সাবেক ফুটবলার আজাদ এখন মাঝবয়সী ক্ষ্যাপাটে কোচ। নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে রয়ে গেছে অনেক না পাওয়ার আক্ষেপ। জাতীয় ফুটবল টিমে বেশ কিছুদিন থাকার সুযোগ হলেও মেলেনি স্বপ্নের সাফ গেমসের স্কোয়াডে থাকার সুযোগ। যদিও সাবেক এই সেন্টারব্যাকের সেরা সময় চলছিল তখন। তবুও সুযোগ মিলেনি ক্লাব ফুটবলের একটি ম্যাচে নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার দায়ে।
হ্যাঁ, সর্বোচ্চ দেয়ার দায়েই। প্রস্তাব ছিল এক ম্যাচ শুধু বিপক্ষ দলকে জিততে দিতে, গোল করতে বাধা না দিতে! সততার সাথে আপোষ করতে রাজি না হওয়ায় হারাতে হয় জাতীয় দলের জায়গা।
ফুটবল যার ধ্যান-জ্ঞান, রিটায়ার্ডমেন্টের পর সেই আজাদ প্রস্তুতি নেয় ফুটবল কোচ হওয়ার। নতুন প্রতিভার সন্ধানে ঘুরে বেড়ান প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের নতুন এক মুখ আজাদের নজর কেড়ে নেয়, যার নাম সমর কুমার চাকমা।
পাহাড়ে বড় হওয়া ছেলে সমর। বাবা শান্তিবাহিনীর (পার্বত্য অঞ্চলের শান্তিবাহিনী, একাত্তরের শান্তিবাহিনী নয়) সাবেক সদস্য রতন কুমার চাকমা। বুটের লাথির আঘাতে যিনি শয্যাশায়ী দীর্ঘদিন ধরে। আঘাতগুলো খেলার মাঠের নয়, আন্দোলনের মাঠের।
তবে ফুটবলের মাঠে এই বুটের লাথির জুজু তাড়িয়ে বেড়ায় সমর চাকমাকেও। বয়সে বড় ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে গিয়ে ল্যাঙ খেয়ে অনেকদিন আহত হয়ে বাসায় ফিরেছে। দাদি তখন পায়ে তেল মালিশ করে দিয়েছে। এই দাদির কাছেই সমরের বড় হওয়া।
আবার ফুটবল খেলার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে শান্তিপ্রিয়া নামের মেয়েটাকে দেখাও ছিল সমরের অভ্যাস৷ বলা যায়, পছন্দই করত মেয়েটাকে। দেখতে সুন্দর ছিল বেশ। সেটাই হয়ত কাল হলো মেয়েটির জন্য। ঘটনাচক্রে ইউপি চেয়ারম্যানের ভাই- সোহেল নুর, বন্ধুদের নিয়ে ধর্ষণ করে শান্তিপ্রিয়াকে।
ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে মহানগরের হয়ে সমর চাকমার অভিষেক হয় আজাদের হাত ধরে, মুছে যায় না সেই স্মৃতি। ঢাকায় সমর চাকমার স্থান জুটে আরিফের বাসায়। আরিফ, সম্পর্কে আজাদের ভাগ্নে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে রেজাল্ট এবং চাকরির অপেক্ষায়। আপনার আমার মতোই সাধারণ একজন৷
অন্যদিকে আরিফের বন্ধু হিমেল, যার জানাশুনার পরিধি সর্বমুখী। আরিফের সাথেই গ্রাজুয়েশন শেষে রেজাল্টের অপেক্ষায়৷ তবে ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে এক রিসার্চ ফার্মে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, প্রতিবেদন তৈরির কাজে। আরিফকেও সেই রিসার্চ ফার্মে নিয়ে এসে হিমেল এবং আরিফ বেরিয়ে পড়ে তাদের অফিস থেকে দেয়া তাদের নেক্সট প্রজেক্টে। পার্বত্য অঞ্চল এবং পাহাড়িদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে।
ছোট্ট দেশ আমাদের। তবু এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি কত সীমিত। পার্বত্য অঞ্চলের শান্তিচুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে, খুব কম লেখাতেই ঝাপসা ধারণা আসলেও, পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য পদতলে চমকায় মাটি উপন্যাসটি সুহান রিজওয়ানের সার্থক প্রয়াস।
লেখকের প্রথম বই সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ, ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে৷ তবে লেখক জনপ্রিয়তায় প্রভাবিত না হয়ে সময় নেন। ৪ বছর পরে তার দ্বিতীয় বই পদতলে চমকায় মাটি প্রকাশিত হয়৷
বলা যায়, বইটিতে দুটি ধারা এবং দুটি গল্প একসাথে চলেছে। একদিকে নিজের নতুন অনুসন্ধান সমর চাকমাকে নিয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আজাদের এগিয়ে চলার সংগ্রাম। অন্যদিকে হিমেল এবং আরিফের পার্বত্য অঞ্চলে, পাহাড়ি বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়া।
একদিকে বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাস, অতীত অবস্থা, প্রিমিয়ার লীগের কন্ডিশন, বর্তমান পরিস্থিতি সহ বিভিন্ন দিক ফুটে এসেছে। এ ধারাটি ফিকশন স্টাইলেই লেখা৷ তাই গতিও ছিল বেশি। পাঠককে ধরে রাখার মত লেখনী, তাই পড়ে যেতেও অসুবিধা হয়নি এবং অত্যন্ত সুখপাঠ্য।
অন্য ধারাটিতে পাহাড়ি মানুষের সংগ্রাম, তাদের অধিকার বঞ্চনা, নিজেদের মধ্যে বিভেদ, পাহাড়ি নেতাদের নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া, স্থানীয় রাজনীতি ইত্যাদি দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই অংশ মূলত ফিকশন স্টাইলে নন ফিকশন লেখা।
বলে না, গল্প হতে বাস্তবতা অধিক রোমাঞ্চকর? তাই লক্ষ্য করা যায় এখানে। তবে এই অংশ অনেকটা ধীরগতির। বাস্তবতার সম্মুখীন হলেও, পাঠককে ধরে রাখার মত উপাদান এই অংশে কম। তাই একটানে হয়ত পড়ে ফেলতে পারবেন না, তবে বিরক্ত লাগার আশঙ্কাও কম।
পুরো লেখা কিছুটা ধীরগতির, তবে বিরক্তিকর নয়। লেখকের বর্ণনাভঙ্গিই এজন্য দায়ী অনেকটা। অনেকটা ক্ল্যাসিকাল উপন্যাসের ধারা যেন আছে এখানে। প্রচণ্ড বর্ণনাবহুল লেখা, সংলাপের পরিমাণ কম। লেখায় উপমার ব্যবহার প্রচুর। অনেক সময় সেগুলি যথার্থভাবে ব্যবহৃত, অনেকসময় খাপছাড়া।
লেখকের এই বইয়ের বর্ণনাবহুল লেখনী ভিন্ন ধারার। অনেককে মুগ্ধ করতে পারে, আবার বেশি পেঁচিয়ে টানার জন্য অনেকে বিরক্তও হতে পারে। অনেক সময় নিজেও খেই হারিয়ে ফেলেছি৷ আবার অনেক সময় বর্ণনায় সূক্ষ্ম কিছু বিষয় তুলে ধরার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছি৷
আমাদের সমাজের বেশকিছু অসঙ্গতি সূক্ষ্ম খোঁচার মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন। বর্তমান সামাজিক অবস্থার সম্যক ধারণা বইটি থেকে পাওয়া যাবে।
বইয়ের চরিত্রগুলো ছিল বইয়ের প্রধান অলঙ্কার। আরিফ, হিমেল, আজাদ, সমর- বইয়ের ৪টি প্রধান চরিত্র। গল্পের চতুষ্কোণ। সবগুলো চরিত্রই যেন আপনার আমার চেনা-পরিচিত। আশেপাশেই আরিফ-হিমেলদের মত উদ্যমী তরুণ দেখতে পাওয়া যায়। আজাদের মত মানুষও একেবারে বিরল নন। সমর চাকমাদের সাথেই হয়তো আমরা পরিচিত না। তবে এই চরিত্রই পুরো গল্পে সবচেয়ে সুগঠিত। মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। পুরো গল্পের হিরোইক ক্যারেক্টার হিসেবেও বলতে পারেন।
এই ৪জনের বাইরেও ছোট বড় অনেক চরিত্র গল্পে এসেছে। তবে সবগুলো সুগঠিত নয়। বিশেষ করে বিজয় গল্পে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, তার ক্যারেক্টার আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে বিকশিত করা যেত।
বইতে খুব চোখে লেগেছে লেগেছে লেখকের ‘এ’ এর পরিবর্তে ‘অ্যা’ এর ব্যবহার৷ প্রথমে বিষয়টি সাধারণ বানান ভুল হিসেবে মনে হলেও, পরে ভুল ভাঙে। লেখক ইচ্ছাকৃতভাবেই এ এর উচ্চারণ ‘অ্যা’ রেখেছেন।
যেমন:
কেমন = ক্যামন
এমন = অ্যামন
যেমন = য্যামন
ফেলেন = ফ্যালেন
এত = অ্যাতো
দেখো = দ্যাখো
গেছে = গ্যাছে
একদম = অ্যাকদম
বইটির উল্লেখযোগ্য দিক হলো পার্বত্য অঞ্চলের সমসাময়িক নানা দিক এবং আলোচিত অনেক ঘটনা বইটিতে এসেছে। তবে একমুখোভাবে নয়। লেখক বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে ঘটনাগুলো দেখার এবং দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
শুধুমাত্র সমস্যাগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলেই ক্ষান্ত হননি। সেগুলোর গোঁড়ায় পৌঁছেছেন এবং কেন এই সমস্যাগুলো এখনো সমাধান করা যাচ্ছে না তা দেখার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে তা বর্ণনা করেছেন।
তবে এদিকে বিস্তারিত বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক শেষের দিকে সমর এবং আজাদ’দের অবহেলায় ফেলে রেখেছেন। ফলে পুরো গল্প শেষের দিকে আরো ধীরগতির হয়ে পড়েছে। তবে গল্পের সমাপ্তি ভালো লেগেছে। ছোট গল্পের মতো শেষ হয়েও হইলো না শেষ।
সব মিলিয়ে বলব, বইটি সুখপাঠ্য এবং সমকালীন উপন্যাস হিসেবে বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন।
বইয়ের নাম: পদতলে চমকায় মাটি || লেখক: সুহান রিজওয়ান
প্রকাশনা: ঐতিহ্য প্রকাশনী || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম