মুনির হাসানের নামটা বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের সাফল্য আখ্যানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে এর বাইরেও তার কিছু পরিচয় আছে। তিনি উদ্যোক্তা ও তারুণ্য এই দুইয়ের মেলবন্ধনের মাধ্যমে ডিঙোতে চাইছেন তারুণ্যের সবচেয়ে বড় শত্রু বেকারত্বের বাঁধা আর তারুণ্যকে বের করতে চাইছেন ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ হতাশার চোরাগলি থেকে।
বই বিষয়ক প্লাটফর্ম Goodreads-এ জনৈক আলোচকের ভাষায়,
আমাকে যদি পজিটিভ আর ইন্সপায়ারিং মানুষদের একটা লিস্ট করতে দেয়া হয় সেই লিস্টের প্রথম পাঁচজনের মধ্যে অবশ্যই মুনির হাসান স্যারের নাম থাকবে। পজিটিভ মানুষ মানে হল যারা কখনও হতাশ হয় না! পুরো ইউনিভার্সে ভয়াবহ একটা বিশৃঙ্খলা শুরু হলেও স্যার মনে হয় হতাশ না হয় নিজের কাজ করে যাবেন! …আজ ম্যাথ অলিম্পিয়াড করছেন তো কাল BdOSN কিংবা প্রোগ্রামিং কর্মশালা না হয় তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রেরণা দিচ্ছেন। …নিজে স্বপ্ন দেখছেন এবং অন্যকে দেখাচ্ছেন।
তার প্রশংসনীয় এই কাজগুলোর সাথে সম্পর্ক রেখে তিনি সময়ে সময়ে রচনা করেছেন বেশ কিছু বই। শরবতে বাজিমাত, গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং, গল্পে গল্পে ধাঁধা, অঙ্কের ধাঁধা ধাঁধায় অঙ্ক তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এদের বাইরেও তার একটি আত্মজৈবনিক বই আছে, পড়ো পড়ো পড়ো; যদিও এটিকে পুরোপুরি আত্মজীবনী বলা যাবে না, কারণ, এটি আসলে তার জীবনের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশের উপর আলোকপাত করেছে। সেটি হচ্ছে লেখকের বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) জীবন।
বুয়েট কিংবা বুয়েট ঘরানার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাত্রেই বইটির বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন স্মৃতিচারণের সাথে নিজের স্মৃতির সম্মিলন ঘটাতে পারবেন। আসলে অল্প কিছু ব্যাপার বাদ দিলে এটা যেন প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচের কথা। উত্তপ্ত দিনগুলোতে মিছিলের যে রোমাঞ্চকর বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, হল জীবনের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, এগুলোর সাথে প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিল খুঁজে পাবেন। পাশাপাশি নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপের অনেক ঘটনাই সেই সময়কার স্নাতক শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তাদের একসময়কার চেনা পরিচিত গণ্ডির বিভিন্ন স্মৃতির আলয়ে।
স্কুল ও কলেজ জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অনেকটাই আলাদা। এই জীবনটা নিজেকে জানার সময়, নিজেকে চেনার সময়, নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা, ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশ পাওয়ার সময়, সর্বোপরি নিজের আত্ম অনুসন্ধানের সময়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই ঠিক এই দিকটিতে লেখক তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, যার উপস্থিতি পাওয়া যায় বইয়ের মুখবন্ধের একাংশে,
বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের পুরো সময়টা জুড়ে লেখক নিজেকে সন্ধান করে ফিরেছেন। কখনো মিছিলে, কখনো আকাশ দেখায় কিংবা কখনো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে।
এসব দিক বিবেচনা করে এক অর্থে বইটিকে কিছুটা হলেও জীবনপথের দিক-নির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কেননা, শুধুমাত্র পড়াশোনা আর পরীক্ষার ভালো ফলাফলের বাইরেও যে অনিন্দ্যসুন্দর একটা জগৎ আছে, তা অনেক শিক্ষার্থীই ভুলতে বসেছে। কিংবা তাদের জোরপূর্বক ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায়, তাদের জন্য একটা প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে স্মৃতিকথামূলক এই বইটি।
বইটির একেবারে শেষ দিকে উপসংহারে উল্লেখ করা বই, চলচ্চিত্র ও বক্তৃতার যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তা একবার স্পর্শ করা শুরু করলেই বোঝা সম্ভব এর মাহাত্ম। এটি ভেবেই বইয়ের বাইরে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখক এর প্রচারণার সাথে তার নিজস্ব একটা ভাবনাও যুক্ত করে দিয়েছিলেন সে সময়। যেহেতু বইয়ের প্রকাশকালের (ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) অনতিবিলম্বেই এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে, কাজেই এই বইটা সেই পরীক্ষার্থী কিশোরদের জন্য আদর্শ একটা রসদ হতে পারে পরবর্তী জীবনের জন্য। কারণ, লেখক চান আত্মানুসন্ধানের কাজটি শুরু হোক কিশোর বয়স থেকেই।
এছাড়াও, বইয়ের কিছু জায়গায় লেখক লিখেছেন, “এটা আমার কাজের দর্শন”, কিংবা “এটা আমার লেখার দর্শন”। যারা তাদের জীবনকে সামাজিক কল্যাণমুখী কাজের সাথে একসূত্রে গাঁথতে চায়, চায় কাজের মধ্যেই জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরতে, কিংবা চায় পরিবর্তনমুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নয়ন সাধন করতে, তাদের জন্যও এই বইয়ের বিষয়বস্তু হতে পারে উল্লেখ করার মতো কিছু।
এতটুকু পড়ে অনেকে হয়তো ভেবে বসতে পারেন, এটি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও এর ক্রিয়াকলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসলে, তা নয়। লেখক তার চোখের ক্যামেরায় তৎকালীন সমাজ জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা আর তার সাথে সন্নিহিত ইতিহাস তুলে এনেছেন প্রয়োজন মতো। স্বৈরাচারী এরশাদের শাসন ও তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদের পতন, তৈরী পোশাক শিল্পের উত্থান এবং তার সাথে সমার্থকসূচক বেসরকারি ব্যাংকের নবযাত্রা, সর্বোপরি আশির দশকের ক্রান্তিকালীন সময়ের বিভিন্ন আলেখ্য এই বইটিতে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।
বইয়ের নাম ‘পড়ো পড়ো পড়ো’ হলেও এটি আসলে পড়াশোনার বই নয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনা বাদ দিয়ে শুধু ঘুরে ঘুরে বই পড়ার নেশাকে উদ্বুদ্ধ করার বইও নয়। ইতোমধ্যে এটা বুঝে ফেলার কথা পাঠকের। তবে, বইয়ের এই নামকরণের পেছনেও আছে লেখকের এক গভীর জীবনবোধ, যাকে লেখক জীবনে পথ চলার এক গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় বলে মনে করেন। এটিকে এ পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত না করে বরং আশা করছি আগ্রহী পাঠক একে বইয়ের পৃষ্ঠায় খুঁজে ফিরবেন।
লেখকের লেখার ধরন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। যারা লেখককে ফেসবুকে, ব্লগে, কলামে বা বইয়ে অনুসরণ করেন, তারা মাত্রেই জানেন, লেখকের বক্তব্যের ঢং খুবই সাবলীল, প্রথম দর্শনেই ভালো লাগার মতো। লেখক বর্ণনা দেন মেপে মেপে, এটি যেন কারও বিরক্তি উদ্রেক না করে; লিখেন আড্ডা দেওয়ার আঙ্গিকে, যেন পড়ুয়া যে কারো মনে হয় যে বক্তা আসলে তারই কোনো ঘনিষ্ঠজন; নিজের ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করেন এমনভাবে যে, এটি তার উপর কোনভাবেই আরোপিত নয়, বরং আত্মউপলব্ধির মধ্য দিয়েই তার এ ভাবনাগুলোর উন্মেষ। বইটিতে এ দিকগুলো তো খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও পাওয়া যাবে,
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।
কবি সুনির্মল বসুর সবার আমি ছাত্র কবিতার সুবিখ্যাত এই পঙক্তিটির বাস্তব চিত্রায়ন।
পরিশেষে, বইয়ের একটি প্রিয় জায়গা উদ্ধৃত করে শেষ করছি,
আসাদুজ্জামান নূর স্টলে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিয়েছেন। উনি বসে আছেন। ক্যামেরা প্রথমে দেখাল একটা লেখা ‘এখানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষেধ’। ক্যামেরা ঘুরে স্থির হল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গ্লাস ভাঙার শব্দ শোনা গেল এবং নেপথ্যে কেউ একজন বলে উঠল, ভাঙলি তো গেলাসটা। তারপর রফিজ চা দিয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি!
আমার যদি সিনেমা বোঝার পড়ালেখা না থাকত তাহলে আমি কখনোই এই দৃশ্যের মর্তবা বুঝতে পারতাম না। বোঝার পরেই আমি বুঝলাম সিনেমা কি জিনিস। তারপর থেকে আমি হয়ে উঠলাম সিনেমাভুক।
লেখক মুনির হাসানের লেখা পড়তে চাইলে দেখতে পারেন লেখকের ব্যক্তিগত ব্লগ।