমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছি, যার মূল গল্প সঙ্গীতকারদের নিয়ে, তাদের সংগ্রাম নিয়ে।
হুইপল্যাশ (২০১৪)
করিডোরের শেষ প্রান্তের এক কক্ষে একাই ড্রাম অনুশীলন করছিল নেইমন। তখনই স্কুলের সবচেয়ে নামকরা সঙ্গীতশিক্ষক মিস্টার ফ্লেচার সেই কক্ষে প্রবেশ করেন। শিক্ষকের উপস্থিতিতে ভড়কে যায় নেইমন।
“তুমি জানো, আমি কে?”
“জি স্যার”
“তাহলে তুমি নিশ্চয় এটাও জানো, আমি শিল্পী খুঁজছি, আমার ব্যান্ডের জন্য?”
“জ্বী স্যার”
“তাহলে তুমি ড্রাম বাজানো বন্ধ করলে কেন?”
এভাবেই প্রথম পরিচয় হয় সঙ্গীতশিক্ষক মিস্টার ফ্লেচার ও প্রথম বর্ষের ছাত্র নেইমনের। লেখক ও নির্মাতা ড্যামিয়েন শ্যাজেল তার ‘হুইপল্যাশ’ সিনেমার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন নিজের জীবন থেকেই। সিনেমার প্রধান চরিত্র নেইমনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাইলস টেলার, যিনি নিজেও একজন ড্রামার। ১৫ বছর বয়স থেকেই, টেলার ড্রামে পারদর্শী। তা সত্ত্বেও, সপ্তাহে তিনদিন করে, প্রতিদিন চার ঘণ্টার অনুশীলনে নিজেকে তৈরি করেছিলেন সিনেমার স্বার্থে।
অন্যদিকে সিনেমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান চরিত্র ‘মিস্টার ফ্লেচার’। রূঢ় এই চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন ষাটোর্ধ্ব অভিনেতা জে. কে. সিমন্স। সিনেমা শেষে এ চরিত্রের জন্য অভিনেতাকে বাহবা দিতে আপনি বাধ্য হবেন নিশ্চিত। বদমেজাজী, রুক্ষ এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য, অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব, বাফটাসহ আরো অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন সিমন্স। পর্দায় ছাত্র-শিক্ষকের এই যুগলবন্দী কখনো গম্ভীর, কখনো আনন্দের, আবার কখনো আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি করে। ‘হুইপল্যাশ’ সিনেমার শেষ ১০ মিনিট, সিনেমাজগতের সবচেয়ে সন্তুষ্টিজনক ক্লাইম্যাক্সগুলোর একটি। অনেকটা পর্দায় টেনে ধরে রাখার মতো এই শেষটা, যা সিনেমা শেষেও অনেকদিন রেশ রেখে যাবে।
বোহেমিয়ান র্যাপসোডি (২০১৮)
হত্যাকারী এক তরুণের আর্তনাদ? নাকি শুধুমাত্র নিজের জীবনের হতাশার গল্পকেই মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন ফ্রেডি মার্কিউরি ও তার ব্যান্ড কুইন, তাদের সৃষ্ট ‘বোহেমিয়ান র্যাপসোডি’ গানের মধ্য দিয়ে? কুইন ব্যান্ডের কালজয়ী এই গান ১৯৭৫ সালে বিশ্ববাসীর কানে পৌঁছালেও এ গানের সৃষ্টি ১৯৬০ সালে ফ্রেডি মার্কিউরির পিয়ানোতে, কোনো এক অলস সন্ধ্যায়। গানের সৃষ্টি আর ফাররুক বুলসেরার একজন ফ্রেডি মার্কিউরি হয়ে ওঠার গল্প নিয়েই এ সিনেমা, ‘বোহেমিয়ান র্যাপসোডি’।
ফ্রেডি মার্কিউরির মতো চরিত্র, যিনি বিশ্ববাসীর সামনে পারফর্ম করেই পরিচিত। যার গান, নাচ, কথা বলার ভঙ্গিমা- সবই শুধু কুইন ব্যান্ডের ভক্ত নয়, যেকোনো সঙ্গীতপ্রেমীরই নখদর্পণে। তার চরিত্র পর্দায় উপস্থাপন করে আবার তাকে জীবন্ত করে তোলা, অভিনেতা রামি মালেকের জন্য কোনো যুদ্ধে নামার মতোই কঠিন কাজ ছিল। তবে এ যুদ্ধ শেষে অভিনেতার ঝুলিতে এসেছে অস্কার, গোল্ডেন গ্লোবসহ আরো অনেক পুরস্কার। মিশরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান অভিনেতা রামি মালেক, ‘বোহেমিয়ান র্যাপসোডি’ নিয়ে তার প্রস্তুতির গল্পতে বলেছেন, ফ্রেডির পুরনো ভিডিও থেকে শুরু করে, তার পরিবারের সকলের কথা বলা, হাঁটাচলা, কোন পরিবেশে ফ্রেডি মার্কিউরি বড় হয়েছেন- সবই নিয়মিত দেখতেন তিনি।
ফ্রেডির সামনের দিকে বাড়ানো দাঁতের জন্য রামিকে আলগা দাঁত ব্যবহার করতে হবে সিনেমাতে, তাই সিনেমার শ্যুটিং শুরু হওয়ার এক বছর আগে থেকেই প্রতি রাতে এই দাঁত পরেই ঘুমাতে যেতেন। যেন অভিনয়ে কোনোরকম অস্বস্তিবোধ না আসে। সিনেমার শেষটা হয়তো আমাদের সকলের জানা। কিন্তু কিংবদন্তি এই শিল্পীর ‘শিল্পী’ হয়ে ওঠার গল্প অনেকেরই অজানা। তাই ফ্রেডি মার্কিউরির জীবনের এই গল্পের সাক্ষী হয়ে উঠতে বোহেমিয়ান র্যাপসোডির জগতে একবার ঘুরে আসতে পারেন।
সাউন্ড অভ মেটাল (২০১৯)
একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয় কোনটি? আচ্ছা আরেকটু সহজ করে প্রশ্নটি করি। একজন সঙ্গীতকারের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয় কোনটি? অবশ্যই, শ্রবণেন্দ্রিয়। একজন সুরকার কিংবা বাদ্যশিল্পীর জন্য সুর শুনতে পারার ক্ষমতাই অনেক মূল্যবান। শ্রবণশক্তি ছাড়া একজন সঙ্গীতকার অসম্পূর্ণ এবং তার সঙ্গীতজীবনও অনেকটা এই ইন্দ্রিয়ের উপরই নির্ভরশীল।
রুবেন একজন ড্রামার। তার ড্রামের সাথে গানে তাল মেলায় বান্ধবী লু। সঙ্গীতের জগতে এই দুজনের যাত্রা শুরু হতে না হতেই, রুবেন বুঝতে পারে, সে তার শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলছে ক্রমশ। ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারল, তার এই শ্রবণশক্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে কি বধির হওয়াই রুবেনের জীবনের শেষ পরিণতি? মাদকাসক্ত রুবিন নিজেকে মাদক থেকে দূরে রেখে এই নতুন জীবনে পা রাখে প্রায় চার বছর আগে। তবে কি সব সম্ভাবনার সমাপ্তি এখানেই?
সিনেমার মূল চরিত্র, রুবেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত, ব্রিটিশ অভিনেতা রিজ আহমেদ। সিনেমায় রিজের অভিনয় সম্পর্কে অনেক সমালোচক বলেছেন, এটি হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে ভালো অভিনয়। একজন বধির ব্যক্তির চোখের ভাষা সেই সাথে তার অঙ্গভঙ্গিমা এবং প্রতীকী ভাষার ব্যবহার- সব মিলিয়ে রিজ আহমেদের অভিনয়ের দক্ষতা ভাবনাতীত। সিনেমায় অভিনয়শিল্পী ছাড়াও প্রশংসিত হয়েছেন দক্ষ শব্দ সম্পাদক দল, জিতে নিয়েছেন অস্কার। প্রধান চরিত্রের বধিরতা দর্শক পর্দায় দেখার সাথে সাথে শব্দের এত সুন্দর ব্যবহারের কারণে অনেকটা অনুভবও করতে পারবেন।
সিনেমার নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার ড্যারিয়াস মারডার তার পরিবারের এক সদস্যের বধিরতা স্বচক্ষে দেখেছেন বলেই হয়তো সিনেমায় তা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ‘সাউন্ড অভ মেটাল’ সিনেমা দুটি বিভাগে অস্কার পায় এবং মনোয়নয় পায় মোট চার বিভাগে। সিনেমার গল্পে শুধু একজন ড্রামারের সঙ্গীতজীবনের কথাই নয়, বরং একজন বধিরতার শিকার এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তির জীবনের গল্পও চিত্রায়িত হয়েছে সুন্দরভাবে।
এমাদিউস (১৯৮৪)
সময়টা ১৮২৩ সাল। গল্পের শুরু হয়, একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে দিয়ে। একজন সুরকার, যিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তিনি সুরকার স্যালিয়েরি। অপরাধবোধে ভুগতে থাকা স্যালিয়েরিকে নিয়ে যাওয়া হয় কনফেশনের উদ্দেশ্যে। কনফেশনের জন্য তার কাছে আসেন একজন পাদ্রী। সেই পাদ্রীর কাছেই তিনি তার আত্মহননের চেষ্টার পেছনের কারণ বর্ণনা করেন এবং ‘এমাদিউস’ সিনেমা মূল কাহিনীতে প্রবেশ করে।
দুজন সুরকার। একজনের নাম মোৎজার্ট, অন্যজন স্যালিয়েরি। দুজনের শিশুকাল, যেখানে মোৎজার্ট উচ্চবিত্ত পরিবারের এবং স্যালিয়েরী মধ্যবিত্ত। মোৎজার্টকে বলা হতো চাইল্ড প্রডিজি, কারণ তিনি ছিলেন ভায়োলিন ও পিয়ানোতে পারদর্শী। যেকোনো সুর একবারে শিখে ফেলা, আট বছর বয়সে প্রথম সুর তৈরি, ১২ বছর বয়সে প্রথম অপেরা সঙ্গীত রচনা- সবকিছুই ছিল মোৎজার্টের আয়ত্তে। অন্যদিকে সুরের প্রতি অত্যধিক ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও বাবার অপছন্দের কারণে সঙ্গীতচর্চা করতেন পারতেন না স্যালিয়েরি। ওদিকে মোৎজার্টের পিতা তার সঙ্গীতসাধনার নিত্যসঙ্গী ছিলেন। স্যালিয়েরির অনুপ্রেরণা ছিলেন মোৎজার্ট। মোৎজার্টকে দেখে তার ভেতরের সঙ্গীতানুরাগ বাড়তে থাকে।
ঈশ্বরের কাছে নিয়মিত সঙ্গীতচর্চার জন্য প্রার্থনা করতেন স্যালিয়েরি। একদিন অকস্মাৎ পিতার মৃত্যুকে স্যালিয়েরি ভেবে নেন ঈশ্বরের দেওয়া বর। এ যেন ঈশ্বরই তাকে অনুপ্রাণিত করলেন সঙ্গীতসাধনায়। এভাবেই শুরু হয় তার পথচলা। কিন্তু একসময় এই দুই সুরকার, দুজনের সঙ্গীতজীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে থাকেন। যেকোনো একজনের মাথায়ই শোভা পাবে চূড়ান্ত মুকুট। শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে ছোটখাট সঙ্গীতযুদ্ধ, যা পরবর্তী সময়ে শুধু সঙ্গীতে নয়, তাদের নিজেদের জীবনেও ছাপ ফেলতে থাকে।
মোৎজার্টের শিশুসুলভ চরিত্রে অভিনয় করেছেন টম হালস। এ চরিত্রের জন্য তিনি মনোনীত হয়েছিলেন সেরা অভিনেতা হিসেবে। অন্যদিকে স্যালিয়েরী চরিত্রে অভিনয় দিয়ে তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন মুররে। ঝুলিতে নিয়ে এসেছেন সেরা অভিনেতার অস্কার। সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টার এই সিনেমা, আশির দশকের অন্যতম চমক ছিল। পর্দায় মোৎজার্টের এই বায়োপিক পেয়েছিল সাড়া জাগানো প্রতিক্রিয়া।
গাল্লি বয় (২০১৯)
স্বপ্নের শহর মুম্বাই। এই শহরের ধারাভি বস্তির সরু গলি থেকে উঠে আসা এক র্যাপারের গল্পই হল ‘গাল্লি বয়’। র্যাপার ডিভাইন এবং র্যাপার নাইজির জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে মুরাদ নামের প্রধান চরিত্রের সৃষ্টি। বলিউডের অগ্রগণ্য নারী পরিচালক জোয়া আখতারের এই সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পরেই সাড়া জাগানো প্রতিক্রিয়া পেতে থাকে দর্শকের কাছ থেকে। শুধু দর্শক নয়, সমালোচকদের কাছে থেকেও ‘গাল্লি বয়’ ছিনিয়ে এনেছে প্রশংসা। এই সিনেমার সিগনেচার থিম সং, ‘আপনা টাইম আয়েগা’ শুধু মুম্বাইয়ের অলিগলিতে নয়, আমাদের দেশের অনেক ঘরেও পৌঁছে গিয়েছিল মুহূর্তেই।
সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন রনভীর সিং ও আলিয়া ভাট। র্যাপার মুরাদ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রনভীর সিং ঘরে ফিরেছেন ফিল্মফেয়ার নিয়ে। সেরা অভিনেত্রী হিসেবে আলিয়ার ঝুলিতেও এসেছে ফিল্মফেয়ার। শুধু রনভীর কিংবা আলিয়া নন, ‘গাল্লি বয়’ সিনেমা মোট ১৩ টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতে রেকর্ড গড়েছে বলিউডের ইতিহাসে। গাল্লি বয়ের এই সাফল্যের পর অনেকেই বিদ্রূপ করে বলতে থাকে, এ সিনেমায় দেখানো যানবাহন বা জড়বস্তুগুলোকেও যেন পুরস্কার দেওয়া হয়। শুধুমাত্র তারাই পুরস্কারের খেতাব থেকে বঞ্চিত আছে!
র্যাপার চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে রনভীর সিং নিজেও র্যাপ গানে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। কাঠখোট্টা প্রেমিকার চরিত্রে আলিয়া ভাটের অভিনয় সকলের মনে দাগ কেটেছে। ‘গাল্লি বয়’ সিনেমার মাধ্যমে অনেক র্যাপার এসেছেন লাইমলাইটে। এ সিনেমায় ব্যবহৃত সব র্যাপ গানই সংগ্রাম করে উঠে আসা র্যাপারদের গলায় গাওয়া। ‘গাল্লি বয়’ মূলত এক জিতে যাওয়া গল্পের নাম। বস্তির এক কোণায় পড়ে থাকা এক ছেলের স্বপ্ন পূরণের গল্প। পাগলাটে প্রেমিকাকে সাথে নিয়ে জীবনযুদ্ধ জয় করার গল্প।